ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অদৃশ্য জাদুকরের ইন্দ্রজাল

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২৪ মার্চ ২০১৭

অদৃশ্য জাদুকরের ইন্দ্রজাল

ঊনবিংশ শতাব্দী ছিল ফরাসী চিত্রকলার এক অসামান্য গৌরবোজ্জ্বল যুগ। আর এই সময়ে ব্যতিক্রমী ঐশ্বর্যে ঝলমল করে ওঠেন যে শিল্পী তিনি হলেন পল সেজান। তিনি তাঁর শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে যে বিশ্বাসটি তুলে ধরলেন তা হলো শিল্প মূলত বাস্তবের অনুকরণ নয়, সে নিজেই একটি স্বাধীন ও স্বয়ম্বর বাস্তবতা, তার নিজস্ব একটা লজিক আছে এবং সেই লজিকের ভিত্তিতেই তার সৃষ্টি। পল সেজান পোষ্ট ইম্প্রেশনিজমের জনক হলেও তিনি ছিলেন কিউবিজমেরও পথিকৃৎ। সেজানের কাছে কাঠামোর প্রশ্ন ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর শিল্পকলায় প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের এক নতুন রূপ খুঁজে পাওয়া যায়। আর সেটি হলো তাঁর ছবি প্রকৃতির অনুকরণে আঁকা নয়, আলোকচিত্রের আদলেও নয়, এমনকি ইম্প্রেশনিস্টদের মতো করেও নয়। বরং তাঁর চিত্রে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল স্থায়ী গড়ন নির্মাণের। তিনি বিশ্বাস করতেন সব কিছুতেই যদি আমরা রংকে দেখতে পাই তাহলে রংই গড়ন তৈরি করতে পারে এবং আলো-ছায়ারও সৃষ্টি করতে পারে। রং আনতে পারে গভীরতা এবং দূরত্ব। রংই আনতে পারে গড়ন এবং ঘনত্বের। রংই হচ্ছে একমাত্র দৃশ্যগত অনুভূতির উৎস, যা ইম্প্রেশনিস্টগণ দেখিয়েছেন, তা ঠিক তেমনি গড়ন ও দৃশ্যগত অনুভূতি সৃষ্টি করতে সক্ষম। প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে সেজান তাঁর চিত্রকলায় আনলেন এক বুদ্ধিবৃত্তিক শৃঙ্খলা। নিয়বচ্ছিন্নভাবে কাজ করে তিনি তাঁর ভাষায় ‘মটিফ’ নির্মাণে ব্রতী হলেন। সেজান প্রতিটি দৃশ্যমান বস্তুকে একটি নির্দিষ্ট গড়নে উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেছেন ‘একজন চিত্রকরকে প্রকৃতিকে সিলিন্ডার, গোলক এবং মোচাকৃতি ভেবে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করতে হবে।’ সেজান প্রচুর প্রাকৃতিক দৃশ্য, মনুষ্যচিত্র এবং স্টিল লাইফ অঙ্কন করেছেন। এর মধ্যে তাঁর স্টিল লাইফগুলো বেশি বিখ্যাত। বিষয়বস্তুগুলোকে তিনি যেভাবে দেখেছেন সেভাবে আঁকেননি। বিষয়বস্তু সম্পর্কে যা জানেন, সেভাবে আঁকার চেষ্টা করেছেন। যেমন একটি ফল নরম এবং রসালো, কাঁচ স্বচ্ছ বস্তু, থালা বাসন শক্ত বস্তু, কাপড় কোমল বস্তু এসব বৈশিষ্ট্যকে তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ একটি বস্তুর অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। কিউবিজম সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা সেজানের অঙ্কন রীতিতে অন্তর্নিহিত ছিল। সেজানের যে কোন ল্যান্ডস্কেপ দেখলে মনে হবে যেন ছবির গাছপালা, ঘাসের তলায় তিনি পৃথিবীর বুকের নিচের পাথরও এঁকেছেন, ছবির রঙের উপরের পর্দাটা তুললেই যা দেখা যাবে। ‘লা মনতান সেন্ট ভিকটোরি’ ছবিটি তাঁর বাড়ির নিকটের দৃশ্যাবলী নিয়ে অঙ্কিত। আলোকিত বিশাল প্রকৃতির এক ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তকে শিল্পী এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন। দীর্ঘ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আলোকিত বিশাল এক ভূখ-ের চিত্র এঁকেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। সামনে একটি পাইন বৃক্ষকে সংস্থাপন করেছেন। অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়বস্তু, আবার কিছুটা ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে দেখা। ওপরে রয়েছে সবচেয়ে বড় বিষয়বস্তু পাহাড়, যাকে রেখা ব্যবহার করে আঁকা হয়েছে। নির্দিষ্ট রং দ্বারা স্পেস বিভজেন করা হয়েছে। গাছপালা ঘরবাড়ি প্রতিটি জিনিসকে রঙের মাধ্যমে ফর্মের আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। সেজানের ল্যান্ডস্কেপ দেখে মনে হয় যেন ছবির মধ্যে ঢুকে আমরা তার মাঠে, ঘাটে, পাহাড়ে বেড়িয়ে বেড়াতে পারি, সর্বদাই পায়ের তলায় শক্ত মাটি পাবো। সেজানের যে কোন প্রতিকৃতি দেখলেও তেমনি মনে হবে, মুখের চামড়ার তলায় আছে রক্তমাংস, তার তলায় হাড়ের শক্তখুলি। ‘লাল ফতুয়াপরা বালক’ ছবিটিতে তাঁর এ বিশেষ রীতি মানবদেহ অঙ্কনে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে ছবির স্পেসকে তিনি ভেঙেছেন। রঙের জ্যামিতিক চরিত্র এখানে একবারে সামনে উঠে এসেছে। লাল ফতুয়াপরা বালকটি টুপি মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার বা হাতটি অস্বাভাবিক লম্বা, তুলনামূলকভাবে কোমরের কাছে বাঁকিয়ে ধরে রাখা ডান হাতটি অনেক হ্রস্ব। পিছনের ঝোলানো কাপড়কে এত জোড়ালো করে আঁকা হয়েছে, যেন তা মূল বিষয়ের ওপর এসে পড়েছে। জ্যামিতিক চরিত্রের গড়ন দৃষ্টিকে সামনে পেছনে নিয়ে যায়। বালকের ডিম্বাকৃতি মুখ এবং পোশাক ও পেছনের কাপড়ের মধ্যে এক ধরনের ধাতব অনুভূতি লক্ষ্য করা যায়। ছবির ক্ষেত্রকে সেজান এমনভাবে ভেঙেছেন, পেছনের পর্দা, সামনের বালক, তার পোশাক, নিচের দিকে ডান কোণে চেয়ারের একটুখানি অংশ, সব কিছু এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন যেন মূল বিষয়বস্তু অর্থাৎ বালকটির নিজস্ব প্রাধান্য কমে গিয়ে শিল্পী যে শিল্পকর্মটি তৈরি করেছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ছবিতে গড়নের সরলীকরণ, তাদের ভাস্কর্যসুলভ উপস্থিতি এবং শান্ত- স্থবির সৌম্যরূপ যা ঊনবিংশ শতাব্দীর চিত্রকলার ইতিহাসের এক নতুন অবদান। তাঁর যে কোন চিত্রের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তিনি আলো, ওজন, ঘনত্ব ও নিরেট ভাব রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর ‘তাস খেলা’ নামক চিত্রে দেখা যায় দু’জন গ্রাম্য লোক একটি গ্রাম্য ক্যাফের টেবিলে বসে তাস খেলছে। এখানে গ্রাম্য লোক দুুটির যথার্থরূপ পোশাক পরিচ্ছদ ইম্প্রেশনিজম ভাব ধারায় চিত্রিত হয়েছে। চিত্রে ঘনত্ব ও বোধ সৃষ্টির চেষ্টার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বস্তুর সঠিক আকারের পরিবর্তন ঘটাতে হয়েছে। যার ফলে সেজানের চিত্র আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে ভিন্নতর অবয়ব নিয়ে। সেজানের যে কোন স্টিল লাইফ দেখলে মনে হবে যেন আপেল ফলগুলো মাটির রসে অসম্ভব ভারি। পৃথিবীর গুণ যেন তার মধ্যে। এই সবের জন্যে তাঁর ছবিতে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতা তিনটি গুণই এসেছে, যেটা সেজানের একান্ত নিজস্ব। ‘স্টিল লাইফ’ নামাঙ্কিত সেজানের একটি ছবিতে শিল্পীর শিল্পাদর্শ ও অঙ্কননৈপুণ্য অসামান্য সাফল্যের সঙ্গে রূপায়িত হয়েছে। ছবিটিতে আছে একটি টেবিল, তার উপর একটা কাপড় বিছানো, কাপড়টা টানটান ও মসৃণ করে পাতা নয়। উঁচুনিচু হয়ে আছে। একদিকে বেশি নামানো, অন্যদিকে কম। বস্তুত পক্ষে দুটো কাপড় রয়েছে, বেশির ভাগ অংশে রয়েছে নীলচে রঙের পাতার নকশা আঁকা। অপেক্ষাকৃত ছোট অংশে রয়েছে সাদা কাপড়, সেটাও অগোছালো। একেবারে ডানদিকে টেবিলের খুব সামান্য একটু অংশ অনাচ্ছাদিত। তার পায়ের উপরের দিকটা চোখে পড়ে, সেখানে রং হলো হাল্কা বাদামি, কাঠের রং। টেবিল ক্লথের উপরে ধরা আছে কয়েকটা আপেল। হলুদাভ ও লাল, আশ্চর্য প্রাণবন্ত, দুটি কাঁচের সোরাইমতো ও একটি গ্লাস। কাঁচের জার, গ্লাস, কুঁচকে থাকা টেবিল ক্লথ, আপেল সবকিছুই সেজান এঁকেছেন একটা বিশেষ ভঙ্গিতে। কাঁচের পাত্র ও আপেলগুলো যেন সিলিন্ডার আর স্ফিয়ারের মতো হয়ে উঠতে চাইছে। এমনকি কাচের ওপর পড়া তীব্র আলোকগুলোও সলিড গড়নে রূপ নিয়েছে। তাছাড়া রঙের ব্যবহারও লক্ষণীয়। রূপবাদীদের রং ভেসে ভেসে যায়, কিন্তু এখানে একটা রং আরেকটা রঙের পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সব মিলে নির্মিত হচ্ছে একটা রঙের স্থাপত্য। সেজান আপেলের মোটিফ নিয়ে এবং স্টিল লাইফ নাম দিয়ে একাধিক ছবি এঁকেছেন। সর্বত্রই তিনি উপরোক্ত বিশেষ ভঙ্গিটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। ‘স্টিল লাইফ উইথ বাসকেট অব এ্যাপেলস’ চিত্রে বোতল, টেবিল, কাপড়, ঝুড়ি, আপেলগুলোসহ প্রতিটি জিনিসের মধ্যে একটি কৌণিকভাব বিদ্যমান। সেজান এখানে বস্তুর গঠনকে উপস্থাপন করেছেন বাস্তব থেকে ভিন্ন ভাবে, তিনি যেভাবে দেখতে চান সেভাবেই উপস্থাপিত। রং এবং ফর্মের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার ঘটেছে এই ছবিতে। আপেল আঁকতে গিয়ে সেজান আপেলের খোসার ওপর আলোটা ছোট ছোট টুকরো বা স্তরে ভেঙ্গে দিয়েছেন। প্রত্যেকটি স্তর এঁকেছেন অদ্ভুত উজ্জ্বল রঙে। সে রংকে ভেঙে দিয়েছেন আবার নানান রঙে। সেই সঙ্গে ছবির মধ্যে সব রং আর স্তরগুলোকে রেখেছেন পরস্পরের মধ্যে একসঙ্গে বেঁধে, যাতে সমস্ত ছবিটা গভীর, ভারি, পার্থিব দেখায়। তাঁর ছবি শুধু সমান, দৈর্ঘ্য প্রস্থে স¤পূর্ণ ক্যানভাসের জমি নয়। আস্তে আস্তে রঙের পর রং মিলিয়ে একের পর এক সমতল, মনে হয় যেন ধাপে ধাপে নানা আকারের নানা গড়নের, নানা রঙের, রঙের চাপ ছবির পিছন দিকে চলে গেছে। ছবির পরিপ্রেক্ষিত থেকে এ রীতি তফাৎ। সেজানের ছবিতে এই দৈর্ঘ্য প্রস্থ- গভীরতা, তিন গুণ থাকার ফলেই হয় পরবর্তী যুুগের কিউবিজমের জন্ম। সেজানের চরিত্র ও কর্মে ক্ষয়িষ্ণু কিছু নেই, বিমূর্ত কিছু নেই, শিল্পের জন্য শিল্প বলে কিছু নেই, শিল্প সৃষ্টি করার একটা অন্তর্নিহিত ও অদম্য আকাক্সক্ষা ছাড়া আর কিছুই নেই।
×