ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফিরে এসো নিরঞ্জন

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২৪ মার্চ ২০১৭

ফিরে এসো নিরঞ্জন

শীত। বড় তীব্র শীত। চাখানার মাটির বারান্দায় খড়ের উপর চট বিছানো শয্যায় কাঁথামুড়ি দিয়ে বিলু পাগলা। পা ঘেঁষে নেড়িকুকুর, পেটের কাছে বিড়াল তাকে আপনজনের উত্তাপ দিচ্ছে। মাধবপুর উপজেলা ছুঁয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে এই চাখানা। এখন বিলুর আশ্রয় এই বারান্দা। আজ পথঘাট প্রান্তরে জোছনার প্লাবন। কুয়াশার সাথে চাঁদের আলোও ঝরছে হয়তোবা। কাঁথা সামান্য সরালো বিলু পাগলা। রাস্তার উল্টা দিকে ঢুকে যাওয়া মেঠো পথটার বাঁদিকে গাছপালায় ছাওয়া বাড়িটার দিকে তাকালো। এই সেই বাড়ি যাকে প্রশান্ত করতো তিতাসের শাখা কাশপী গাঙ্গের বাতাস। এই বাড়ি ছিল সম্পত্তিবঞ্চিত, স^জনতাড়িত বিলালের আশ্রয়। প্রয়োজনের অন্নবস্র শুধু নয়, বাড়িটির মমতায় বাঁধা পড়েছিল। নিদারাবাদের এই নিটোল সুন্দর বাড়ির লক্ষ্মী ছিল বাসবী। নিরঞ্জন গাঁয়ের ছেলে, অন্য জেলার মেয়ে বাসবীকে বউ করে এনেছিল। নিরঞ্জনের বাপই আশ্রয় দিয়েছিল বিলালকে। নিরঞ্জনকে ও ডাকতো নিরনপুত আর বিলুকে নিরঞ্জন ডাকতো বিলুপুতি। বাসবী পুতি ডাকতো না। সে ডাকতো বিলুকা মানে বিলুকাকা। বাসবীর অঞ্চলে পুত্রকে পুতও বলে না আর পুত থেকে পুতিও বানায় না ওরা। বিলুপাগলা ঐ কাকা ডাকে অনেক মায়া খুঁজে পেয়েছিল। নিরঞ্জনের বাপ মারা গেল। বাপের সামান্য ছোট বিলুকে আরও আকড়ে রাখলো ওরা। তখনই শুনেছিল নিরঞ্জন ও বাসবীর আপনজন বলতে তাদের সন্তান চারটি ছাড়া আর কেউই নাই। নিরঞ্জনের নাকি বহুদূরের এক দিদিমা না পিসিমা আছে আগরতলায়। বিলুপাগলা ঐ বাড়ির আঙ্গিনায়, পৈঠায় জবা, গাঁদা অনেক গাছ লাগিয়েছিল। প্রচুর ফুল ফুটলো। বাসবী মানত করলো বৃহস্পতিবারে মন্দিরে ফুল-বাতাসা-দুধ পাঠাবে। শৈশবে মাতৃহীন নিরঞ্জন বারোয়াড়ি পূজা ছাড়া ঘরোয়া এইসব ধর্মাচার দেখেনি। ঝামেলা মনে হয়েছিল। বিলুপাগলাই বাসবীর মান্তির উপাচার মন্দিরে পৌঁছে দিতো। শীতের শেষে গ্রামের খালেক চিঠি এনে দিলো নিরঞ্জনকে। আগরতলা থেকে কেউ পাঠিয়েছে। তার কিছুদিন পর নিরঞ্জন কোথায় যে গেল আর ফিরলো না। দুঃখিত, ব্যথিত, শংকিত বাসবী। বর্ষার এক অন্ধকার রাতে চার সন্তানসহ বাসবীও নিখোঁজ হল। বর্ষার শেষে বিল, হাওর, বাওরের পানি টানলে বড় বড় ড্রাম ভেসে উঠলো। ড্রামে মা ও চার সন্তানের দেহগুলো চুনে চুবানো ছিল। বাদলায়-জোছনায় গভীর রাতে বিলুপাগলা চারপাশে শুনে হাহাকার ‘ফিরে এসো নিরঞ্জন’! (নিদারাবাদ হত্যাকা-ের নায়ক খালেক তাবলীগে লুকিয়েও বাঁচতে পারেনি। সে রামপুরাতে ধরা পড়ে। শাস্তি ছিল মৃত্যুদ-। ) আন্টি লিন্ডা বাচ্চাটিকে চাইল্ড কেয়ারে দিতে গিয়ে মায়ের মনটা বিষণœ ছিল। প্রথম দিন যে মেয়েটির কোলে উঠেছিল বাচ্চাটি সেই হাসিখুশি দীর্ঘাঙ্গী সাদা মেয়েটিকে দেখিয়ে মা বলেছিল -লুক্ ইট্স আন্টিলিন্ডা! লিন্ডা উচ্ছল হাসি ছড়িয়ে বাচ্চাটিকে নিয়ে এক পাক ঘুরে নিল। লিন্ডার সাদর অভ্যর্থনায় মা ও শিশু দু’জনই খুশি। বাচ্চার মা ভেবে রেখেছে সে তার বাচ্চাকে আদব-কায়দা শেখাবে। বড়দের নাম ধরে ডাকতে দেবে না। সেইজন্যে লিন্ডাকে আন্টিলিন্ডা বলে পরিচয় করালো। প্রথম দিকে বাচ্চাটি একটু একটু মন খারাপ করলেও ধীরে ধীরে চাইল্ডকেয়ার সেন্টারের খেলাধুলা ও আনন্দে মেতে থাকা ও নিয়মশৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হচ্ছিল। খেলার ছলে নানা কর্মকা-ে ছোট্ট বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখার কত যে কৌশল। অন্য বা””াদের সাথে মিলেমিশে খেলার, খেলনা ভাগাভাগির সুন্দর আচরণগুলোও শিখছিলো। বাচ্চার মুখে কথা ফুটছে। প্রতিদিনই সে নতুন কিছু শব্দ আধো আধো উচ্চারণে বলছে। মা-বাবা আনন্দে হেসে কুটিকুটি। ঐ চাইল্ডকেয়ার সেন্টারে লিন্ডা ও অন্যরা সবাই বাচ্চাদের প্রতি যথেষ্ট যতœবান। মা ভাবে ভারতীয় সারিকা, প্রীত্তি, মনপ্রীত, মাধুরী, চাইনীজ এনি, নিউজিল্যান্ডের কিরা Ñ এরা সবাই যদি বাচ্চা রাখার মতো কঠিন হিমশিম খাওয়া কাজটি আন্তরিকভাবে না করতো তবে পেশাজীবী মায়েদের কি গতি হত? অনেক মা পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় বাচ্চা রাখার ভাল বন্দোবস্ত করতে না পেরে। বেশ কিছুদিন যেতে মা লক্ষ্য করলো বাচ্চার কথাবার্তা ভালই আগাচ্ছে। “থ্যাংক ইউ”, “মে আই...”, “সরি” জায়গামত ঠিকই ব্যবহার করছে তবে একটা বিষয় মা বার বার বলেও অভ্যাস করাতে পারছে না। তা হল শুরু থেকে লিন্ডা ছাড়া অন্য কাউকেই সে আন্টি ডাকে না। যখন সে নিজের মায়ের চেয়েও বয়সে বড়দের প্রীত্তি, সারিকা, মনপ্রীত বলে ডাকে মায়ের খারাপ লাগে। লিন্ডা, এনি, কিরাদের নাম ধরে ডাকলেও ওরা কিছুই ভাবতো না। আন্টি ডাকলেও ওরা আহ্লাদে আটখানা হয় না। ওদের কাছে আত্মীয়তার চেয়েও সখ্যতা বেশি কাছের। সারিকাদের আন্টি ডাকলে ওরা বেশি খুশি হতো। বাচ্চার এই আচরণের কোন কারণ মা ধরতে পারলো না। কেন যে বাচ্চাটা এই ভব্যতাটুকু শিখছে না কে জানে? একদিন সেন্টারে কি এক অনুষ্ঠানে অনেক অভিভাবক জড়ো হয়েছে। অন্য এক বাচ্চার মা বললো -তোমার বাচ্চাতো বেশ কথা শিখেছে, কেয়ারারদের নাম জানে ও? -জিজ্ঞেস কর ওকে। ঐ মা তখন এক একজনকে দেখিয়ে তার নাম কি বাচ্চাটির কাছে জানতে চাইলো। চটপট করে সে নাম বলে যাচ্ছিল। লিন্ডাকে দেখিয়ে যখন সে প্রশ্ন করলো - হোয়াট ইজ হার নেইম? সে সানন্দে বলে উঠলো -আন্টি লিন্ডা! ওকে যতোই বলা হল যে ওর নাম লিন্ডা। বাচ্চাটি মাথা দু’পাশে দুলিয়ে বারবার বলে গেল - নো ইট্স আন্টি লিন্ডা। ফালতু জ্ঞান ছেলেটি র্ঝঝর করে একটির পর একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। দেখতে সে চমকে দেওয়ার মত বুদ্ধিমান চেহারার অধিকারী নয়। কিছুটা সাদামাটা ধরনেরই বলা যায়। তবে মিলিয়ন ডলার জিততে এসে উত্তর যখন দিচ্ছিল তখন বোঝা যাচ্ছিল ওই ছোকরা জেনেশুনেই উত্তর দিচ্ছে। আন্দাজ করে বাজিমাৎ করা তার উদ্দেশ্য নয়। উপস্থাপকও অবাক ওর তথ্য ভা-ারের উপ্চে পড়া বৈভব দেখে। হয় শেষ প্রশ্ন বা তার আগের প্রশ্নটা দেখেই ছেলেটির মুখে বিদ্রƒপের হাসি ফুটে উঠলো। সে বললো -এই তথ্য আমি জানি না, আর জানতেও চাই না -আরে আন্দাজতো কর, এতোগুলো প্রশ্নের ঝট্পট্ উত্তর দিলে এখন এটা পারবে না এ কেমন কথা? মিলিয়ন ডলার পেয়ে যেতে পার! -এই ফালতু জ্ঞান মাথায় ঠাঁই দিতে চাই না । প্রশ্ন ছিল বাকিংহাম প্যালেসে মোট কয়টা রুম বা কামরা রয়েছে? আইনের ছাত্র প্রতিযোগী ছেলেটি মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ফস্কে যাওয়াতেও ব্যাজার হল না। উপরন্তু এটিকে ফালতু জ্ঞান (যাকে সে ঁংবষবংং শহড়ষিবফমব) বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল। শেষে উপস্থাপকই জানালো ৭৭৫টি কামরা রয়েছে ওই রাজপ্রাসাদে। তখন মনে পড়লো আমাদের দেশে, হয়তো বা উপমহাদেশেও স্কুলে ইতিহাস পরীক্ষায় এককথায় উত্তর দিতে বা শূন্যস্থান করার জন্য এমনি এক ফালতু তথ্য বা ওই ছেলের বয়ান অনুযায়ী ‘ইউজলেস নলেজ’ মাথায় রাখতে হত। তা ছিল ‘বুসিফেলাস’ এর নাম। সে কোন বীর বা নৃপতি বা ইতিহাস খ্যাত প-িত নয়। সে ছিল গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ঘোড়া!
×