জুবাইদা গুলশান আরা হেনার উপন্যাস সমগ্র (প্রথম খ-) এবং সায়েন্স ফিকশন সমগ্র (প্রথম খ-) বই দুটো প্রকাশ পায় ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে। গুলশান জুবায়েদ প্রিন্সের প্রচ্ছদে সমগ্র দুটো প্রকাশ করেছে পিপিএমসি প্রকাশন। উপন্যাস সমগ্রে স্থান পেয়েছে লেখকের সাতটি গ্রন্থ। নিঁদ নাহি আঁখি পাতে’ গল্প সংগ্রহ ছাড়া অন্য ছয়টি বই উপন্যাস। উপন্যাস এবং ছোটগল্পের বিষয়বস্তুতে সমকালীন সমাজ, সংস্কার-অপসংস্কার, নারীর অবস্থানসহ পুরুষশাসিত বলয়ে সামগ্রিক ব্যবস্থার একটি জীবন্ত ছবি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন গ্রন্থের রূপকার। একজন সচেতন এবং অধিকার বোধসম্পন্ন নারী হিসেবে নারী সমাজের প্রতিপক্ষ এবং প্রতিবন্ধকতাকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। একজন সুশিক্ষিতা এবং বিজ্ঞানমনস্ক লেখক হিসেবে তিনি তার সৃজনসম্ভারকে সমৃদ্ধও করেছেন। তার ‘সুখের লাগিয়া’ উপন্যাসটি নারীর প্রতি তার দায়বদ্ধতাকে পাঠকের সামনে হাজির করে। তিন প্রজন্মের নারীদের নিয়ে লেখা এই উপন্যাসটিতে ধরা পড়ে নারীদের অসহায়ত্ব এবং দৌর্বল্য। প্রথমত নির্যাতিত নারীরা নিজেরাই উপলব্ধি করে না যে তারা কোন এক ধরনের অমানবিকতার শিকার। অনেকেই বুঝতে পারলেও একে ভাগ্য বা বিধিলিপি হিসেবে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। আবার এমনও কেউ আছেন যারা ঠা-া লড়াইয়ে কিছুটা প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আর এভাবে উপন্যাস গতি নির্ণয় হয়, সাবলীলভাবে এগিয়ে যায় এবং পরিণতি লাভ করে। গ্রন্থকারের ছোট গল্প সংগ্রহ ‘নিঁদ নাহি আঁখি পাতে’ সাতটি গল্পের সমন্বয়ে সাজানো হয়। সমাজের স্বচ্ছ প্রতিবেদন হিসেবে গল্পগুলোকে তৈরি করা হয়। ছোটগল্পের আঙ্গিক ও বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কবিতাকে ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা’ সবার ওপরে স্থান দেন লেখক। ‘অদৃশ্য কারাগার’ উপন্যাসটিতে আবারও নারী নিগ্রহের সকরুণ অনুভব। আবদ্ধ আর শৃঙ্খলিত নারীদের সমাজ সংসারে টিকে থাকার দায়বদ্ধতা লেখককে অনুক্ষণ তাড়িত করে। ‘নীল ডায়েরি’ উপন্যাসটি ভিন্ন মাত্রার আবেদন নিয়ে কিশোর-কিশোরীদের প্রাণিত করার চেষ্টা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিমগ্ন লেখক ও স্বাধীনতা সংগ্রামে আহুতি দেয়া ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতার যে আলেখ্য পাঠকের কাছে নিয়ে আসেন তা সম্পূর্ণ আপামর বাঙালী জাতির অহঙ্কার এবং অর্জন। ‘বনলতা’ উপন্যাসটি বাল্যবিবাহ আর যৌতুকের নির্মম পেষণে নিপীড়িত এক কিশোরীর রক্তক্ষয়ী জীবনকে করুণ অবয়বে উপস্থাপন করা হয়। লেখক সমাজ এবং সমাজবদ্ধ নারী-পুরুষের বিচিত্র কর্মপ্রবাহে অত্যাচারের মাত্রায় নারীরা কতখানি এগিয়ে তা স্পষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছেন। লেখকের অপর গ্রন্থ ‘সায়েন্স ফিকশন সমগ্র’ বিজ্ঞানের প্রতি তার সীমাহীন একনিষ্ঠতার চিত্র তুলে ধরেন পাঠকের কাছে। গ্রন্থকার নিজেও একটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। বিজ্ঞান আজ আধুনিক মানুষের একেবারে নাগালে। প্রতিনিয়তই তথ্যপ্রযুক্তির অব্যাহত অগ্রযাত্রা আজ সারা পৃথিবীকে এক সুতায় বেঁধে রেখেছে। মুহূর্তেই যে কোন খবর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বিজ্ঞানের এই সীমাহীন কর্তৃত্বের কারণে। এখন শুধু কল্পনা নয় সূর্য, গ্রহ, চাঁদ তারা মানুষের বোধের একেবারে নিকটে। আবার সেই বাস্তবসম্মত বিজ্ঞানের জয়যাত্রা কল্পনার জগতকে কিভাবে সমৃদ্ধ করতে পারে তাও ভাবার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সন্ত্রাস নির্মূল কিংবা অপরাধ জগতের আলোর স্ফুরণ ঘটানো যায় কিনা সেটাও গ্রন্থকারের কাল্পনিক বিবেচনায় স্থান পেয়েছে। সায়েন্স ফিকশনের ‘বায়োনিক চোখে’ বাঙালী সংস্কৃতির প্রবাদ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, কাজী নজরুল, সত্যজিৎ রায় এবং ফিরোজা বেগমের মতো ব্যক্তিত্বদের কথোপকথন হাজির করা হয় বিভিন্ন কাল্পনিক প্রক্রিয়ায়। যা পাঠককে নতুন করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা সত্যজিৎ রায়কে মনে করিয়ে দেয়। যদিও তারা চিরস্মরণীয়, অমর। সমগ্রদ্বয়ের শব্দচয়ন, কাহিনীর গতি নির্ণয় শেষ অবধি পরিণামের যথার্থতা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। যা পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য এবং সহজবোধ্য হবে বললে বেশি বলা হয় না।
সমকালীন বিষয়, নারী, সমাজ সংস্কারের অপ্রতিরোধ্যতা, ঐতিহ্যিক ব্যক্তিত্বদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তুলে ধরা সর্বোপরি বিজ্ঞানের অব্যাহত অগ্রযাত্রাকে বৈশ্বিক পরিম-লে আরও তথ্য নির্ভর করার ওপর গুরুত্বারোপ করে গ্রন্থের রূপকার সময়ের দাবি মিটিয়েছেন। এ জন্য তাকে সশ্রদ্ধ অভিনন্দন। আশা করি আগ্রহী এবং নতুন প্রজন্মের পাঠকদের কাছে গ্রন্থদ্বয় সমাদৃত হবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।