ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ২৪ মার্চ ২০১৭

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

(পূর্ব প্রকাশের পর) চাঁদটাকে যেখানে রেখে গিয়েছিলাম ফিরে এসে সেখানেই পেলাম। আজ যেন ওর নড়াচড়া করার কোন শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশে তেমনি উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করে রেখেছে এই বসুন্ধরাকে। রাত পোহাতে মনে হয় আর বেশি সময় বাকি নেই। শরীরটা অবসন্ন হয়ে আসাতে তাকে রেখে দিলাম বিছানায় এর পর কি হলো বলতে পারব না। কিন্তু এই বলতে না পারাটা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, ঘুম ভেঙে গেল। সাগরের উচ্চ মাত্রার ঢেউয়ের কারণে রোলিং হচ্ছে। মাঝে মাঝে স্থির থাকাটাও সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের স্যুটে দুটো সিঙ্গেল খাটকে একত্র করে ডবল করা হয়েছে। রোলিংয়ের কারণে তাদের ভাল বাসায় ফাটল ধরেছে সেই সঙ্গে আমাদেরও। উচ্চ মাত্রার ভূমি কম্পে যেমন মেঝেতে স্থির থাকা যায় না, মাঝে মাঝে এমনই কম্পন অনুভূত হচ্ছে। আর মনে পড়ছে ইতিহাস হয়ে থাকা টাইটানিকের কথা। টাইটানিক ডুবেছিল বিশাল আকৃতির আইচ বারের সঙ্গে প্রচ- গতিতে ধাক্কা খেয়ে। আজ না আমাদের সলিল সমাধি হয় ঢেউ এর কারণে। না, সে সম্ভাবনা একবারেই নেই। তবে দোল খাওয়াটা প্রাণে কেন জানি শিহরণ জাগায়। এরই মাঝে ওকে জড়িয়ে ধরে আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম। এবার ঘুম ভাঙল সূর্য্যরে প্রখর কিরণ পর্দা ভেদ করে চোখে পড়াতে। ইচ্ছা ছিল আজ প্রত্যুষে বাল্টিক সাগরের অকূল দরিয়ার সূর্য্য উদয়ের দৃশ্যটা মানস পটে ধরে রাখব, কিন্তু তার উদয়ের মুহূর্তটা কিভাবে ঘটে গেল সেটা অজানাই রয়ে গেল। জীবনে চলার পথে এমনি হাজারও বিরল ঘটনা অজানা থেকে যায় আজ না হয় তার সঙ্গে আরও একটা যোগ হলো। তবে ভোরের আলোয় সিন্ধ শীতল আবহাওয়ায় নীরবে নিভৃতে একবার ডেকের ওপর দিয়ে একটা চক্কর দিয়ে আসলাম। তখনও জাহাজ ভর্তি যাত্রীরা রাত জাগরণের নিদ্রাবিহীন ক্লান্তিতে অঘোরে নিদ্রা দেবীকে আঁকড়ে ধরে আছে। শুধু আমার মতো অতি উৎসাহী দুই একজনের সঙ্গে দেখা হলো, যারা ভোরের তীব্র বাতাসে পরিধেয় বস্ত্রাদি সামলিয়ে কোনক্রমে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে উপভোগ করার চেষ্টা করছে সকালের সাগরকে। ডেকের উপরে তখনও বিকেলের সুবিন্যস্ত চেয়ারগুলো এখানে সেখানে এলোমেলো অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। চলন্ত জাহাজের খোলামেলা ডেকে ঠা-া বাতাসে বেশিক্ষণ অবস্থান স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে বিধায়, বিদায় নেওয়া সমীচীন মনে করলাম। সে রাতে আর অনুপ বাবুদের সাক্ষাত মিলল না। কিন্তু আমাদের মধুচন্দ্রিমায় বিঘœ ঘটানোর যে অস্ত্র তার হাতে সপে দিয়ে এসেছিলাম বিনা দ্বিধায় বিনা সংকোচে, তার অপব্যবহার কেন হল না সে কৈফিয়ৎ তো নিতেই হবে। ইতোমধ্যে সকালের অন্নগ্রহণ করার সময় সমাগত। তাই বেরিয়ে পড়লাম তাদের অন্বেষণে। এইখানে জাহাজের অন্যান্য স্যুট গুলির একটা বিবরণ দেওয়া আবশ্যক, যে স্যুট গুলিতে অল্প ভাড়ায় ভ্রমণ করা সম্ভব। নিঃসন্দেহে এই স্যুটগুলোর অবস্থান একবারে ভিতরের দিকে যেখান থেকে বাইরের কোন দৃশ্য অবলোকন করা একেবারে অসম্ভব। এই ঘর গুলিকে স্যুট না বলে কেবিন বলাই উত্তম। অপ্রশস্ত লম্বা করিডোরের দুই ধারের কেবিনগুলোতে প্রাপ্ত বয়স্ক চারজন অনায়াসে ঘুমিয়ে সময় কাটাতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। দূরপাল্লার ট্রেনের স্লিপারের আদলে উপর নিচ এইভাবে দুই পাশে চারটা স্লিপারের আয়োজন। এরই একটি কেবিনে আশ্রয় নিয়েছেন সস্ত্রীক পাল ভ্রাতৃদ্বয় এবং অন্য আর একটিতে জামাতা পুত্র ও কন্যাদ্বয়। সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারলে নিশ্চয় আমরা অন্য আর একটার ভাগীদার যে হতাম সেটা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। যা হোক নবম তলায় তাদের কেবিনের নাম্বার জানাই ছিল তাই তাদের সুখ নিদ্রায় বিঘœ ঘটাতে কোন ঝামেলাই হলো না। তাদেরকে জাগিয়ে তুলে অনুযোগ অভিযোগের সুরে বললাম আন্যদের সারা নিশি টেনশনে বসিয়ে রেখে নিজেরা নিবিঘেœ আরাম আয়েশে নিদ্রা গিয়ে রীতিমতো অন্যায় করেছেন। এর একটা বিহীত হওয়া দরকার। কিন্তু অপর পক্ষ থেকে তেমন কোন জোরালো প্রতিবাদের লক্ষণ দেখা গেল না। একতরফা ঝগড়াতে কোন মজা নেই তাই রণে ক্ষান্ত দিয়ে আপাতত সকালের অন্ন গ্রহণ করানোর দিকে মনোযোগী হতে হলো অন্যথায় সময় পেরিয়ে গেলে অভুক্ত থাকার অথবা বাড়তি অর্থ দ-ের সমূহ সম্ভাবনা প্রকট হতে পারে। আজ আমাদের সকলের জন্যে নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে সকালের খাবার আয়োজন পূর্ব নির্ধারিত। তাই সময়মতো হাজির হওয়া আবশ্যক অন্যথায় বিড়ম্বনা বেড়ে যাবে। সবাইকে সময়মতো হাজির করাতে তেমন অসুবিধা হলো না। রেস্টুরেন্টে প্রবেশ পথেই আমরা বোনাফাইড কাস্টমার কিনা সে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া পরই আসন গ্রহণ করার বৈধতা পাওয়া গেল। ব্রেক ফাস্টের আয়োজন দেখে চক্ষু চড়ক গাছ হওয়ার উপক্রম। কোন ফাইভ স্টার হোটেলের রেস্টুরেন্ট হলে বেমানান হতো না নিঃসন্দেহে। সকল ধরনের আয়োজনে সমৃদ্ধ প্রস্তুত করা মেনুগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো আছে টেবিলের উপরে যাদের সংখ্যা শতাধিকের উপরে। প্লেটটা হাতে নিয়ে এ মাথা থেকে ও মাথা একটা চক্কর দিয়ে দেখে নিলাম কি ধরনের ব্রেক ফাস্ট চয়েজ করলে স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরিভাবে মেনে চলা যায়। সকলে মিলে চমৎকার দৃশ্যপট উপভোগ করা যায় এমন একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম, যেখান থেকে অপরূপ সুন্দর ভিউ দেখা যায় সকালের সাগরের। তরীখানি তার আপন গতিতে ছুটে চলেছে এ চলার যেন কোন শেষ নেই। সাগরের মেজাজটা কেন জানি খুবই শান্ত। এ দুদিনে অন্তত সেটাই চোখে পড়ল। এই বাল্টিক সাগরের জলের রঙের একটা পার্থক্য নিঃসন্দেহে করা যেতে পারে, যেটা বিশেষভাবে চোখে পড়ে। পর্তুগালে গিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের জলের রঙের মাধুর্য দেখে বিমোহিত হয়েছিলাম। সাগরের জল যে এত সুন্দর নীল হতে পারে এর আগে কোথাও দেখা হয়নি। ইতোমধ্যে প্রায় সব মহাসাগরের জলের দর্শন ও স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়েছে তবে কোথাও রঙের এত মাতামাতি চোখে পড়েনি, যেটা কিনা পড়ল পর্তুগালে গিয়ে। প্রায় তিনশ’ কিলোমিটারের বিস্তৃত উপকূল বরাবর জলাভূমির যেখানেই পদার্পণ করেছি সর্বত্র একই দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে বাল্টিক সাগরের জলের রঙের ভিন্নতা বিমোহিত করে না। এর জলের রং কালো। যদিও আপাতত দৃষ্টিতে জলের কোন রং নেই। যে পাত্রে রাখা হয় সেই পাত্রের রং ধারণ করে এটাই জলের ধর্ম। তবে ইংল্যান্ডের চতুর্দিকের আটলান্টিকের এবং ইংলিশ চ্যানেলের জলের রং কিছুটা সুজাভো দেখায়। এ প্রসঙ্গে ভারতের কন্যা কুমারীর কথা উল্লেখ না করে পারা গেল না, যেখানে তিন সাগরের মিলন ঘটেছে। ভারত মহাসাগর, আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগর। এই তিন সাগরের জলের রঙের পার্থক্য আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, সহজেই সেটা চোখে পড়ে। প্রসঙ্গক্রমে ভিন্ন প্রসঙ্গ এসে গেল। ফিরে যাই খাবারের টেবিলে। টেবিলের অবস্থানটা সত্যি অপূর্ব। একবারে জলের কিনার ঘেঁষে। কাঁচের জানলাটা না থাকলে একবারে জলে হাত ডুবিয়ে খেলা করা যেত। পছন্দমতো খাবার প্লেট ভর্তি করে টেবিলে বসতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল তাতে করে খাবার থেকে বেশি উপভোগ্য মনে হলো বাইরের দৃশ্য। ভোরের আঁধারকে পরাভূত করে সূর্য তার আপন মহিমায় আলোক রশ্মিতে দিগন্ত বিস্তৃত জল রাশিকে আলোকিত করে ফেলেছে। তারই আলোয় সকলেই আমরা উদ্ভাসিত দীপ্ত। রসনা তৃপ্তির বাসনা লাভের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির অকৃপণ দানে মনোজগতের যে রসনা লাভ হলো তাকে কি কোন দামে কেনা যায়? তখনও সূর্যের কিরণ প্রখর হতে কিছুটা সময় বাকি। তারই হলকা আভা মৃদু মন্দ হাওয়াকে ফাঁকি দিয়ে শান্ত সাগরের ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর আছড়ে পড়ে চিকিমিকি করছে আর ঢেউগুলো তারই বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ে তাতেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে খাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। প্রকৃতির অকৃপণ দানে ভরে ওঠা প্রাকৃতিক পরিবেশ মন প্রাণ উজাড় করে দেখতে কার না ভাল লাগে? খুব বেশিক্ষণ ভাল লাগানো গেল না। খাওয়ার পর্ব শেষ করতে হবে, অন্যথায় অনেক কিছু দেখা ও জানার বাকি থেকে যেতে পারে। ব্রেক ফাস্ট মেনুর কথা আর কিই বা বলব, নিঃসন্দেহে এটা কোন সাধারণ মানের রেস্টুরেন্ট নয় এবং খাবারের তালিকাটা যেমন দীর্ঘ তেমনি মানটাও অনেক উন্নত। চলবে...
×