স্টাফ রিপোর্টার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তের সর্বত্রই অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক চোরাকারবারিরা খুবই বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। জেলার ১৭৪ কিলোমিটার সীমান্তের ৪১ পয়েন্ট দিয়ে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা নানা কৌশলে এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক আসছে। এর মধ্যে স্পর্শকাতর ও সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত শিবগঞ্জ সীমান্তে রয়েছে ২৭ পয়েন্টের মধ্যে সোনামসজিদ সীমান্তের সাতটি পয়েন্টে চোরাকারবারি এখন খুবই বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। সোনামসজিদ বন্দরের কাছাকাছি দারসবাড়ি এলাকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ কয়েকটি হাঁটা পথ গিয়ে ওঠেছে ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। এসব পথ ধরে আসছে বিস্ফোরক ও ছোট ছোট সেফ অস্ত্রের চালান। একাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও পাঁচটির অধিক গোয়েন্দা সংস্থার নজর এড়িয়ে স্থলপথে আসা অস্ত্র ও বিস্ফোরক চালান ওঠে যাচ্ছে সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে ছেড়ে আসা পণ্য ভর্তি ট্রাকে। এই অঞ্চলের রফতানি ও আমদানিকারকদের নিয়ন্ত্রণাধীন অফিস ও গুদামে মজুদ করে রাখা এসব বেআইনী পণ্য প্রতিদিন ট্রাকে চলে যাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে। এরই পাশাপাশি দুর্লোভপুর, মনাকষা, শাহবাজপুর ইউপিসহ কামালপুর ও পুরো ভোলাহাট সীমান্ত পথের পদ্মা ও মহানন্দা পেরিয়ে আসছে অস্ত্রের চালান। বিশেষ করে মার্চ শুরুর প্রথম দিন থেকেই এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক দেদার আসছে। সর্বশেষ শিবগঞ্জ সীমান্ত পথে আসা দেড় কেজি গান পাউডার, দুটি পিস্তল, ছয় রাউন্ড গুলি, দুটি ম্যাগজিন উদ্ধার করে পুলিশ। কানসাট এলাকার একটি বাড়িতে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ২৮ চালান মজুদ করা হয়েছিল। এর মধ্যে সর্বশেষ চালানের অংশবিশেষ মাত্র দেড় কেজি গান পাউডার, দুটি বিদেশী পিস্তল, দুটি ম্যাগজিন ও ছয় রাউন্ড গুলি উদ্ধারে সক্ষম হয় পুলিশ। এর আগেই মজুদ চালানগুলো নির্বিঘেœ চলে যায় গন্তব্যে। অস্ত্র চোরাকারবারিদের সঙ্গে রয়েছে জঙ্গী সম্পৃক্ততা। কানসাটের যে বাড়ি থেকে এসব অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে পাওয়া গেছে বিপুল সংখ্যক জিহাদী বই। কানসাট বালুচরের এই বাসা থেকে অস্ত্র ও জিহাদী বই উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে তিনজন বড় মাপের জামায়াত নেতা আটক হয়েছে। এরা সাতক্ষীরা জেলার রায়পাড়া গ্রামের আরশাদ আলীর ছেলে মাওলানা তৈয়বুর রহমান (৫১), স্থানীয় সিরাজ বিশ্বাসের ছেলে শরিফুল ইসলাম (৫২) ও শেরতাজ আলীর ছেলে আশরাফুল আলম (৫০)। সন্ত্রাসের জনপদ সাতক্ষীরা জেলার অধিকাংশ সন্ত্রাসী গ্রুপ স্থান পরিবর্তন করে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এদের সংখ্যা কয়েক সহস্র বলে জানা গেছে। এরা ইতোমধ্যেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় চোরাকারবারি মালামালের ব্যবসা করছে। ইচ্ছেমতো পারাপার হচ্ছে সীমান্ত। ’১৩ সালের পর কানসাটসহ শিবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া সন্ত্রাসের বহু নায়ক ভারতে পালিয়ে রয়েছে। এদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে সাতক্ষীরার সন্ত্রাসীরা। এদের অধিকাংশের সঙ্গে কানেকশন রয়েছে দুই পারের জঙ্গী সংগঠনের। এরাই এখন অস্ত্র ও বিস্ফোরকের প্রধান চোরাকারবারি। একইভাবে স্থানীয় জঙ্গীরা চলে যাচ্ছে সাতক্ষীরা বা চট্টলাতে।
এরা সারাবছরই কমবেশি সক্রিয় থাকলেও বিশেষ বিশেষ সময়ে অধিক পরিমাণে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পুরো দেশের সন্ত্রাসী ও জঙ্গীদের অর্ডার মোতাবেক বিস্ফোরক ও অস্ত্র সরবরাহ করে থাকে। একই সঙ্গে করে প্রচারনার কাজ। ইদানীং জিহাদী বই পুস্তক ও বোমা তৈরির ফর্মুলা ছাপানো বই পুস্তক ও উভয় দেশের জালনোট এদের মাধ্যমেই এখানে আনা এবং বিতরণ করা হয়। শিবগঞ্জের একাধিক রুটে এসব এনে মজুদ, পরবর্তীতে বিতরণ ও গন্তব্যে পাঠানো হয়। একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে শিবগঞ্জ থেকে নয়টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। একই সময়ে গুলি উদ্ধার হয়েছে ৫০ রাউন্ড, ম্যাগজিন ১৬টি ও ওয়ান শূটার গান ৩টি। আটক করা হয়েছে একাধিক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে। অপর এক তথ্যে জানা গেছে, ১৪ মার্চ মঙ্গলবার সকালের দিকে বিজিবি শ্যামপুর সাহাপাড়ার একটি ভুট্টা ক্ষেতে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি ব্যাগ উদ্ধার করে। এই ব্যাগ থেকে একটি পিস্তল, তিনটি শূটার গান, দুটি ম্যাগজিন ও ১০ রাউন্ড গুলি পাওয়া যায়। একই দিন র্যাব উদ্ধার করে দুটি পিস্তল, তিনটি ম্যাগজিন ও ১২ রাউন্ড গুলি। একজন অস্ত্র ব্যবসায়ী ধরা পড়ে এসব মালামালের সঙ্গে। আটক অস্ত্র ব্যবসায়ী বিনোদপুর ইউপির কিরণগঞ্জের আতাউরের ছেলে শামিম রেজা। দীর্ঘদিন ধরে সে অস্ত্র ব্যবসা করছে। পরের দিন কিরণগঞ্জ বিওপির এক নায়েক সুবেদার কালীগঞ্জ মাঠ এলাকায় তিনটি বিদেশী পিস্তল, পাঁচ ম্যাগজিন ও ১৩ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে। পাশাপাশি বিজিবি অপর এক অভিযানে একটি পিস্তল, তিন শূটার গান, দুটি ম্যাগজিন ও ১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে। এভাবে প্রতিদিন বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধার হচ্ছে অস্ত্র ও অস্ত্রসহ ধরা পড়ছে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী।
পাকা ইউপির বোগলাউড়ি এলাকায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে তিন পিস্তল, ছয় ম্যাগজিন পনেরো রাউন্ড গুলিসহ ইউসুফ আলী নামের এক অস্ত্রব্যবসায়ীকে আটক করে। উদ্ধারকৃত এসব অস্ত্র সন্ত্রাসীদের চাহিদামতো দাম চূড়ান্ত করে ও নগদ আগাম নিয়ে তুলে দেয় তাদের হাতে। বেশ কটি অভিযানের উল্লেখ করা হলেও একই সঙ্গে আনা হয়েছে শতাধিক অস্ত্রের চালান। সেগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে গন্তব্যে পাঠানো হয়েছে। সামনে অর্ডার পাওয়া সহস্রাধিক চালান আসছে। একাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনকণ্ঠকে জানান, তারা জেলায় সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু এসব বিস্ফোরক ও অস্ত্র চলে যাচ্ছে অন্য গন্তব্যে। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে সামনে নির্বাচন ও বিরোধীদের একাধিক কর্মসূচী আসছে। এসব বিস্ফোরক ও অস্ত্রের আগাম অর্ডার হঠাৎ করে সীমান্ত দিয়ে আসা শুরু হয়েছে। সীমান্ত জুড়ে গড়ে ওঠছে অস্ত্রের মজুদ। এসব অস্ত্রের অধিকাংশ আমেরিকার তৈরি। সমানে আসছে জাপান ও চীনের অস্ত্রও। পাশাপাশি ভারতে তৈরি অস্ত্রও আসছে। তবে গ্রহীতাদের চাহিদা বিদেশী অস্ত্রের প্রতি ।
এদিকে সীমান্ত এলাকায় কর্মরত একাধিক গোয়েন্দা সদস্যদের সঙ্গে নাকি গভীর যোগাযোগ রয়েছে অস্ত্র চোরাকারবারিদের। বিশেষ করে একাধিক গরু করিডর বর্তমানে অস্ত্র চোরাকারবারিদের প্রধান রুটে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার বাখের আলীতে নতুন করে একটি শুল্ক করিডর স্থাপন করা হয়েছে। নতুন এই করিডর দিয়ে গরুর আড়ালে আসছে বিস্ফোরক ও অস্ত্র। কারণ এই এলাকার চিহ্নিত চোরাকারবারি যাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী শহরে একাধিক বড় বড় বিশাল রিসোর্ট টাইপের পাকা ভবন রয়েছে, তাদের কানেকশন রয়েছে এই করিডরের সঙ্গে। তারা অবৈধ পথে চোরাই মালামাল এনে শহরের বাড়িতে মজুদ করে রাখে। সময় সুযোগ মতো গন্তব্যে পাঠিয়ে থাকে। এসব মহলের সঙ্গে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সদস্যের দহরম মহরম সম্পর্ক থাকায় বড় বড় অস্ত্রের চালান কোন সময়েই ধরা পড়েনা।
তবে হঠাৎ করে অস্ত্রের চোরাচালান ও বিপুল বিস্ফোরক মজুদের খবরে খুবই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা। কারণ তাদের ধারণা অধিক অস্ত্রের চোরাচালান বেড়ে যাবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে দেশজুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা।