ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইতিহাস বিকৃতির বিপরীতে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৩ মার্চ ২০১৭

ইতিহাস বিকৃতির বিপরীতে

বঙ্কিম চন্দ্র বলেছিলেন ‘বাঙালীর কোন লিখিত ইতিহাস নেই।’ তাই বলে কি বাঙালী ইতিহাসবিহীন জাতি। ইতিহাসবিহীন জাতির তো কোন শিকড় থাকে না। এ কথা মোটেই সঠিক নয়। বাঙালীর আছে এক সমৃদ্ধ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও সুমহান ঐতিহ্য। সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মাধ্যমে সেই ইতিহাস রচিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ততোধিক গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক ও বাতিঘর। পৃথিবীতে খুব কম জাতিরই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের সৌভাগ্য হয়েছে। আমার মতে মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক প্রজন্ম তিনটি- মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব প্রজন্ম, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম এবং মুক্তিযুদ্ধ উত্তর প্রজন্ম। পূর্ব প্রজন্ম আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এই পর্বে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম, পাকিস্তান আমলে ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী ও ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্ত শাসনের আন্দোলন এবং সর্বশেষে চূড়ান্ত পর্যায় মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তর সালের ৭ মার্চ বংগবন্ধু লিখলেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চের দিকনির্দেশনায় একটি শান্তিপ্রিয় নিরস্ত্র জাতির সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরের এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের এই হলো নাতিদীর্ঘ ইতিহাস। এই ইতিহাসের মহানায়কের উত্তরণ ঘটল মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতায়। বাঙালী পেল স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় সংবিধান। দুঃখের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর কয়েকটি প্রজন্ম গড়ে উঠেছে ইতিহাস বিকৃতি চর্চার মাধ্যমে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এটি একজন ব্যক্তি শেখ মুজিবকে হত্যা নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যার শামিল। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের মদদপুষ্ট একটি মহল (পরবর্তীকালে বিএনপি নামে পরিচিত) ক্ষমতা দখল করেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস বিকৃতির চর্চা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান ‘জয় বাংলা’ তুলে দেয়। বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা শব্দগুচ্ছসহ শেখ মুজিবুর রহমানের নাম পর্যন্ত টিভি ও পত্র-পত্রিকায় উল্লেখ, প্রচার ও প্রকাশের ওপর কাপুরুষোচিত অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে। স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া শুরু করে। ক্ষমতা দখলকারী মিলিটারি জিয়া কলমের এক খোঁচায় সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা উচ্ছেদ করে এবং মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ সুগম করে তোলে। দেশটিকে আবার পাকিস্তানের আদর্শের দিকে ঘুরিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়। পঁচাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত টানা একুশ বছর ধরে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের বাড়বাড়ন্ত এমন পর্যায় পৌঁছে যায় যে অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের পরিচয় পর্যন্ত প্রকাশ করতে ভীতসন্ত্রস্ত্র ও দ্বিধাগ্রস্ত থাকত। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে এই সময়ের প্রজন্ম এক রকম অন্ধকারেই ছিল। আর পূর্ব প্রজন্মের বিকৃতির ডামাডোলে সঠিক ইতিহাস ভুলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ছিয়ানব্বই সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এ অবস্থার ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে থাকে। বিএনপি-জামায়াত আমলের পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতির ভয়াবহ আবর্জনা এতদিনে পরিষ্কার করা হয়েছে। যে জাতি তাঁর ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে যায়, বিকৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে সে জাতি কোন দিন বড় হতে পারে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের দায়িত্ব আজকের প্রজন্মের। উত্তরণের পথ হতে পারে অনুসন্ধান, গবেষণা ও ব্যাপক পড়াশোনা। আজকের দিনেও স্বাধীনতার ঘোষণা, জাতির পিতা, গণহত্যায় শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তোলার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। একমাত্র আজকের প্রজন্ম গণজাগরণ সৃষ্টির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টিকারীদের এ অপচেষ্টা প্রতিরোধ করতে পারে। শান্তিবাগ, পটুয়াখালী থেকে
×