ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীদের আগামী দিনগুলো... -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৩ মার্চ ২০১৭

জঙ্গীদের আগামী দিনগুলো...  -স্বদেশ রায়

প্রধানমন্ত্রী গত মাসে তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেন, আবার জঙ্গী হামলা হতে পারে। তখনই একটা ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল দেশে জঙ্গীর পৃষ্ঠপোষকরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ মাসেই আমেরিকা এক নির্দেশে পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ চারটি দেশে তাদের নাগরিকদের চলাচলের ক্ষেত্রে সাবধানতার কথা বলে। এই নির্দেশনার পরেই যারা সংবাদ মাধ্যম বা অন্যান্য সেনসেটিভ পেশায় আছেন, সকলে ধরে নেন খুব শীঘ্রই আবার দেশে জঙ্গী তৎপরতা দেখা যাবে। তার পরে এই লেখা যখন লিখছি তখন গত ছয় দিনের পাঁচ দিনই দেশে জঙ্গী সংক্রান্ত ঘটনা আছে। এর ভেতর তিন দিনের ঘটনা চট্টগ্রামে, দুই দিনের ঘটনা ঢাকায়। ঢাকার দুটি ঘটনায় জঙ্গীদের লক্ষ্যবস্তু র‌্যাব। চট্টগ্রামের লক্ষ্যবস্তু পরিষ্কার হওয়ার আগেই তাদের প্রতিহত করা হয়েছে। তবে চট্টগ্রামে এখনও পুলিশ ও র‌্যাবের টানা অভিযান চলছে। আরও অভিযান প্রয়োজন বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা মনে করছেন। চট্টগ্রামের জঙ্গীদের লক্ষ্যবস্তু কী এ নিয়ে আমি আমাদের ডেপুটি এডিটর চট্টগ্রাম বুরে‌্যা প্রধানের সঙ্গে বিভিন্ন সময় কথা বলেছি, কথা বলেছি চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাজনীতিক ও অন্যান্য পেশার মানুষের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, চট্টগ্রামে জঙ্গীদের লক্ষ্যবস্তু প্রথমত দুটিÑ এক. বিদেশী নাগরিক; দুই. জ্বালানি তেলের ডিপো। এই ধরনের বড় হামলা করার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জঙ্গীরা গিয়ে চট্টগ্রামে নানাভাবে অবস্থান নিয়েছে। হলি আর্টিজান ঘটনার পরে একাধিক জঙ্গী অভিযান হয়েছে এবং সব ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সফল হয়েছে। জঙ্গীরা আর কোন সফলতা দেখাতে পারেনি। এর অর্থ এ নয় যে জঙ্গীরা আর কখনও সফল হতে পারবে না। জঙ্গী নিয়ে বিভিন্ন বাহিনীর যারা কাজ করছেন, তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন দেশের জঙ্গীদের সম্পর্কে স্বল্প পড়াশোনার ভেতর দিয়ে কয়েকটি ধারণা জঙ্গীদের সম্পর্কে পেয়েছি। যেমন, এক শ্রেণীর জঙ্গীদের কাছ থেকে তথ্য বের করা বেশ কষ্টের। এছাড়া বেশ কিছু ক্ষেত্রে এদের ট্রেনিংয়ের একটা আন্তর্জাতিক মান আছে। অধিকাংশ দেশে দেখা যাচ্ছে, আত্মঘাতীদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ কলামে আগেও লিখেছি, পৃথিবীর অনেক জঙ্গী হামলার কেস স্টাডি পড়ে দেখেছি, প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে মূল জঙ্গী ট্রেনিং পাচ্ছে পাকিস্তানী মিলিটারি ট্রেনারের কাছ থেকে। অন্যদিকে পাকিস্তানী মিলিটারি ট্রেনারদের একটি বড় অংশ আমেরিকান ট্রেনিং পাওয়া। এর থেকে বোঝা যায় কিছু কিছু জঙ্গীর ট্রেনিং কেন আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে। জঙ্গীদের এই ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি তাদের আর যে সুবিধা, তা হলো অঢেল অর্থ। বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে এই অর্থ বন্ধ করার। সত্যি অর্থে সরকার এখনও সফল হতে পারেনি। যেমন এখনও বিভিন্ন বর্ডার দিয়ে বিস্তর অর্থ আসছে। এছাড়াও এদের অর্থের আরও যোগান হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে। অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতের এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী তাদের বিভিন্ন ব্যবসা থেকে অনেক টাকা তুলে নিয়েছে। এই টাকা তারা কী করছে, কোথায় কোন্ কাজে ব্যয় করছে তার খোঁজ সরকার রাখতে পারছে না। জঙ্গী অর্থায়ন বন্ধ করার জন্য ইসলামিক ব্যাংকে একটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। সে পরিবর্তন হয়েছে ওপরের কাঠামোতে। নিচের দিকে সবই জামায়াতে ইসলামীর কর্মী। তারা আগে হয়ত খুব সোজাপথে জঙ্গীদের অর্থ দিত, এখন কৌশলে দিচ্ছে। তারা এতই দক্ষ যে, তাদের ওপর নজরদারি রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার বা সরকার সমর্থকরা। তাই জঙ্গী অর্থায়ন সমান গতিতে আছে বলেই ধরে নেয়া উচিত। শুধু তাই নয়, আগামী দিনে এটা বাড়বে। কারণ তারেক রহমান এখনও বসে আছেন আগামী নির্বাচনে অর্থ ব্যয় করার জন্য। এখনও তাদের দলের একটি অংশ মনে করছে তারা নির্বাচনে যাবে। অবশ্য আগামী বছর হয়ত এই অবস্থানটুকু তাদের থাকবে না। তখন তাদের হিসাব হবে, নির্বাচনে যাওয়ার অর্থ শেখ হাসিনা সরকারকে আরও শক্তিশালী করা। কারণ নির্বাচনে তারা জিততে পারবে না এটা ততদিনে আরও নিশ্চিত হবে। তখন তারা বলবে, শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না তাই তারা অংশগ্রহণ করবে না। বিএনপি যখনই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেবে ও তাদের দলের ভেতর এবং নেতৃত্বে বেশ কিছু সমস্যা আসবে তখন বিএনপির মূল পরিচালক পাকিস্তান ও বিএনপির সিদ্ধান্ত ভিন্ন হবে। পাকিস্তান ও বিএনপি তখন সিদ্ধান্ত নেবে আবার ২০১৩ সৃষ্টি করার। এবার তারা আরও বেশি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস সৃষ্টি করে শেখ হাসিনার সরকারকে অচল করার চেষ্টা করবে। তাদের এ চেষ্টার মূল উদ্দেশ্য থাকবে, আন্তর্জাতিক চাপে ও অভ্যন্তরীণ চাপের ফলে যেন দেশে অন্য কোন ধরনের সরকার আসে। সে সরকার অনির্বাচিতই হবে এবং তারা যদি বেশ কিছুদিন থাকে সেটাও বিএনপি তাদের জন্য লাভের মনে করবে। এখনও তাই মনে করে। এ কারণে তারেক ও পাকিস্তানের অর্থ তখন জঙ্গীদের কাছে আরও বেশি যাবে। শুধু তাই নয়, জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির আরও কর্মী নিয়ে জঙ্গীদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা হবে। আর পাকিস্তান খুব সহজে বাংলাদেশে জঙ্গীদের কাছে অর্থ পাঠাতে পারবে। কারণ, এক্ষেত্রে তাদের নিরাপদ স্থান পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং যে সব সাংবাদিক বিভিন্ন এলাকা ঘুরেছেন বা ওয়াকিফহালদের সঙ্গে কথা বলেন, তারা জানেন, মমতার আনুকূল্যে পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু এলাকাকে এখন পাকিস্তান বলা যেতে পারে। সে সব এলাকা থেকে ভীত হয়ে অনেকে বাড়িঘর বদলে অন্য স্থানে চলে আসছেন। তাই ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার যদি কোন কঠোর ব্যবস্থা না নিতে পারে, তাহলে তারেক ও পাকিস্তানের একটি ভাল ঘাঁটি হবে পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি এলাকা। সেখানে নিরাপদে বসে বাংলাদেশের জঙ্গী নেতারা দেশের অভ্যন্তরে অপারেশন চালাতে পারবে। এই রাজনৈতিক দিকগুলো ছাড়া সামাজিকভাবেও জঙ্গী বাড়ছে। প্রথমত ইসলামিক ফাউন্ডেশন খুতবা নির্ধারিত করে দেয়ার নির্দেশ দিলেও তা পালন হচ্ছে কিনা তা মনিটর করছে না ফাউন্ডেশন। তার বদলে অনেক ক্ষেত্রে কী হচ্ছে সে খোঁজও নিচ্ছে না। এর ফলে জঙ্গী তৈরির কাজ আগের মতোই চলছে। এছাড়া এ কলামে বহুবার লিখেছি, দেশের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের পরীক্ষার চাপ থেকে বের করে আনুন। এই সর্বনাশী শিক্ষানীতি থেকে সরে আসা সরকারের একান্ত প্রয়োজন। এখান থেকে সরে এসে শিশু-কিশোরের মনোবিকাশ ঘটানোর পথে হাঁটতে হবে সরকারকে। অন্যদিকে যে হেফাজতের দাবির কাছে মাথা নত করে সরকার পাঠ্যসূচী পরিবর্তন করেছে সাময়িকভাবে দেশকে স্থিতিশীল রাখার জন্যÑ এ কোন সমাধান নয়। রাজনীতিবিদরা সমাজের বাস্তব অবস্থা বুঝে চলেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করেছিল বলে তাদের সৈন্যরা সাফল্যের সঙ্গে পশ্চাদপসরণ যেমন করে, তেমনি শেষ জয়ের হাসি তাদের জন্যই হয়। যুদ্ধে পশ্চাদপসরণ কখনও কখনও প্রয়োজন হয়, কিন্তু আদর্শের ক্ষেত্রে কখনও পশ্চাদপসরণ করতে নেই। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু কখনই কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাপের মতো হঠকারী আবার আপোসকামী সিদ্ধান্ত নেননি। এমনকি বঙ্গবন্ধু এলএফও মেনে নিয়ে ’৭০-এর নির্বাচনে যানÑ এ যেমন সত্য তেমনি এও সত্য, কেউ দেখাতে পারবে না বঙ্গবন্ধু আদর্শের সঙ্গে আপোস করেছিলেন কোনদিন। এখন আমাদের সমাজে প্রায়ই একটা কথা শুনি, আদর্শ কোন বিষয় নয়, টাকাই বড়। এ সত্য নয়। বরং আদর্শ কোন বিষয় নয় বলেই জঙ্গীদের সহায়তা করা হচ্ছে। এই জঙ্গী দমনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বা বর্তমান সরকারকে এ সত্যও মানতে হবে, বিএনপি যেমন জঙ্গীদের অর্থ ও লোকবলের যোগান দিচ্ছে, তাদের আশ্রয় দিচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কিন্তু তার থেকে কম যাচ্ছেন না। অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, জঙ্গী হামলা হলে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতার জানা থাকা সত্ত্বেও জামায়াতের নেতার বিরুদ্ধে কেস করতে দেন না। তিনিই থানাকে বাধা দেন। কারণ ওই জামায়াত নেতার কাছ থেকে তিনি অর্থ সহায়তা পান। আবার অনেক আওয়ামী লীগ নেতা মনে করেন, জামায়াতের নেতাকে দলে যোগদান করিয়ে তিনি লাভবান হচ্ছেন। আসলে লাভবান হচ্ছে ওই জামায়াত নেতা। সে সেল্টার পাচ্ছে আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগের ভেতর বসে, আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের মানসিক শক্তি দুর্বল করে দিচ্ছে এরা। যেমন উদাহরণ হিসাবে বলা যায় একটি বিশেষ ক্ষেত্রের পেশাজীবী নেতা এমন একজন আছেন, যার কারণে প্রকৃত আওয়ামী লীগাররা প্রমোশন পান না। সরকারী চাকরি ছেড়ে দিয়ে অনেকে বেসরকারী চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছেন এই আওয়ামী লীগের সময়। এ সবও আদর্শের সঙ্গে আপোসের ফল। যা হোক, গত কয়েকদিন আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু এখানে শেষ নয়। আগামী দিনগুলোকে আরও কঠিন করার চেষ্টা করা হবে। তার ইঙ্গিতও মির্জা ফখরুল দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সরকার ভয়ঙ্কর খেলা খেলছে। যে কোন বাচ্চা শিশুও তাঁর এ বক্তব্যের সত্যতা বোঝে। মির্জা ফখরুলের এ কথা সরকারকে উদ্দেশ করে নয়, তাঁর কর্মীদের জানিয়ে দেয়া যে, তাঁরা এখন ভয়ঙ্কর খেলায় নেমে গেছেন। তাঁদের কর্মীরা যেন প্রস্তুত থাকে। তাই মির্জা ফখরুলরা এই ভয়ঙ্কর খেলার জার্সি পরার আগেই সরকারকে এটা মোকাবেলা করতে হবে। দেরি করার মতো সময় তাদের হাতে আছে মনে করলে ভুল হবে।
×