ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নব্য জেএমবি নেতা সোহেল রানার নেতৃত্বে আত্মঘাতী স্কোয়াড

জঙ্গী ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আস্তানা তুমব্রু বাইশারি ও ঈদগড়

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৩ মার্চ ২০১৭

জঙ্গী ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আস্তানা তুমব্রু বাইশারি ও ঈদগড়

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ অরণ্যবেষ্টিত বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারি ও তুমব্রু এবং কক্সবাজারের রামুর ঈদগড় জঙ্গী সন্ত্রাসীদের বড় ধরনের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। এ তিনটি এলাকা মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি। স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে এখানে বাসস্থান গড়ে তুলেছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও দেশের উত্তরাঞ্চলের কিছু মানুষ। জঙ্গী সন্ত্রাসীরা এ তিনটি স্থানকে বেছে নিয়েছে নিরাপদ হিসেবে। কেননা, এসব স্থানকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্তিশালী নজরদারি নেই। অতিসম্প্রতি কুমিল্লা, মীরসরাই ও সীতাকু-ে একের পর এক জঙ্গী হামলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে লিস্টেট জঙ্গী নিহত হওয়ার ঘটনার পর বেরিয়ে এসেছে নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারি, তুমব্রু এবং রামুর ঈদগড় সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যের পাশাপাশি এখন জঙ্গীরাও আস্তানা গেঁড়েছে। পুলিশী অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে দিনাজপুর থেকে আসা সোহেল রানা নামের এক নব্য জেএমবি নেতা এসব এলাকায় গত এক বছর ধরে অবাধ বিচরণ করে স্থানীয়দের জঙ্গী সন্ত্রাসের সঙ্গে অত্যন্ত কৌশলে উদ্বুদ্ধ করছে। তার সঙ্গে ছিল কুমিল্লায় ধৃত হাসান ও অমি এবং সীতাকু-ের সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতার দম্পতি জহির ও আরজিনা। বুধবার চট্টগ্রাম রেঞ্জ ও জেলা পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, তারা নিশ্চিত হয়েছে গেল বছর বাইশারিতে পুলিশের ওপর বোমা হামলা, বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যা এবং গেল তিন মাস আগে আওয়ামী লীগ নেতা হত্যাকা-ের নেপথ্যের নায়ক এই সোহেল রানা ও তার সহযোগীরা। পুলিশ এখন গ্রেফতারকৃত হাসান, অমি, জহির ও আরজিনাকে সহসা রিমান্ডে এনে মুখোমুখি করে বিভিন্ন তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা চালাবে। উল্লেখ্য, বাইশারি এলাকাটি নাইক্ষ্যংছড়ির একটি ইউনিয়ন। আর ঈদগড়টি রামু উপজেলার অধীনে। এছাড়া এর পাশাপাশি রয়েছে আলী কদম উপজেলার অধীন চাকঢালা। এসব স্থান থেকে মিয়ানমারে হেঁটে চলাচল করা যায়। এসব স্থানে রয়েছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আরএসও সদস্যদের আনাগোনা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝেমধ্যে এসব এলাকায় অভিযান তৎপরতা চালায় বটে, কিন্তু গহিন অরণ্য এলাকা হওয়ায় সহজে পাকড়াও করা যায় না। এসব এলাকায় মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, নোয়াখালী, বরিশালসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকার লোকজন নামমাত্র মূল্যে পাহাড়ীদের কাছ থেকে জমি কিনে বসতি স্থাপন করেছে। বিশেষ করে ঈদগড়, চাকঢালা ও আলী কদম এলাকাগুলো রোহিঙ্গা জনঅধ্যুষিত। সীতাকু-ের জঙ্গী আস্তানা থেকে গ্রেফতারকৃতদের বাড়ি বাইশারির লম্বাবিল গ্রামে হলেও এদের পূর্ব নিবাস মিয়ানমারে। বুধবার বাইশারি ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম জানান, একদিকে জঙ্গী সন্ত্রাসী, অপরদিকে রোহিঙ্গাদের উৎপাতে তারা উদ্বিগ্ন অবস্থায় রয়েছেন। বাইশারির প্রবেশমুখে কোন ধরনের তল্লাশি চৌকি নেই। সীতাকু-ে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান লাভের পর বাইশারি থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা করার প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে মোহাম্মদ আলম জনকণ্ঠকে জানান। তিনি জানিয়েছেন, সীতাকু-ের ছায়ানীড় ভবনে নিহত দম্পতির সন্তানটির বয়স যখন মাত্র ৫ দিন তারা তখনই বাড়ি ছাড়ে। এটি প্রায় ছয় থেকে সাত মাস আগের ঘটনা। আরও জানা গেছে, গেল বছর ১০ রমজানে জহির, কামাল ও হাসান যখন বাড়ি ছাড়ে তখন নিহত জোবাইদা ছিল সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা। গেল বৃহস্পতিবার ছায়ানীড় ভবনে আত্মঘাতী বোমায় কামাল ও জোবাইদা মারা যায়। সঙ্গে তাদের দুই বছর বয়সী শিশুও মারা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জহিরুলরা ৮ ভাই ও ৪ বোন। আর কামালরা ৬ ভাই ও এক বোন। এদের আধি নিবাস মিয়ানমারের আরাকানে। নিহত কামালের বাবা মোজাফফর আহমদ দাবি করেছেন তাদের আদি নিবাস কক্সবাজারের মহেশখালীতে। প্রায় বিশ বছর আগে তিনি বাইশারিতে এসে বসতি স্থাপন করেছেন। অপরদিকে, জহিরের পরিবার রামু উপজেলার জোয়ারিয়া নালা ইউনিয়নে ছিল। এরপর তারা বাইশারিতে চলে আসে। পুলিশের ধারণা, নিহত কামালের বাবা মিয়ানমার থেকে নাইক্ষ্যংছড়িতে এসেছেন বলে তারা খবর পেয়েছেন। অপরদিকে, জহির ও তার স্ত্রী আরজিনা, কামাল ও তার স্ত্রী জোবাইদা প্রাতিষ্ঠানিক কোন লেখাপড়া নেই। এরা বাড়ি ছাড়ার আগে এলাকায় জায়গাজমি চাষের কাজেই লিপ্ত ছিল। এদিকে, চট্টগ্রামের জঙ্গী আস্তানায় নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে যাওয়া সন্ত্রাসীদের তথ্য উদঘাটিত হওয়ার পর পুরো বান্দরবান জুড়েই চলছে তোলপাড়। গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ইতোপূর্বেকার চেয়ে এখন বহুগুণে তৎপর হয়েছে। সীতাকু-ে আটক জহিরের বাড়ি বাইশারি ইউনিয়নের যৌথ খামার বাড়ি এলাকায়। তার পিতা নুরুল আলম ও মা জান্নাত আরা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, জহির প্রতিনিয়ত তবলীগ জামাতে অংশ নিত। ছুরত আলম ওরফে হাসানই তাদের ছেলেসহ অন্যদের নব্য জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে। নিহত রাজিয়া সুলতানার মা সাদেকুন নাহার জানিয়েছেন, মেয়েকে চিকিৎসার কথা বলে জহির ঘর থেকে বের হওয়ার পর আর কোন খোঁজ মেলেনি। এ ব্যাপারে তারা ইউপি চেয়ারম্যানকে অভিযোগ দিয়ে রাখেন। অপরদিকে, জোবাইদার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আট মাস ঘরে সে নিখোঁজ ছিল। তার স্বামী কামাল বেড়ানোর কথা বলে গত আট মাস আগে ঘর থেকে বের হয়। এরপর থেকে আর খবর মেলেনি। জোবাইদা একটু ধর্মমনা ছিল। বাইশারি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই আবু মুসা জানিয়েছেন, সীতাকু-ের জঙ্গী আস্তানায় নিহত জোবাইদা ও কামালের পরিচয় তারা নিশ্চিত হয়েছেন। বাইশারি এলাকার লোকজন বিস্মিত হয়েছে তারা এদের চলাফেরায় জঙ্গী সন্ত্রাসের কোন লক্ষণ বুঝতে পারেননি। তবে এলাকায় বরিশাল, নোয়াখালী ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন লোকজনের বসতি যেমন রয়েছে, তেমনি আনাগোনাও রয়েছে। এদিকে পুলিশী অনুসন্ধানে আরও খবর মিলেছে, সীতাকু-ে ঘটনার আগে এসব জঙ্গীরা তিনমাস পটিয়ায় ছিল। পটিয়ার পৌর এলাকার ৩নং ওয়ার্ডের আমির ভান্ডার রেলগেট এলাকার নুরুল আমিন মুন্সীর ঘরের তিন তলায় ভাড়া থাকত। পটিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ নেয়ামত উল্লাহ জানিয়েছেন, গত শুক্রবার ভবনটিতে তারা তল্লাশি চালিয়েছেন এবং ভবন মালিকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়েছেন। সীতাকু-ের জঙ্গী সন্ত্রাসের ঘটনার পর পুলিশ পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হয়েছে দিনাজপুর থেকে আসা সোহেল রানাই চট্টগ্রাম অঞ্চলে নতুন করে জঙ্গী সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়েছে। তার বয়স ৩৬ থেকে ৩৭ বছর হবে বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। এছাড়া সে আলিম পাস। সে ৫ সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে ১২ সদস্যের সুইসাইডাল একটি স্কোয়াড। এছাড়া নব্য জেএমবির জন্য সদস্য সংগ্রহে কাজ করছে মুসা নামের আরেকজন। সেও বহিরাগত। পুলিশ এদের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য পেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সকল সংস্থাকে এদের ব্যাপারে প্রাপ্ত তথ্য প্রদান করা হয়েছে। সোহেল রানা মুখে দাড়ি রয়েছে। তার ছবি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর হাতে দেয়া হয়েছে। সোহেল রানা সম্পর্কে দিনাজপুরে তথ্য সংগ্রহের জন্য তৎপরতা চলছে। কারণ, দিনাজপুরের ঠিক কোথায় তার বাড়ি তা এখনও জানা যায়নি।
×