ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুফতি হান্নান ছিনতাই চেষ্টায় হুজির সঙ্গে নব্য জেএমবি কানেকশন

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৩ মার্চ ২০১৭

মুফতি হান্নান ছিনতাই চেষ্টায় হুজির সঙ্গে নব্য জেএমবি কানেকশন

শংকর কুমার দে ॥ ফাঁসির আসামি হরকত-উল-জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি) প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টার নীলনক্সার সঙ্গে জড়িত ছিল র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত সারোয়ার-তামিম গ্রুপ বা নব্য জেএমবি’র পাঁচ জঙ্গী। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত পাঁচ জঙ্গীকে নব্য জেএমবি বা সারোয়ার-তামিম গ্রুপের বলা হলেও দুই জন হুজির সদস্য, যার মধ্যে একজন মুফতি হান্নানের আত্মীয়। নব্য জেএমবি বা সারোয়ার-তামিম গ্রুপের গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা ও ছক কষার ঘটনায় হুজির সঙ্গে নব্য জেএমবি বা সারোয়ার-তামিম গ্রুপের জঙ্গীরা এক প্লাটফর্মে এসে সংগঠিত হয়েছে। র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গুলশান ও শোলাকিয়াসহ সাম্প্রতিক জঙ্গী হামলাগুলো হয়েছে, আইন শৃঙ্খলাবাহিনী বিশেষ করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়ে আসছে, হামলাকারী জঙ্গী গোষ্ঠী নব্য জেএমবি, আর এই অংশটিকেই র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সারোয়ার-তামিম গ্রুপ। যেই নামেই ডাকা হোক না কেন এই জঙ্গী গোষ্ঠীই সাম্প্রতিককালে আত্মঘাতী জঙ্গী হামলাও করে যাচ্ছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত সারোয়ার-তামিম গ্রুপের পাঁচ জঙ্গী, যাদের নব্য জেএমবিও বলা হয়ে থাকে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র‌্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে সারোয়ার-তামিম গ্রুপ বা নব্য জেএমবি যখন প্রায় নেতৃত্বশূন্য তখন গ্রেফতারকৃত পাঁচ জনের সঙ্গে আরও অন্তত ১০ থেকে ১২ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। এসব জঙ্গী এখন ছোট ছোট দল বা সেলে বিভক্ত হয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে রাজধানীর মিরপুর-কাফরুল এলাকায় সংগঠিত হচ্ছিল একটি গ্রুপ। এই গ্রুপে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করা দুজন প্রকৌশলী আছে। আছে হরকত-উল-জিহাদ (হুজি) নেতা ও ফাঁসির দ-প্রাপ্ত মুফতি হান্নানের এক আত্মীয়। গত সোমবার রাজধানীর কয়েকটি এলাকা থেকে নব্য জেএমবি বা সরোয়ার-তামিম গ্রুপের পাঁচ জঙ্গীকে গ্রেফতারের পর এমনই দাবি করেছেন র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) কর্মকর্তারা। তবে সেলটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সদস্য পলাতক। জানতে চাইলে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার যে পাঁচ জঙ্গীকে গ্রেফতার করার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। র‌্যাবের আরেক টিম এর আগে নয় জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে। তাদের কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে সেই নথিপত্র পর্যবেক্ষণ করেও গ্রেফতারকৃত পাঁচ জনের জঙ্গী সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করে পাঁচজনকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করে র‌্যাব। ২৮ মার্চ রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করে আসামিদের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয় বলে জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোমবার রাতে র‌্যাব-১০-এর একটি দল বাড্ডা থেকে অলিউজ্জামান ওরফে অলি ও আনোয়ারুল আলমকে গ্রেফতার করার পর তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই রাতেই সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে সালেহ আহাম্মেদ শীষ, আবুল কাশেম ও মোহন ওরফে মহসিনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে বিস্ফোরক, বোমা তৈরির সরঞ্জাম, জঙ্গীবাদী বই, নকল বন্দুক ও তিন লাখ ১৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃত পাঁচ জঙ্গীকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, জঙ্গীরা এখন ছোট ছোট সেলে বিভক্ত হয়ে কাজ করছে। গ্রেফতারকৃতরা তেমনই একটি সেলের সদস্য। এক বছর ধরে তারা সক্রিয়। ১০-১২ সদস্যের এই সেলের অধিকাংশ সদস্য কাফরুল ও মিরপুর এলাকার। এটি নিয়ন্ত্রণ করছিল অলিউজ্জামান। অলি একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিল। সে বুয়েট থেকে ২০১২ সালে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে। সেখানে পড়ার সময় তার ধর্মীয় বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। ২০১৫ সালে সারোয়ার-তামীম গ্রুপে যুক্ত হলে কাফরুল এলাকার জঙ্গী সেল পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। সেলের সদস্যদের ইন্টারনেট ও টেলিগ্রাম আইডি ব্যবহারের ওপর দীক্ষা দিত অলি। অলির সহপাঠী আনোয়ারুল আলম বুয়েট থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেছে। এখন একটি কোচিং সেন্টারের শিক্ষক। অলির মাধ্যমে সে সারোয়ার তামিম-গ্রুপে যোগ দেয়। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র হওয়ায় সে বোমা তৈরিতে পারদর্শী। অপর গ্রেফতারকৃত আবুল কাশেম আরবিতে লেখা উগ্রবাদী মতাদর্শ বাংলায় ভাষান্তর করে নেটে ছড়িয়ে দিত। সে কামরাঙ্গীরচর ফরিদাবাদ জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসা থেকে ২০১৪ সালে দাওরা হাদিস পাস করে। ২০১৬ সালের শুরুতে তার সঙ্গে অলির পরিচয় হয়। ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞান থাকায় দলের অন্য সদস্যদের নিয়ে আকিদাগত বিষয়ে আলোচনায় সে মূল ভূমিকা পালন করত। এ ছাড়া সদস্যদের কাছ থেকে মাসিক ইয়ানত সংগ্রহ করে সে অলির নির্দেশমতো বিভিন্ন স্থানে দিয়ে আসত। এ ছাড়া গ্রেফতারকৃত সালেহ আহাম্মেদ শীষও সংগঠনে নিয়মিত ইয়ানত প্রদান করত। চট্টগ্রামে অস্ত্র চালনার ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সে। শীষ মিরপুর সেনপাড়া বায়তুল মামুর মাদ্রাসা থেকে ২০১২ সালে দাখিল পাস করে মিরপুর বাঙলা কলেজে ডিগ্রী (পাস) কোর্সে ভর্তি হয়। অলির মাধ্যমে উগ্র ধর্মীয় ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয় সে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জঙ্গী ও হুজি নেতা মুফতি হান্নানের সঙ্গে সালেহর আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। একই গ্রুপের আরেক সদস্য মহসীন তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। ২০১৪ সাল থেকে বিভিন্ন পরিবহনের হেলপার হিসেবে কাজ করে। আবুল কাশেম তাকে উগ্রবাদী ভিডিও প্রদর্শন ও জিহাদী প্রস্তুতি নিতে দীক্ষা দেয়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সে বাড়ি ছেড়ে হিজরতের উদ্দেশে বের হয়। সেও গত বছর চট্টগ্রামে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছে। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতারকৃত পাঁচ জনকে সারোয়ার-তামিম গ্রুপের বলা হলেও জিজ্ঞাসাবাদে দেখা যায়, তাদের মধ্যে হুজির সদস্য রয়েছে, আবার ফাঁসির আসামি মুফতি হান্নানের আত্মীয়ও আছে। এতে দেখা যাচ্ছে, সারোয়ার-তামিম গ্রুপ বা নব্য জেএমবির সঙ্গে হুজির জঙ্গীরা একত্রে বা এক প্লাট ফরমে এসে কাজ শুরু করেছে। গত ৬ মার্চ ঢাকার আদালত থেকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের নেয়ার সময়ে টঙ্গীতে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে ফাঁসির আসামি হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে জঙ্গী গোষ্ঠী। এর আগে ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে একই কায়দায় প্রিজনভ্যানে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়ে তিন জঙ্গীকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গী গোষ্ঠী জেএমবি। এতে দেখা যাচ্ছে, জেএমবি বা নব্য জেএমবি অথব সারোয়ার-তামিম গ্রুপ যাই বলা হোক না কেন ফাঁসির আসামি মুফতি হান্নানের হুজি জঙ্গী গোষ্ঠীর সঙ্গে জেএমবির এক প্লাটফরমে এসে জঙ্গী তৎপরতা করেছে, যা গ্রেফতারকৃত পাঁচ জঙ্গীও মুফতি হান্নান ছিনতাই ছকের সঙ্গে জড়িত রয়েছে এমন ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে বলে র‌্যাব কর্মকর্তার দাবি।
×