ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গণপরিবহনে যত বিড়ম্বনা, ভোগান্তি নারী যাত্রীদের

আপা, মহিলা সিট খালি নাই, উঠন যাইব না

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৩ মার্চ ২০১৭

আপা, মহিলা সিট খালি নাই, উঠন যাইব না

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ মিরপুর-১ নম্বর ওভারব্রিজের নিচে গণপরিবহনের জন্য প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছেন তামান্না মির্জা। গন্তব্য মতিঝিল। তিনি যে বাসেই উঠতে যাচ্ছেন হেল্পার বলছে, ‘আপা মহিলা সিট খালি নাই, উঠন যাইব না।’ তামান্নার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ যাত্রী দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠতে পারলেও তার পক্ষে সম্ভব নয়। বুধবার সকাল ৯টার চিত্র এটি। এ সময় তামান্নার পাশে থাকা অনেক কর্মজীবী নারীর দশাও একই। প্রতিদিন এসব কর্মজীবী নারী অফিসে যাওয়ার পথে পরিবহনে ওঠা নিয়ে এক প্রকার লড়াইয়ের সম্মুখীন হন। যানজট ও পরিবহন সঙ্কটে নগরীতে পথ চলাই দায়। এ অবস্থায় নারী যাত্রীর তো সংগ্রামের শেষ নেই। পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। সঙ্গে রয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। সকাল থেকে শুরু করে রাতে বাসায় ফেরা পর্যন্ত কর্মজীবী নারীকে নিগ্রহের শিকার হতে হয়। শিক্ষার্থীদেরও একই অবস্থা। আসফিয়া সিটি কলেজের ছাত্রী। বলেন, কলেজে যাওয়া-আসার সময় প্রায় প্রতিদিনই লোকাল বাসে চলাচল করতে হয়। অনেক সময় ভিড়ের কারণে বসা তো দূরের কথা দাঁড়ানোর জায়গাও পাওয়া যায় না। ভিড়ের মধ্যে বাসে উঠলে অনেক সময় যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। পড়ালেখা বা চাকরির প্রয়োজনে আমার মতো হাজার হাজার নারীকে নিয়মিত লোকাল বাসে চড়তে হয়। কিন্তু বাসে সংরক্ষিত সিট থাকে সর্বোচ্চ ৯টি। অনেক সময় মহিলার আসনেও পুরুষকে বসতে দেখা যায়। জিন্নাত আরা একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনিও প্রতিদিন মিরপুর-১ অথবা মিরপুর-১০ থেকে বাসে অফিসে যাতায়াত করেন। শুধু অফিসেই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করতেও তিনি গণপরিবহন ব্যবহার করেন। উপায় না থাকায় গণপরিবহন ব্যবহার করতে হয় বলে জানালেন তিনি। বললেন, সব জায়গায় তো আর রিক্সায় যাওয়া যায় না। সঙ্গে সিএনজি ভাড়ায়ও নৈরাজ্য বিদ্যমান। তাই লোকাল বাসই ভরসা। কিন্তু সিট না পাওয়ায় প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকে অহেতুক সময় নষ্ট করতে হয়। রাজধানীর কর্মজীবী নারীর এই সমস্যা নিত্যদিনের ঘটনা। বর্তমানে শিক্ষাসহ কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মহিলা বাসযাত্রীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ মহিলা বাসের সংখ্যা হাতেগোনা। সরকারী চাকরিজীবীর কেউ কেউ অফিসের গাড়িতে যাওয়া-আসার সুযোগ পেলেও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের অফিসের গাড়িতে যাওয়া-আসার সুযোগ খুবই কম। ফলে অফিসে যাওয়ার সময় বাসে উঠতে না পারায় নারীদের পক্ষে ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছানো যেমন কঠিন হয়ে পড়ে তেমনি অফিস ছুটির পর ক্লান্ত শরীরে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় একটি মহিলা বাস কিংবা সাধারণ বাসে ওঠার অপেক্ষায়। নারী শিক্ষা দিন দিন বেড়েই চলছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে কর্মজীবী নারীর সংখ্যাও। রাজধানীতে তাদের উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি। কিন্তু অফিস-আদালতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে তারা সীমাহীন বিড়ম্বনা ও ভোগান্তিতে পড়েন। চাকরি ছাড়াও নানা সময় নানা প্রয়োজনেও ঘরের বাইরে নারীর দৃপ্ত পদচারণা বাড়ছে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে তারা নতুন নতুন বাস্তবতা ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। তারা সাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারছেন না। এর অন্যতম কারণ পরিবহন সঙ্কট। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সালমা আলী জনকণ্ঠকে বলেন, এই সঙ্কটেরও আছে নানা মাত্রা। প্রথমত, মহিলা বাসের সংখ্যা অপ্রতুল। আবার তা সব সময় পাওয়াও যায় না। দ্বিতীয়ত, নারীদের সাধারণ বাসে সংরক্ষিত আসনের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় কম। অনেক সময় তা হয়ে পড়ে বেদখল। তাছাড়া অফিস টাইমে ও ব্যস্ত সময়ে অনেক সাধারণ বাসেও নারীদের ঠাঁই হয় না। বাসে তুলতেই হেল্পার-ড্রাইভাররা অনীহা প্রকাশ করে। তাদের যুক্তি, নারী পুুরুষের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যেতে পারেন না। তারা উঠতে-নামতে সময় নেন বেশি ইত্যাদি। তৃতীয়ত, পৃথক মহিলা বাস সার্ভিস বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক দাবি করা হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে, চাহিদা নেই। এ ক্ষেত্রে নারীর অসচেতনতাও দায়ী। কলেজছাত্রী মিথিলার অভিযোগ হেল্পারদের দুর্ব্যবহার নিয়ে। তার মতে, রাস্তার সব বাসই মনে হয় পুরুষের জন্য। মেয়েমানুষ বলে বাসের কাছেই যেতে দেয় না হেল্পাররা। দাঁড়িয়ে যাব বললে, তবুও না। উঠতে গেলে, সিট নাই, আপা উইঠেন না ইত্যাদি কথা। বাস্তবতা যাচাই করতে এক বাস চালক রতনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কি কারণে তারা সিটের বেশি মহিলাদের বাসে তুলতে চান না। তিনি বলেন, মহিলারা উঠলেই ঝামেলা হইবই। দেখা যায় অনেক সময় মারামারিও লাইগা যায়। এগুলান যাতে না হয় সে জন্যই সিট ছাড়া মহিলাগো নেওন যায় না। জানালেন রফিক। হেল্পার মুঈদ দিলেন আরেক যুক্তিÑঅফিসের বা ভিড়ের সময় একটা মহিলার জায়গায় ৩ জন (পুরুষ) নেওন যায়। মহিলারা দাঁড়াইলেই তাগো সাইড দিতে হয়। হের লাইগা ভিড়ের সময় মহিলাগো বাসে উঠাই না। তবে এ সমস্যার মূল কারণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বলে মন্তব্য করলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, সবার আগে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। সরকার তো বাসে বাসে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। সেটা সম্ভবও না। সেক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি তো আগে পাল্টাতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি যেভাবে হচ্ছে সামাজিক অগ্রগতি ততটা হচ্ছে না। বরং দিন দিন বাড়ছে অশ্লীল মানসিকতার। তবে বাসে এ ধরনের সমস্যা এড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে বাস মালিকদের চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ছে দিন দিন। সে সঙ্গে শ্রমবাজারে নারীর উপস্থিতিও বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালে করা লেবার ফোর্স সার্ভেতে দেখা যায়, ২০০২-০৩ সালে শ্রমবাজারে নারীর উপস্থিতি যেখানে ছিল ১০ দশমিক ৩ শতাংশ, এক বছরের মাথায় তা এসে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ২ শতাংশ। পাঁচ বছরের মাথায় বর্তমানে তা অনেক, অনেক বেড়ে যাওয়ারই কথা। বিশেষ করে শহরে-নগরে এই কর্মজীবী নারীর বহুমাত্রিক বিড়ম্বনা ও সমস্যার কথা এখন অনেকেরই অজানা নয়। তার মধ্যে পরিবহন সংঙ্কট বহুলাংশে তাদের পথচলায় বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ঢাকা মহানগর পরিবহন কমিটির (ঢাকা মেট্রো আরটিসি) শর্তানুযায়ী, ঢাকার বড় বাসে নয়টি এবং মিনিবাসে ছয়টি আসন শিশু, নারী ও প্রতিবন্ধীর জন্য সংরক্ষিত। তবে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসনের এ শর্ত অনেক বাসেই মানা হয় না। আবার মানলেও সেসব আসন বেশিরভাগ সময় পুরুষ যাত্রী দখল করে রাখে। আসন ছেড়ে দেয়ার কথা বললে নানারকম কটূক্তি করতে থাকে। পাশাপাশি নির্ধারিত আসনের বাইরে বসতে গেলেও নারীকে শুনতে হয় নানা আপত্তির কথা। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ১৯টি বিআরটিসি মহিলা বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। এর মধ্যে সকাল সোয়া ৭টায় ও সোয়া ৮টায় আবদুল্লাহপুর থেকে মতিঝিল, সকাল সাড়ে ৮টায় নতুনবাজার থেকে মতিঝিল এবং বিকেল ৬টা ১০ মিনিটে মতিঝিল থেকে নতুন বাজার, সকাল ৯টা ৫ মিনিট ও ১০টা ১০ মিনিট রাজধানীর তালতলা থেকে মতিঝিল এবং সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিট ও ৬টা ১০ মিনিটে মতিঝিল থেকে তালতলা এবং বিকেল সোয়া ৫টা ও সোয়া ৬টায় মতিঝিল থেকে আবদুল্লাহপুর, সকাল সাড়ে ৭টায় মিরপুর-১২, মিরপুর-১০ থেকে মতিঝিল বাস ডিপো এবং সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় মতিঝিল দ্বিতল বাস ডিপো থেকে মিরপুর-১২ ও মিরপুর-১০, সকাল ৮টায় মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল এবং বিকেল সোয়া ৫টায় মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুর, সকাল ৮টায় মিরপুর ১০ থেকে মতিঝিল এবং বিকেল সোয়া ৫টায় মতিঝিল থেকে মিরপুর-১০, সকাল পৌনে ৮টায় ও সোয়া ৮টায় নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিল এবং বিকেল সোয়া ৫টায় ও ৬টায় মতিঝিল থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটিসি মহিলা বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর মিরপুর-১২ থেকে আসাদগেট হয়ে আজিমপুর পর্যন্ত মহিলা স্কুল বাস সার্ভিস পরিচালিত হচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এসব বাস নিয়মিত কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সচিব মোহাম্মদ শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, নিয়মিতই চলছে। কিন্তু অনেক রুটে চালু থাকে বলে চোখে পড়ে না। এ ক্ষেত্রে বাস্তবতা হলো সকালে অফিসে মহিলাদের দেয়ার পর সারাদিনে আর কোন মহিলা যাত্রী পাওয়া যায় না। তারপরও আমাদের কড়া নির্দেশ দেয়া আছে গণপরিবহনে মহিলাদের জন্য ৯টা সিট খালি রাখার জন্য। সে সঙ্গে এ ধরনের অভিযোগ পেলেই আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতেরও ব্যবস্থা রয়েছে। অথবা অনেক সময় নারী পুলিশ বা সামনে থাকা ট্রাফিক পুলিশের কাছে অভিযোগ আসে। তখন তারাই ব্যবস্থা নিতে পারে। যদি ১শ’ মহিলাও আগে ওঠে তাহলে মহিলাদেরই নিতে হবে। বাস হেলপারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলেই আমরা ব্যবস্থা নেব। কারণ, মহিলা যাত্রীর সঙ্গে এমন আচরণ করার কোন সুযোগ তাদের জন্য নেই।
×