ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা ধর্মান্ধ নই ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৩ মার্চ ২০১৭

আমরা ধর্মান্ধ নই ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারা জঙ্গীবাদে অস্ত্র, অর্থ ও উৎসাহ দিচ্ছে তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলো এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এখানে কথা হচ্ছে কারা এদের হাতে অস্ত্র দিচ্ছে? কারা এদের টাকা দিচ্ছে? কারা এদের উৎসাহিত করছে? এসব কিছু খুঁজে বের করা দরকার। আর জঙ্গীবাদ থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্ত রাখতে শিক্ষক ও অভিভাবকদের আরও উদ্যোগী হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। বুধবার প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রদত্ত ‘প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক ২০১৩-১৪’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে দেশের শিক্ষক সমাজের উদ্দেশে বলেন, জাতিকে গড়ে তোলার বিরাট দায়িত্ব শিক্ষকদের। আপনারা মানুষ গড়ার কারিগর। আপনাদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ছেলেমেয়েদের তৈরি করবেন। কারিগরি বিষয়ে বিদেশীদের ওপর নির্ভরশীলতা দূর করে দেশেই দক্ষ লোকবল তৈরির উদ্যোগের কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়ে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার দেশের উচ্চশিক্ষার প্রসারে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ করে দিয়েছি, এই আইন যাতে যথাযথ প্রয়োগ হয়, সেদিকে সকলের নজর দিতে হবে। সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাযথ মনিটরিং করতে ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আইন কমিশন আইন-১৯৭৩’ সংশোধন করার কাজ চলছে। আসলে মঞ্জুরি কমিশন যে অবস্থায় আছে তা দিয়ে ১৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়কে নজরদারিতে রাখা সম্ভব নয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ ও ২০১৪ সালে পদক অর্জনকারী ২৩৩ জনের মধ্যে ৫৬ জনের হাতে এই স্বর্ণপদক ও সনদ তুলে দেন। স্বর্ণপদক গ্রহণ করে অনুভূতি জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বর্তমানে শিক্ষক জেনিফার হাকিম লুপিন এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বর্তমানে শিক্ষক সজল রহমান। সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাসে যারা মেধাতালিকায় আসছে, তাদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করেই প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যানরা, ইউজিসির বর্তমান ও সাবেক সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, স্বর্ণপদকপ্রাপ্তদের অভিভাবকগণ এবং ইউজিসির কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামের নামে জঙ্গীবাদের প্রসারের বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক উন্নত দেশ, সেখানে পড়াশোনা করতে গিয়ে উল্টো এ ধরনের জঙ্গীবাদের পথে চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশেও কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, ছেলেমেয়েরা কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে কি না- সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে তারা বিপথে যেতে না পারে। তিনি বলেন, সত্যিই আমি অবাক হয়ে যাই, মেধাবী, শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত (পরিবারের) ছেলেমেয়েরা কীভাবে ধর্মান্ধ হয়ে যায়, আর কীভাবে জঙ্গীবাদের পথে যায়। এটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। এখানে কখনোই বলা হয়নি যে, নিরীহ মানুষ হত্যা কর। আর নিরীহ মানুষ হত্যা করলে বেহেস্তে চলে যাবে- এটা কি করে হয়? জঙ্গীদের আত্মঘাতী হামলার সমালোচনা করে তিনি বলেন, আমাদের ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ। সেই মহাপাপের পথে কি করে যায় ধর্মের নামে? দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশের মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করি, ধর্ম পালন করি। আমরা ধর্মভীরু, কিন্তু ধর্মান্ধ নই। আর আমাদের বাংলাদেশে, এই ভূখ-ে সকলে যার যার ধর্ম পালন করবে স্বাধীনভাবে। সেই অসাম্প্রদায়িক একটা চেতনা নিয়েই বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে সরকারপ্রধান আরও বলেন, এই অঞ্চলে আমরা সবসময় একটা সম্প্রীতি নিয়ে চলি। কিন্তু সেই জায়গায় উগ্রবাদ যে ধ্বংস এনে দেয় বা আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলামের যে বদনাম করে দিচ্ছে- সেটা তারা (জঙ্গী) বোঝে কি না তা জানি না। জঙ্গীবাদের পাশাপাশি মাদকাসক্তি থেকে ‘ছেলেমেয়েদের’ রক্ষা করতে অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবাইকে আরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এসব মোকাবিলায় তার সরকার শিক্ষার প্রসার ঘটানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্রীড়া ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেন মেধাগুলো বিপথে গিয়ে তাদের জীবনটাকে নষ্ট করে না দেয়। ও রকম আত্মহননের চিন্তা যেন তাদের মধ্যে না থাকে। আত্মঘাতমূলক কাজ যেন তারা না করে বা তারা যেন ধর্মান্ধ হয়ে না যায়। তিনি বলেন, ধর্ম মানতে হবে, কিন্তু ধর্মান্ধ যেন না হয়- সেদিকে আমাদের বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, শিক্ষার মান উন্নত না হলে দেশ কীভাবে এগুবে? সেকথা মাথায় রেখেই বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে দেশের সরকারী মেডিক্যাল কলেজ ছিল ১৪টি; যা বেড়ে এখন ৩৬টি হয়েছে। বেসরকারী মেডিক্যালের সংখ্যা এখন ৬৯টি। ২০০৯ সালের পর নতুন ১১টি রাষ্ট্রায়ত্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে দেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হয়েছে ৪২টি। আর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৯৫টি। মেধাবী ছেলেমেয়েদের দেশের উন্নয়নের কথা ভাবার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব আজ এগিয়ে চলেছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে চলবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। শিক্ষাকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর নেয়া পথেই আমরা আমাদের শিক্ষার বিস্তার করে চলেছি। আমাদের সরকারেরও এটা লক্ষ্য যে আমাদের ছেলেমেয়েদের আরও বেশি শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তাদের জীবন মান আরও উন্নত হতে হবে। তিনি বলেন, গবেষণাকে আমরা সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেই। গবেষণাকে গুরুত্ব দিই বলেই বাংলাদেশ আজ খাদ্যে উদ্বৃত্তের দেশ। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা এবং উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। কারিগরি শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়ন করতে হবে। তোমরা আগামী দিনের সোনার বাংলাদেশ গড়তে নেতৃত্ব দেবে। মনে রাখতে হবে- এই স্বাধীন দেশ। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমরা আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে চলব, মাথা উঁচু করে বাঁচব। তিনি বলেন, আমরা শিক্ষা খাতে বেশি ব্যয় করছি। অবশ্য এটাকে আমরা ব্যয় মনে করছি না, বিনিয়োগ মনে করছি। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের প্রধানতম প্রয়োজন শিক্ষার বিস্তার, সব মানুষকে সাক্ষর করে তোলা, যার তাঁর সরকার করছে। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে শিক্ষার হার বাড়ালেও পরের বিএনপি-জামায়াত সরকার তা ফের নিচে নামিয়ে নেয়, সেই আক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পরে আবার ক্ষমতায় এসে তাঁর সরকার শিক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। তিনি বলেন, শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে জাতি এগিয়ে যাবেই। যে চেতনায় বিশ্বাসী হলে তাঁর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তারিই বাস্তবায়ন করে চলেছেন তিনি ও তাঁর সরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্রাম-বাংলায় জরিপ করে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। প্রাথমিক স্কুল সংস্কার, নির্মাণ, মাধ্যমিকে মেয়েদের পাঠের পরিবেশ সৃষ্টি, শিক্ষক নিয়োগে নারীদের অগ্রাধিকার, মানসম্মত শিক্ষার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, আধুনিক শ্রেণীকক্ষ ব্যবস্থা, স্কুলে স্কুলে ল্যাপটপ, প্রজেক্টের এগুলো দেয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলায় সরকারী কিংবা বেসরকারী যাই হোক একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার স্বপ্নের কথাও এ সময় তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
×