ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আমজাদ রাজাকার এখন আওয়ামী লীগ নেতা

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ২৩ মার্চ ২০১৭

আমজাদ রাজাকার এখন আওয়ামী লীগ নেতা

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ একাত্তরের দুর্ধর্ষ আমজাদ রাজাকার এখন আওয়ামী লীগের মিছিল মিটিংয়ে দেখা যায়। অথচ পুরো স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার বিরুদ্ধে বাঘারপাড়া এলাকায় বহু মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। রাজাকার হওয়ার কারণে নামের শেষে বিশেষণ লেগেছে। আমজাদ রাজাকার না বললে, তাকে এলাকার কেউ চেনে না। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এলাকা থেকে পালিয়ে যায় সে। এরপর আটক হয়ে অনেকদিন জেলে ছিল। এত বড় রাজাকার ৫ মাস আগে স্থানীয় এক এমপির হাতে ফুলের মালা দিয়ে যোগদান করেন আওয়ামী লীগে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ বাঘারপাড়ার মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধারা। বাঘারপাড়ার বন্দবিলা ইউনিয়নের প্রেমচারা গ্রামের মৃত সোবহান মোল্যার বড় ছেলে স্বীকৃত রাজাকার আমজাদ মোল্যা। সে এতই স্বীকৃত রাজাকার যে তাকে শুধু আমজাদ বললে মানুষ চেনে না। তাকে রাজাকার আমজাদ বলতে হয়। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের কাছে রাজাকারদের যে নামের তালিকা রয়েছে সেখানেও তার নাম লিখিত রয়েছে উপরের দিকে। কত নিরীহ মানুষকে আমজাদ রাজাকার হত্যা করেছে তার সঠিক হিসাব দেয়া কঠিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমজাদ ও তার বাহিনী অসংখ্য মানুষকে নিঃস্ব করেছে। তার সহযোগী হিসেবে তার সহোদর কেরামত মোল্যা ও রাজাকার ওহাব মোল্যা অনেক নির্যাতন করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, আমজাদ এমন কোন অপরাধ নেই যা করেনি। হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, লুটপাট সবকিছুই সে করেছে। আমজাদ স্বাধীনতার পর এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে এলাকায় ফিরলে আটক হয়। কারাগারে ছিল কয়েক বছর। ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের হত্যার পর কারাগার থেকে মুক্তি পায় আমজাদ রাজাকার। পরবর্তীতে বেশ কিছুদিন লুকিয়ে থাকে। পরে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করলে রাজাকার আমজাদ প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু করে। তারপর এরশাদ আমলে সে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে। পরে অবশ্য বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আবার বিএনপিতে ফিরে আসে এবং ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বেড়ায়। রাজাকার আমজাদ ৫ মাস আগেও বাঘারপাড়া বিএনপির প্রেমচারা ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি, ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি এবং বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপির অন্যতম সদস্য ছিল। গত ৫ মাস আগে বাঘারপাড়ার গাইদঘাট স্কুল মাঠে জনসভায় স্থানীয় এমপি রণজিৎ রায়ের হাতে ফুলের মালা দিয়ে যোগদান করে আওয়ামী লীগে। জহুরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উপজেলা যুবলীগ নেতা দিলু চেয়ারম্যান বলেন, আমজাদ রাজাকারের কথা বাঘারপাড়ার সবাই জানে। কারণ তাকে আমজাদ রাজাকার না বললে কেউ চেনে না। বীর মুক্তিযোদ্ধা নওশের আলী বলেন, সে ছিল বাঘারপাড়ার বড় রাজাকার। বাঘারপাড়ার মানুষ জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাঘারপাড়ার উত্তর চাঁদপুর গ্রামের নওশের আলীর মা রূপজান বেগমকে আমজাদ ধর্ষণ করে। গণধর্ষণ শেষে সমস্ত শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে রূপজানকে হত্যা করা হয়। একই গ্রামের নূর হোসেন দফাদারের সামনে আমজাদ ও তার দোষররা তার স্ত্রীকে হত্যা করে। উত্তর চাঁদপুর গ্রামের ডাঃ নওফেল উদ্দীন বিশ্বাসকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে আমজাদ রাজাকার। এছাড়া সীমাখালী গ্রামের রজব আলী বিশ্বাস ওরফে রজকলুকে ধরে নিয়ে এসে প্রেমচারা চিনারশীতে (বর্তমান ব্রিজের পাশে) পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে হত্যা করে। রজকলুকে ধরে আনার আগ মুহূর্তে সে মুড়ি খাচ্ছিল। তাই তার মৃত্যুর পর পেট ফেটে সেই মুড়ি বের হয়ে আসে। তার লাশ কয়েকদিন সেখানে পড়েছিল। বন্দবিলা ইউনিয়নের গাইদঘাট গ্রামের আব্দুল হামিদ বিশ্বাসের ছেলে মোক্তার আলীকে ধরে নিয়ে হত্যা করে বিজয় দাসের দেবদারু বাগানের কুয়ার মধ্যে ফেলে দেয় আমজাদ রাজাকার। একই গ্রামের তুরফান বিশ্বাসের ছেলে সুরত আলীকে হত্যা করে একই কুয়ার মধ্যে ফেলে দেয়। মোক্তার আলীর বৃদ্ধ পিতা হামিদ বিশ্বাস আজও তার সন্তান হত্যাকারী রাজাকার আমজাদের বিচারের আশায় বুক বেঁধে আছেন। তিনি আমজাদের ফাঁসি কার্যকার দেখতে চান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খুলনা বেতার কেন্দ্র থেকে রাজাকার আমজাদকে নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘নফর আলী আগুন জ্যালতা হে’। মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, রাজাকার আমজাদ ও তার সহোদর কেরামত ও ওহাব মোল্যা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সব লোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়েছে এবং যাদের হত্যা করেছে সেই সব হত্যার কষ্ট বুকে নিয়ে আজও বিচারের আশায় স্বপ্ন দেখছে স্বজনহারা পরিবার। বর্তমান সরকার অনেক প্রভাবশালী রাজাকার এমনকি প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রীদেরও ফাঁসি দিয়েছে। স্বীকৃত রাজাকার আমজাদ মোল্যা ওই অঞ্চলে তার দাপট দেখাচ্ছে। তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- দিলে সেই সব শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। আমজাদ রাজাকারকে দলে যোগদান প্রসঙ্গে রণজিৎ রায় এমপি বলেন, সে দলে যোগদান করেনি। এমপি হিসেবে এলাকার অনেক লোক তার কাছে আসে- কে রাজাকার কে রাজাকার নয়, তা তিনি জানেন না।
×