ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিউটি পারভীন

ঈর্ষণীয় সাফল্যে নায়ক তামিম

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২২ মার্চ ২০১৭

ঈর্ষণীয় সাফল্যে নায়ক তামিম

ক্যারিয়ারে বীরোচিত অনেক ইনিংসই খেলেছেন। প্রতিপক্ষদের কাছ থেকেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কিন্তু পি.সারা ওভাল টেস্টে শ্রুীলঙ্কার বিরুদ্ধে যে ইনিংসটি খেললেন, নিঃসন্দেহে সেটা অনেক বড় প্রাপ্তি হয়ে থাকবে তামিম ইকবালের কাছে। শুধু তাই নয়, তার ব্যাটে নিজেদের শততম টেস্টে জয় পাওয়ার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছে বাংলাদেশÑ সে কারণে দেশের ইতিহাসের পাতায়ও উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলবেন তামিম। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১৮ টেস্টে প্রথম জয়, আর চতুর্থ দেশ হিসেবে নিজেদের শততম টেস্টে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। আর এমন একটি জয় ৮২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলে পাইয়ে দিয়েছেন এ বাঁহাতি ওপেনার। সে কারণে হয়েছেন ম্যাচসেরা। আনন্দের পরিমাণটা আরও আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে তার জন্য। কারণ রবিবার দলকে জিতিয়েছেন আর সোমবার তার ২৮তম জন্মদিন। একজন ক্রিকেটারের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি বুঝি আর নেই। তামিম কেন দেশসেরা ক্রিকেটার সেটা আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন। আর প্রতিপক্ষ অধিনায়ক রঙ্গনা হেরাথও জানালেন তামিমের ব্যাটিং তোড়েই তাদের জয় পাওয়ার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। এক শ’ টেস্ট খেলে ফেলেছে ৯ দেশ। বাকি ছিল শুধু বাংলাদেশ। এবার কলম্বোর পি.সারা ওভালে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সেই মাইলফলক স্পর্শ করল মুশফিকুর রহীমের দল। যদিও শততম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তান ছাড়া জিততে পারেনি আর কেউ। বাংলাদেশ চতুর্থ দল হিসেবে নিজেদের শততম টেস্টে জয় তুলে নিয়েছে। সেই জয়ের অন্যতম রূপকার ছিলেন বাঁহাতি ওপেনার তামিম ইকবাল। ৮২ রানের দারুণ এক ইনিংস উপহার দেন তিনি। আর এতে করেই ঐতিহাসিক বিজয়ের ভিত পেয়ে যায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রান তাড়া করে জেতার ম্যাচে চতুর্থ ইনিংসে এটি দ্বিতীয় সেরা ইনিংস। সাকিব আল হাসানের ছিল অপরাজিত ৯৬ রান। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে বরাবরই ব্যাট হাতে তেমন সফল হতে পারেননি, এবার তাদের বিরুদ্ধে সেরা ইনিংস উপহার দিলেন। লঙ্কানদের বিরুদ্ধে প্রথম বিজয়ের যে স্বপ্ন সেটাও পূরণ হলো বাংলাদেশের। আর এ ইতিহাস রচনা এমন সময় করলেন যা বিশেষ এক উপহার হয়ে গেল তার। কারণ আজ তামিমের জন্মদিন, সেটার সবচেয়ে বড় উপহার হিসেবে পেয়েছেন দেশের শততম টেস্টে বিজয়। ২৮ বছরে পা দেবেন এ বাঁহাতি। শততম জয়ে দারুণ অবদানের জন্য হয়েছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। বাংলাদেশের পক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক রানের মালিক তামিম। সর্বাধিক সেঞ্চুরিও তার। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এবার সিরিজের আগে পর্যন্ত ৫ টেস্টে খুবই বাজে পরিসংখ্যান ছিল এ বাঁহাতির। কিন্তু দুদিনের প্রস্তুতি ম্যাচে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে এবার শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে দারুণ কিছু করার ইঙ্গিত দেন। যদিও প্রথম টেস্টে ৫৭ ও ১৯ রান করেছিলেন দুই ইনিংসে। কিন্তু পি.সারা ওভাল টেস্টে প্রথম ইনিংসেও দারুণ খেলেছেন। ৪৯ রান করে অল্পের জন্য হাতছাড়া করেন অর্ধশতক। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে নিজেকে বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রমাণ দেখান। একেবারে নিখুঁত একটি ইনিংস খেলেন তিনি। যদিও অন্যপ্রান্তে বাকি ব্যাটসম্যানরা তাকে সেভাবে সঙ্গ দিতে পারছিলেন না। আর পি.সারা ওভালে পঞ্চম দিনের উইকেট স্পিনারদের জন্য স্বর্গ হয়ে ওঠে। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞ স্পিনার রঙ্গনা হেরাথ তো ছিলেনই বড় হুমকি হিসেবে। সেটা পঞ্চম দিনে ১৯১ রানের জয়েল লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে যায় বাংলাদেশ। দলীয় ২২ রানের মধ্যে সাজঘরে ফিরে যান সৌম্য সরকার ও ইমরুল কায়েস। অথচ, এ দুজনই তামিমের খুব ভাল সঙ্গী। সাব্বির রহমান আগেভাগে নামেন এদিন। আর দারুণ সঙ্গ দেন তামিমকে। তার পূর্ণ সমর্থনে এদিন যেন পুরনো রূপে আবির্ভূত হন তামিম। ভয়ানক হয়ে ওঠা লঙ্কান স্পিনের বিরুদ্ধে দারুণ সব শট খেলেন আত্মবিশ্বাসী ফুটওয়ার্কে। দারুণ সব ড্রাইভের পাশাপাশি বেশকিছু বল সফলভাবে উড়িয়েও মেরেছেন। এমনকি একটা ছক্কাও হাঁকান লক্ষণ সান্দাকানকে যা কর্পোরেট বক্সের ছাদে গিয়ে পড়ে। এ বিষয়ে লঙ্কান অধিনায়ক হেরাথ বলেন, ‘আমরা দ্রুত দুই উইকেট ফেলে দিয়েছিলাম। তখন আমরা জয়ের যে স্বপ্ন দেখেছিলাম সেভাবেই সবকিছু হচ্ছে বলে মনে হয়েছে। কিন্তু মধ্যাহ্ন বিরতির পর আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে শুরু করে তামিম। আর সেখানেই আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায় ম্যাচটা।’ আক্রমণাত্মক মেজাজে ব্যাট চালালেও সেটা দলের জন্য জয় পাওয়াটাকে সহজ করে দিয়েছে। এ বিষয়ে তামিম বলেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতিতে যখন রান তাড়া করতে হয় তখন কিছুটা আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখাতেই হয়। আমি আর সাব্বির তখন সেটা নিয়েই বারবার কথা বলেছি যে দ্রুত রান তুলতে হবে।’ এভাবেই তৃতীয় উইকেটে সাব্বিরের সঙ্গে গড়ে তোলেন ১০৯ রানের বড় একটি জুটি। চতুর্থ ইনিংসে শত রানের জুটি তেমন একটা নেই বাংলাদেশের। তবে সাকিব আল হাসান একাই ৪টি শত রানের জুটি উপহার দিয়েছেন। তামিম এটি করলেন দ্বিতীয়বারের মতো। তামিম আউট হয়ে যাওয়ার আগে খেলেন ১২৫ বলে ৭ চার ও ১ ছক্কায় ৮২ রান। এটি তার টেস্ট ক্যারিয়ারে চতুর্থ ইনিংসে সবেমাত্র চতুর্থ ফিফটি। ক্যারিয়ারের ২২টি অর্ধশতক আছে তার। অর্থাৎ ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে তেমন ভাল করতে পারেননি কখনও। অবশ্য, বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং চেহারাটাই চতুর্থ ইনিংসে দুর্দশাময়Ñ পরিসংখ্যানটা তাই বলে। এরপরও চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বাধিক রান তামিমের। ১৮ ইনিংসে ৩৩.৬১ গড়ে ৬০৫ রান করেছেন চতুর্থ ইনিংসে। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক ৮ সেঞ্চুরির মালিক হলেও এর কোনটাই চতুর্থ ইনিংসে হাঁকাতে পারেননি তামিম। সর্বোচ্চ ৮৩ রানের ইনিংস খেলতে পেরেছিলেন। আর সমান ইনিংসে ৬১৬ রান আছে সাকিবের। বাংলাদেশ দলের রান তাড়া করে জেতার ম্যাচে চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান অবশ্য সাকিবের। তিনি ২০০৯ সালের জুলাইয়ে সেন্ট জর্জেসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় এনে দিয়েছিলেন অপরাজিত ৯৬ রানের ইনিংস খেলে। ওই ম্যাচেই রকিবুল হাসান করেছিলেন ৬৫ রান। তামিমের এই ৮২ রানের ইনিংসটি তাই বাংলাদেশের জয়ের ম্যাচে চতুর্থ ইনিংসের দ্বিতীয় সেরা। এছাড়া বাংলাদেশের জয়ের ম্যাচে আর কোন ফিফটি নেই চতুর্থ ইনিংসে। চতুর্থ ইনিংসে তামিমও তার ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেরা ইনিংসটি খেললেন। অবশ্য সার্বিকভাবে চতুর্থ ইনিংসে বাংলাদেশের ২২টি অর্ধশতক ও ৫টি সেঞ্চুরি আছে। কিন্তু তামিম যেন ব্যর্থই। আর শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান তামিমের পরিসংখ্যানটা আরও বাজে। এ সিরিজের আগে তিনি শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৫ টেস্টের ১০ ইনিংসে ১৯.৮ গড়ে করেছিলেন মাত্র ১৯৮ রান। ছিল একটি মাত্র ফিফটি। এবার দুই টেস্টের ৪ ইনিংসে করলেন ৫১.৭৫ গড়ে দুটি ফিফটিসহ ২০৭ রান। সবমিলিয়ে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে এখন ১৪ ইনিংসে তার রান ২৮.৯২ গড়ে ৩ ফিফটিসহ ৪০৫ রান। এই ৮২ রানের ইনিংসটিই লঙ্কানদের বিরুদ্ধে তার ক্যারিয়ার সেরা। অথচ অন্য দেশগুলোর বিরুদ্ধে ৪১.৪১ গড়ে ৮টি সেঞ্চুরি ও ১৯টি ফিফটিসহ করেছেন ৩ হাজার ২৭২ রান। এবার অন্তত শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সেই বাজে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠেছেন তামিম। আর সে কারণেই শততম টেস্টে জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বাংলাদেশের। তামিম অবশ্য জানিয়েছেন, গল টেস্টে হারের পরপরই আসলে এ বিজয়ের শুরু হয়েছিল। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ সময় ধরে পরস্পরের সঙ্গে এবং কোচের সঙ্গে আলোচনা করেছি। খেলোয়াড়রাও এগিয়ে এসেছে।’
×