ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কথাটা অপ্রিয় সত্য, কিন্তু প্রতিকারের পথ কি?

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২২ মার্চ ২০১৭

কথাটা অপ্রিয় সত্য, কিন্তু প্রতিকারের পথ কি?

খবরটা আমার চোখে পড়েছে একটু দেরিতে। নইলে সময় মতোই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে তার এই তিক্ত অথচ সত্য-ভাষণের জন্য অভিনন্দন জানাতাম। একটু দেরিতে হলেও এই অভিনন্দনটা এখন জানাচ্ছি। গত ১২ মার্চ রবিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে শ্রমিক লীগের সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যাতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কোন সংগঠনের খবর না ছাপেন। তিনি বলেছেন, নিউজ আর ছবি ছাপালে এসব ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সংগঠন উৎসাহিত হয় এবং চাঁদাবাজি করে। এদের উৎসাহিত করবেন না। যে শ্রমিক লীগের সভায় তিনি বক্তব্য রাখছিলেন, তাদের উদ্দেশেই তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় শ্রমিক লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার কী দরকার? বিদেশে শ্রমিক লীগের দরকারটা কী? কৃষক লীগের গুলশান শাখার কী দরকার? অথবা ধানম-িতে? ধানম-িতে যে ধান চাষ হয় তা তো আমি জানি না। কৃষক লীগের কাতার শাখার কী দরকার? তাঁতী লীগ নাম দেখলাম কুয়েতে, না কাতারে। তার আবার পাল্টা দুই কমিটি!’’ তরুণ লীগ নামে এক ভুঁইফোড় দলের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘‘এই লীগের হেডকোয়ার্টার কোথায়? পাঁচ শ’ টাকা দিয়ে একটা রাবার স্ট্যাম্প বানালেই তো দল হয়ে যায়।” এই দলগুলো যে বিনা পয়সায় বেসাতির দোকান সে কথাও তিনি উল্লেখ করে বলেছেন, “এই দোকানদারির স্বীকৃতি আমরা দেব না। এগুলো আওয়ামী লীগের সুনাম নষ্ট করছে, ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।” ওবায়দুল কাদেরের এই কথাগুলো অত্যন্ত তিক্ত সত্য। আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতাই এই সত্যটি জানেন, কিন্তু বলতে চান না। কারণ, তাদের একটা বড় অংশ এই ব্যাঙের ছাতাগুলোকে লালন-পালন করেন নিজেদের ব্যক্তিগত ও উপদলীয় স্বার্থ এবং নেতৃত্ব রক্ষার জন্য। তাতে দলের কী গুরুতর ক্ষতি হচ্ছে, সেদিকে তাদের নজর নেই। আওয়ামী লীগের মতো পুরনো ও প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনে যখন এসব কা- চলছে, তখন তার অনুকরণে অন্য কোন দলÑ বিশেষ করে বিএনপিতেও নামের পেছনে ‘জাতীয়তাবাদী’ কথাটি লাগিয়ে বহু শাখা মৃগ-উপদল তৈরি হয়েছে। এদের প্রধান কাজ চাঁদাবাজি। সঙ্গে উপদলীয় কোন্দলের বিস্তার এবং নিজ নিজ উপদলীয় নেতার জন্য জনগণকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা নজরানা আদায়। এদের উপদ্রবে দেশের সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সকল পেশার মানুষ অতিষ্ঠ। এসব উপদল সরকারী দলের ছাপমারা হলে তো কথাই নেই। দলের সরকার যত ভাল কাজ করুক, জনগণের কাছে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে থাকে। বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বড় সঙ্কট হচ্ছে তার ভাবমূর্তির সঙ্কট। কেবল প্রধানমন্ত্রীর সুনামও জনপ্রিয়তাকে মূলধন করে কোন দল বাঁচতে পারে না। তার দলীয় ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হওয়া দরকার। আমি লন্ডনে বাস করি। আওয়ামী লীগের আমি একজন শুভাকাক্সক্ষী। সে জন্য এখানেও এই দলের কার্যকলাপের দিকে লক্ষ্য করি। লক্ষ্য করে হতাশ হই। উপদলীয় কোন্দলে যুক্তরাজ্যের আওয়ামী লীগও জর্জরিত। ছাত্রলীগ, যুবলীগ অঘোষিতভাবে বিভক্ত এবং পারস্পরিক বিবাদ বিসম্বাদে লিপ্ত। যুক্তরাজ্যেও শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, তাঁতী লীগ আছে। তারাও বিভক্ত ও বিবাদে লিপ্ত। জামায়াত বা বিএনপির কার্যকলাপে বাধা দেয়ার চাইতে তারা নিজেরাই নিজেদের বাধা দিতে ব্যস্ত। ২০১৫ সালে একবার পূর্ব লন্ডনে আওয়ামী লীগ ‘ব্লু মুন’ নামে একটি কমিউনিটি হলে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ পালনের ব্যবস্থা করেছিল। তা দলের দুই গ্রুপের মধ্যে বিবাদে ভ-ুল হয়ে যায়। একবার বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক লন্ডন সফরে এলে ম্যানচেস্টারে তাকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য বড় রকমের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলের পাল্টা গ্রুপের হুমকিতে ভীত হয়ে আইনমন্ত্রী আর ম্যানচেস্টারে যাননি। সভাটি দায়সারা গোছের মতো অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী নেতা ঢাকার গুলশানে কৃষক লীগের দরকার কি প্রশ্ন তুলেছেন, আমার প্রশ্ন, লন্ডন শহরে কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, তাঁতী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের দরকারটা কি? ওবায়দুল কাদের মিডিয়াকে অনুরোধ করেছেন, তারা যেন এসব সংগঠনের খবর ও ছবি না ছাপেন। আমি তাকে অনুরোধ করি, তিনি যেন কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এসব উপদলের অনুমোদন দেয়া বন্ধ করেন। বিদেশে যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও আওয়ামী লীগের কর্মসূচীতে বিশ্বাসী তারা আওয়ামী লীগ এই মূল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বা সমর্থন দিয়ে কাজ করতে পারেন। তাতে কোন্দল ও বিভক্তি কমবে। দুঃখ হয় যখন বিদেশে বঙ্গবন্ধু পরিষদের অবস্থা দেখি। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে নয়; বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে দেশ-বিদেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের নেতৃত্বে একটি সহযোগী দল হিসেবে এই পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। এই পরিষদটিও এখন আওয়ামী লীগের অঙ্গ দলে পরিণত। বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতি কর্মীদের নেতৃত্ব থেকে হটিয়ে আওয়ামী লীগের একদল অসংস্কৃত নেতাকর্মীই এখন সর্বত্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের হর্তাকর্তা। এই নেতাকর্মীদের মধ্যে ঐক্য নেই। তাই ব্রিটেনসহ ইউরোপ আমেরিকার সর্বত্র বঙ্গবন্ধু পরিষদ বহু ভাগে বিভক্ত এবং আত্মকোন্দলে লিপ্ত। আমি নিউইয়র্কে গিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদের দুই গ্রুপের মারামারি দেখেছি। একবার ইতালির রাজধানী রোমে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভায় আমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে পরিষদের পাল্টা গ্রুপের হামলায় নিজেও আহত হতে চলেছিলাম। আমার স্নেহভাজন সাবেক কূটনীতিক জমির উদ্দীন আহমদ তখন ইতালিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদের দুই গ্রুপের যুদ্ধের মাঠ থেকে আমাকে উদ্ধার করেন। পরে দুই গ্রুপের নেতারাই আমার কাছে দাবি করেন তারাই আসল পরিষদ। তাদের একটা দাবি আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকেছিল। এই দাবি হলো তারা কেন্দ্রীয় পরিষদের এক নেতাকে চার লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ইতালি শাখার অনুমোদন নিয়ে এসেছেন। এই অভিযোগ কতটা সত্য তা খতিয়ে দেখার সাহস আমার আর হয়নি। যদি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোয়। লন্ডনের কথাই বলি, কর্মী নেই দশজন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরিষদের গ্রুপ তিনটি। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের মুখ দেখে না। এর ওপর আবার তৈরি হয়েছে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট এবং সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ফোরাম। জোটের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আছেন মন্ত্রী তারানা হালিম। ফোরামের নেতৃত্বে আছেন মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তারা দু’জনেই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তারা জানেন, প্রকৃত সংস্কৃতি কর্মী ছাড়া সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয় না। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী সাংস্কৃতিক কর্মীর সংখ্যা হাতেগোনা যায়। এই অবস্থায় এরা সকলে মিলে একটা সংগঠন গড়ে না তুলে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য উপসংগঠন গড়ে তোলার স্বার্থকতা কি? লন্ডনে এসব সংগঠনের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের অধিকাংশের শিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কটা কোথায়? ওবায়দুল কাদের ঠিকই বলেছেন, এই ব্যাঙের ছাতার মতো নামসর্বস্ব সংগঠন গড়ে তোলা এখন একটা ব্যবসা বা দোকানদারি। চাঁদাবাজিই শুধু তাদের একমাত্র অকাজ নয়। অর্থের বিনিময়ে সংগঠনের সদস্য ও কর্মকর্তার পদ বিতরণ বা বিক্রিও একটি বিরাট ব্যবসা। শুনেছি, বাংলাদেশে একটি জেলায় আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গ সংগঠনের শাখা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মকর্তার পদ বহু লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে এবং বহু স্থানেই নাকি হচ্ছে। লন্ডনেও একটি সংগঠন সম্পর্কে এই গুজব শুনেছি। বিএনপিতেও এই বাণিজ্য রমরমা। বাজারে চালু গুজব, বিএনপির ‘যুবরাজ’ তারেক রহমান যে লন্ডনে একজন ‘নেটিভ প্রিন্সের’ মতো দীর্ঘকাল ধরে বাস করছেন, তার পেছনে শুধু হাওয়া ভবনের টাকা নয়, কাজ করছে দলের কর্মকর্তার পদ বিক্রির অঢেল টাকা। তারেক রহমান লন্ডনে বাস করছেন বটে, কিন্তু দেশে তার দলে কে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদ পাবেন, সেটা তিনিই ঠিক করে দেন। মাতা পুত্রআজ্ঞা পালন করেন। দলের অনেক নেতা লন্ডনে এসেও ‘যুবরাজকে’ সেলামি দিয়ে যান। বিদেশে নিজ দলে কোন্দল থাকলে, পাল্টা গ্রুপ থাকলে একশ্রেণীর কেন্দ্রীয় নেতারও সুবিধা হয়। দুই গ্রুপ রেষারেষি করে তাকে সংবর্ধনা দেয়, সমাদরের প্রতিযোগিতা চালায়। দামী দামী উপঢৌকন দেয়। দুই গ্রুপের অর্থেই নেতার আরামদায়ক বিদেশ ভ্রমণ ঘন ঘন চলে। তাতে মূল সংগঠনের যে ক্ষতি হচ্ছে, দলের ভাবমূর্তি ধুলায় লুটাচ্ছে সেদিকে এই শ্রেণীর নেতাদের খেয়াল থাকে না। বাংলাদেশের আবহাওয়াই শুধু নয়, তার রাজনীতিও এখন দূষিত। এই দূষণ ক্রিয়া অব্যাহত থাকলে আইনের শাসন, দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার আপ্তবাক্য আউড়ে কোন লাভ হবে না। মানুষ রাজনীতিকে ঘৃণা করতে শুরু করবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থা হারাবে। তার সুযোগ নেবে গণবিরোধী অশুভ শক্তি। রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত এই ধুয়া তুলে পাকিস্তানে একবার জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা দখল করেছিলেন। অনুরূপভাবে বাংলাদেশে করেছিলেন জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ। এই দুই জেনারেলের আমলেÑ বিশেষ করে জেনারেল এরশাদের আমলে দুর্নীতি কম হয়নি। কিন্তু কথায় বলে মল খায় সব মাছে, দোষ পড়ে পাঙাসের ঘাড়ে, তেমনি সব আমলেরই দুর্নীতির দায় বহন করতে হয়েছে রাজনীতিকদের। ওবায়দুল কাদের রোগটা যখন ধরেছেন, তখন তা নিরাময়েরও একটা কার্যকর পন্থা বের করুন। আওয়ামী লীগ দেশের সব চাইতে বড় দল। এই দল যদি কঠোরভাবে আত্ম সংশোধনের পথ ধরে তাহলে অন্যান্য দলও তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হবে। আমাদের রাজনীতি যদি কলুষমুক্ত না হয়, তাহলে কোন উন্নয়ন দ্বারাই দেশের মঙ্গল সাধন করা যাবে না। লন্ডন ২১ মার্চ, মঙ্গলবার ২০১৭
×