ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সন্ত্রাসে জড়াচ্ছে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা যুবকরা, ৩১ জন নিখোঁজ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২২ মার্চ ২০১৭

সন্ত্রাসে জড়াচ্ছে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা যুবকরা, ৩১ জন নিখোঁজ

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নর-নারী ও যুবকদের একটি অংশ জঙ্গী সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছে। ইতোপূর্বে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তন্মধ্যে তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা ৩৩ হাজার। কিন্তু অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে লাখ লাখ। গেল বছরের অক্টোবর মাসে রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার পর এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজার অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। গত কয়েকমাসে টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্প, লেদা’র বস্তি ও উখিয়ার কুতুপালংয়ের ক্যাম্প থেকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার হদিস মিলছে না। এরমধ্যে অধিকাংশ যুবক। ইতোমধ্যে দেশে জঙ্গী সন্ত্রাসে লিপ্ত সংগঠনগুলোর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততার তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। মঙ্গলবার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে রোহিঙ্গাদের উধাও হয়ে যাওয়ার বিভিন্ন তথ্য। নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ আলম জানিয়েছেন, তার এলাকা থেকে ৭০ যুবক এলাকা ছেড়েছে। তবে এদের মধ্যে ছয় জনের কোন হদিস মিলছে না। অবশিষ্টরা অন্য স্থানে কাজ কর্মে রয়েছে বলে জানতে পেরেছেন। যাদের কোন হদিস মিলছে না তাদের মধ্যে রয়েছে মোঃ হোসনের পুত্র মোঃ রুবেল (২৩), শফিকুর রহমানের পুত্র মোঃ সালমান (২১), স্ত্রী রুবী আক্তার, জয়নাল আবেদিনের পুত্র মোঃ ইউনুস। তবে নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি এইচএম তৌহিদ কবির জানিয়েছেন, বাইশারি এলাকা থেকে ৩১ জন নিখোঁজ থাকার তথ্য থানার রেকর্ডে রয়েছে। অবশিষ্টদের ব্যাপারে তার কাছে কোন তথ্য নেই। গত রবিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার শহরের একটি আবাসিক হোটেলে গোপন বৈঠককালে ৬ রোহিঙ্গা জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। এছাড়া এর আগে টেকনাফে আনসার ক্যাম্পে হামলার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততা মিলেছে। উদ্ধার হয়েছে ওই ক্যাম্প থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ আরএসও, আল একিন ও বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দলনেতা নুর আলম টেকনাফের শালবন আনসার ক্যাম্পের কমান্ডার আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ইতোমধ্যে স্বীকার করেছে। টেকনাফের আনসার ক্যাম্পে হামলা ও অস্ত্র গোলাবারুদ লুটেরঘটনার পর ৬ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রেফতার হয়। এদের মধ্যে একজন আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়ার পর র‌্যাবের অভিযানে আরও কয়েক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রেফতার হয়। গেল ১০ জানুয়ারি নেপথ্যের ঘটনা উদঘাটিত হওয়ার পর অভিযানে একটি এসএমজি, ৬টি ম্যাগজিন, ১টি চাইনিজ রাইফেল ও ২টি এম টু রাইফেল উদ্ধার করে র‌্যাব। গত ১ মার্চ ভোর রাতে মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন নাইক্ষ্যংছড়ির তমরুর পশ্চিম পাহাড়ী এলাকা থেকে উদ্ধার হয় ৬টি অস্ত্র, ২টি ম্যাগজিন ও ৬ রাউন্ড গুলি। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে মিয়ানমার থেকে বহু আগে এবং গেল বছর থেকে এ পর্যন্ত পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা বিপুল। তবে অক্টোবর থেকে এসেছে প্রায় ৯০ হাজার। ’৯০ দশকে আসা মাত্র ৩৩ হাজার রোহিঙ্গাকে শরণার্থী হিসাবে তালিকাভুক্ত করে তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু গেল বছরের অক্টোবর থেকে নতুন করে যে ৯০ হাজার রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে এসেছে তাদের নাম নথিভুক্ত হয়েছে। কিন্তু শরণার্থী হিসাবে স্বীকৃত নয়। এদের নামমাত্র সামান্য মানবিক সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। তবে এদের অবস্থান শরণার্থী শিবিরে নয়। কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন অঞ্চলে এরা বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এলাকার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের এ দুর্বলতার সুযোগে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো মিয়ানমারের এসব বাসিন্দাদের বিশেষ করে যুবকদের জঙ্গী সন্ত্রাসে প্রলুব্ধ করছে। নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারি, তুমরু এলাকায় রোহিঙ্গা জঙ্গী সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা দিন দিন বাড়ছে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। গেল বছর বাইশারি বাজারে বোমা হামলা বৌদ্ধ ভিক্ষু ও আওয়ামী লীগ নেতা হত্যার ঘটনায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে পুলিশের ধারণা। উল্লেখ্য, বাইশারি এলাকাটি নাইক্ষ্যংছড়ির একটি ইউনিয়ন। এলাকাটি মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন। এ বাইশারিতে রোহিঙ্গা ছাড়াও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজনের বসবাস রয়েছে। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের জন্য টেকনাফ ও উখিয়ায় রেজিস্টার্ড দুটি ক্যাম্প রয়েছে। অনিবন্ধিত বস্তি রয়েছে আরও চারটি। এসব বস্তিকে স্থানীয় ভাষায় টাল বলা হয়। এছাড়া কক্সবাজার শহর এলাকা, নাইক্ষ্যংছড়ি ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গারা দিন দিন ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান নিচ্ছে। মিয়ানমারের আরএসও, আরএনও, এআরআইএফ ও এআরইউ ইত্যাদি নামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোতে রোহিঙ্গা সশস্ত্র ক্যাডাররা সম্পৃক্ত। বর্তমানে দেশে নব্য জেএমবির যে অপতৎপরতা শুরু হয়েছে এতে রোহিঙ্গা যুবকদের প্রলোভনে ফেলে ভেড়ানো হচ্ছে। আরএসও একাংশের সভাপতি রোহিঙ্গা মাস্টার আইয়ুব, আল একিনের সমন্বয়ক মৌলভী সফিকুর রহমান, মৌলভী নুর হোসেন, হাফেজ ছলাউল ইসলাম, মৌলভী আবদুর রহিম, আবু বক্কর, আবু তাহেরসহ বহু আরাকান বিদ্রোহী রোহিঙ্গা বর্তমানে এদেশে জঙ্গী সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী এলাকাটি বার্মাপাড়া নামে পরিচিত। এটি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য বলে স্থানীয়রা মনে করেন। এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অনেকে ইতোপূর্বে হরকাতুল জিহাদের সক্রিয় কর্মী হিসাবে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গা যুবকদের জঙ্গী সন্ত্রাসে উদ্বুদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত কয়েকজনের নামও জানা গেছে। এদের মধ্যে পাকিস্তান থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হরকাতুল জিহাদ নেতা মৌলভী আবদুল কুদ্দুস, মৌলভী হানিফ, শেখ নুর, দীন মোহাম্মদ ও তার সহোদর মৌলভী নুর মোহাম্মদের নাম জানা গেছে। নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারি ইউনিয়ন থেকে যে ৩১ যুবক নিখোঁজ রয়েছে এদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে বলে নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি এইচএম তৌহিদ কবির মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন।
×