ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাঠ্যবইয়ের ভুল শোধন- একদিনের কাজ মাসেও শেষ হয় না

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২২ মার্চ ২০১৭

পাঠ্যবইয়ের ভুল শোধন- একদিনের কাজ মাসেও শেষ হয় না

বিভাষ বাড়ৈ ॥ সমালোচনার মুখে প্রাথমিক স্তরের বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি দীর্ঘ দেড় মাস আগে সংশোধন করে ‘সংশোধনীপত্র’ তৈরি করেছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য কবিতাটির ভুল ও বিকৃত তথ্য সরিয়ে সংশোধনীপত্র তৈরি করে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলেও তা দেড় মাস ধরে পড়ে আছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। অথচ কেবল অনুমোদনের অভাবে এনসিটিবি সংশোধনীপত্র পাঠাতে না পাড়ায় ভুলে ভরা কবিতা পড়ছে শিশুরা। প্রতিষ্ঠানটির হতাশ কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন, এক ঘণ্টার একটা কাজের জন্য দেড় মাস ধরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, দেশজুড়ে বিতর্কের মুখে এনসিটিবি আলোচিত কবিতাটি বিশেষভাবে সংশোধনের এ উদ্যোগ নিয়েছিল বছরের শুরুতেই। সে অনুসারে কাজও এগিয়েছিল। তবে আদর্শ ছেলে কবিতাটি বিকৃতি সংশোধন হলেও এখনও সংশোধিত হয়নি অন্যান্য বইয়ের কয়েকটি ভুল। ফলে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্যবই ‘হিন্দু ধর্মশিক্ষা’ বইয়ের পেছনে লেখা ‘উড় হড়ঃ ঐবধৎঃ অহুনড়ফু’, প্রথম শ্রেণীর বইয়ে ছাগলকে গাছে চড়িয়ে আম খাওয়া, ও-তে ওড়নার মতো ভুলগুলোর সংশোধন নিয়ে। তবে সংশোধনী নিয়ে যারা কাজ করেন সেই কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রণালয় বইয়ে সাম্প্রদায়িকীকরণ ও ভুলের দায় আমাদের ওপরই চাপিয়েছে সব সময়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হওয়া ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটির সংশোধনী পাঠালেও তা অনুমোদন না দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। বিষয়টির দ্রুত সুরাহা চান কর্মকর্তারা। এদিকে একটি বইয়ের লেখা চূড়ান্ত হওয়ার আগে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞের হাত দিয়ে তা এলেও এবারও বইয়ে রয়েছে ভুলের ছড়াছড়ি। এমনও হয়েছে, যে কবিতা এক বছর আগে সঠিক ছিল এবার এসব ব্যক্তির বদৌলতে ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যার একটি হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি। এতদিন বইয়ে ঠিকভাবে থাকলেও এবার বেশ কয়েটি লাইন বিকৃত হয়েছে। মূল কবিতায় আছে ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’। আর বইয়ে ছাপা কবিতায় লেখা হয়েছে ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে?’ এছাড়া ‘মানুষ হইতে হবে- এই তার পণ’ এর বদলে লেখা হয়েছে ‘মানুষ হতেই হবে’। বিকৃতি কেবল এটুকুই নয়, কবিতার চতুর্থ লাইনে কুসুমকুমারী লিখেছেন, ‘মানুষ হইতে হবে’Ñ এই তার পণ। বিকৃত কবিতায় ‘হইতে’ শব্দটিকে ‘সম্পাদনা’ করে ‘হতেই’ লিখেছেন পাঠ্য রচয়িতারা। এনসিটিবির প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ে নানা ভুল আর অসঙ্গতি নিয়ে চলতি বছর সারাদেশে বিতর্কের ঝড় ওঠে। বিষয়টি নিয়ে বিপাকে পড়ে শিক্ষা এবং প্রাথমিক মন্ত্রণালয় ছাড়াও এনসিটিবি। পরে তড়িঘড়ি করে আলাদা দু’টি তদন্ত কমিটি করা হয়। এনসিটিবির তদন্ত কাজ শেষ হওয়ার আগেই দুই কর্মকর্তাকে ওএসডি ও তদন্তকাজ শেষে গ্রাফিক্স ডিজাইনারকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, ঘটনার আসল নায়কদের রক্ষা করে কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রুহি রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির মেয়াদ কয়েক দফায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাঠ্যবই কেলেঙ্কারির মূল হোতা শনাক্তে সাত কার্যদিবস মেয়াদের এ কমিটি পুরো দুই মাস সময়ক্ষেপণ করলেও নতুনভাবে আর কাউকে শনাক্ত করেনি। এ কারণে তদন্ত কাজ নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। যদিও অতিরিক্ত সচিব রুহি রহমান বলেছেন, এনসিটিবি যাদের অভিযুক্ত করেছে তাদের অবহেলায় এমন ভুল হয়েছে। আমরা নিবিড়ভাবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছি। পাশাপাশি পররর্তী বছরগুলোতে এমন ভুল যেন আর না হয় সে বিষয়েও তদন্ত প্রতিবেদনে পারামর্শ দেয়া হয়েছে। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেছেন, প্রতিবছর বইয়ের মধ্যে বিভিন্ন ভুল ধরা পড়ে। পরবর্তী বছর আবার নতুন বই করার সময় তা পরিমার্জন করা হয়। তাই বানান ভুল ও অসঙ্গতিগুলো চলমান প্রক্রিয়ায় সংশোধন করা হচ্ছে। তবে শুধু কুসুমকুমারী দাশের কবিতাটি বিশেষভাবে সংশোধন করে পাঠানো হবে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা সংশোধনীপত্র স্কুলে স্কুলে পাঠিয়ে দেবেন। শিক্ষকরা সে অধ্যায় পড়ানোর সময় সংশোধন কপি দেখে পড়াবেন। সেভাবেই কাজ করা হচ্ছে। তবে প্রাথমিক স্তরের বইয়ের দায়িত্ব যার কাছে এনসিটিবির সেই সদস্য (প্রাথমিক) অধ্যাপক সরকার আবদুল মান্নান অভিযোগ করেছেন, আমরা অনেক আগেই শিশুদের জন্য সংশোধনীপত্র তৈরি করেছিলাম। দেড় মাস আগে আমরা সংশোধনীপত্র তৈরি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সেখান থেকে কোন সাড়া মিলছে না। এ সদস্য বলছিলেন, তারা যদি বলত ঠিক আছে আপনারা এটা পাঠিয়ে দেন সারাদেশে তাহলে আমরা এতদিনে তা করতে পারতাম। কিন্তু যে কাজ এক ঘণ্টার, কেবল একটি অনুমোদন দিলেই আমরা সারাদেশে পাঠাতে পারি। এটা কেন হচ্ছে? আপনারা কোন তাগাদা মন্ত্রণালয়ে দিয়েছেন কিনা? এমন প্রশ্নে এ কর্মকর্তা বলেন, কেবল একবার না দুইবার আমরা সংশোধনীপত্র পাঠিয়ে তাগাদা দিয়েছি। একবার পাঠিয়েছি। সাড়া না পাওয়ায় যোগাযোগ করা হলে আবার পাঠাতে বলা হয়। পরে আবার পাঠিয়েছি। কিন্তু কোন খবর নেই। অভিযোগের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার কাছে এটা আসেনি। তবে অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি। গিয়াস উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মনে হয় দেড় মাস হবে না। এক সপ্তাহের একটু বেশি হতে পারে। এনসিটিবির দুইবার তাগাদা দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, আসলে আমরা তদন্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এজন্য সামান্য দেরি হয়েছে। এদিকে শিক্ষক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই দ্রুত ভুল সংশোধনের দাবি তোলা হয়েছে। শিক্ষকরা বলছেন, পাঠ্যবইয়ে ভুল নিয়ে আমরা বিপাকে রয়েছি। কোনটি ভুল আর কোনটি শুদ্ধ, ক্লাসে পড়ার সময় সংশয়ে থাকতে হয়। দ্রুত পাঠ্যবইয়ের ভুলগুলো সংশোধনের দাবি জানান তারা। সিলেবাস না পেয়ে সঙ্কটে লাখ লাখ শিক্ষার্থী সিলেবাস না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন নবম ও একাদশ শ্রেণীর ২৫ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণীকক্ষে পাঠদান করছেন শিক্ষকেরা। জানা গেছে, শিক্ষাবর্ষ শুরুর আড়াই মাস পরেও সিলেবাস দিতে পারেনি এনসিটিবি। চলতি শিক্ষাবর্ষে নবম স্তরের ২৩ লাখ ৭৫ হাজার শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেয়া হয়েছে। বর্তমানে নবম শ্রেণীর বাংলা এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষাবর্ষের শুরুতে সিলেবাস ঠিক করে দেয় এনসিটিবি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নবম ও দশম শ্রেণীর বাংলা সাহিত্য বইয়ে ৩০টি গদ্য ও ৩১টি কবিতা আছে। এর মধ্যে ১৫টি গদ্য ও ১৫টি কবিতা নবম শ্রেণীর জন্য ঠিক করে সিলেবাস দেয়ার কথা এনসিটিবির। ওই সিলেবাস অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা পড়েন। কিন্তু এখনও সিলেবাস বিদ্যালয়গুলোতে যায়নি। রাজধানীর স্কুলগুলোর প্রথান শিক্ষকরা ইতোমধ্যেই বলেছেন, সিলেবাস না পাওয়ায় অভিজ্ঞতা থেকে অনুমানের তারা গল্প- কবিতা পড়াচ্ছেন। যেগুলো পড়ানো হচ্ছে, তা সিলেবাসে না থাকলে নবম শ্রেণীতে কাজে লাগবে না। সময়টা নষ্ট হবে। অথচ নবম শ্রেণী থেকেই এসএসসির প্রস্তুতি শুরু হয়। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এনসিটিবির কারণেই এই দেরি হচ্ছে। তবে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, তারা আগেই কাজ করেছেন। মন্ত্রণালয়ের কাজে গতি নেই। এদিকে এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেবাসের একটি প্রস্তাব তৈরি করে তারা অনুমোদনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় কিছু ব্যাখ্যা চেয়েছে। এখন ব্যাখ্যা ঠিক করা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করা হলে এক যুগ্ম সচিব বলেন, আসলে এবার বইয়ের ভুলের সংশোধনী ও এ সংক্রান্ত কাজ নিয়েই সকলে ব্যস্ত ছিলেন। এতেই সময় বয়ে যায়। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সিলেবাস চূড়ান্ত করা হবে। এ কর্মকর্তা জানান, সিলেবাস চূড়ান্ত হলে দ্রুত তা জানানোর সকল পদক্ষেপ দেয়া হবে।
×