ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মরুর জাহাজ উট

ঘোড়ায় চালিত গাড়ি, যোগাযোগে দুর্ভোগ কমেছে চরবাসীর

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২২ মার্চ ২০১৭

ঘোড়ায় চালিত গাড়ি, যোগাযোগে দুর্ভোগ কমেছে চরবাসীর

সমুদ্র হক ॥ যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে চরের জাহাজ হয়েছে ঘোড়ায়চালিত বিশেষ ধরনের এক গাড়ি। মরুর জাহাজ উটের পথ ধরে চরের জাহাজ হয়েছে ঘোড়া। অস্তিত্ব রক্ষায় চরের মানুষ ঘোড়ায়চালিত এমন গাড়ি উদ্ভাবন করেছে। যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মার চরে এমন গাড়ি চোখে পড়ে। ঘোড়া শক্তি দিয়ে যাত্রী ও পণ্যবোঝাই গাড়ি টেনে নিয়ে যায়। এই গাড়ির নাম চরের মানুষ দিতে পারেনি। শুধু ডাকে চরের ঘোড়া। তাতেই বুঝে নেয় ঘোড়ার গাড়ি। চরে এই গাড়ি থাকায় মানুষের দুর্ভোগ অনেক কমেছে। এখন আর উত্তপ্ত বালির ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ চর পাড়ি দিতে হয় না। হেঁটে দূরের হাটবাজারে পণ্য নিয়ে যাওয়ার কষ্ট দূর হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের পালায় দিনে দিনে নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ঘোর বর্ষা মৌসুমেও অনেক চর ডুবে যায় না। বগুড়ার সারিয়াকান্দি ধুনট সোনাতলায় যমুনা ও বাঙালী নদী, লালমনিরহাট নীলফামারীতে তিস্তা, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ধরলা, ময়মনসিংহ জামালপুরে ব্রহ্মপুত্র, রাজশাহীতে পদ্মার তীরে গেলে যতদূর চোখ যায় দৃষ্টিতে পড়ে শুধুই বালিচর। গ্রীষ্মে এই চরের বালি যেমন আগুনে উত্তপ্ত হয়ে থাকে শীতে এই বালি হয়ে পড়ে বরফের মতো। চরের মানুষ পায়ে ফোস্কা নিয়ে পাড়ি দেয়। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টি চর এলাকা। বর্তমানে যে হারে চর পড়ছে তাতে আরও দু’য়েকটি ইউনিয়ন বালিয়াড়িতে ঢাকা পড়তে যাচ্ছে। সারিয়াকান্দি সদর থেকে নৌপথে সহজে এখন আর চরে যাওয়াও যায় না। এক চরের পর কিছুটা পানি তারপর ফের চর। চর ট্রানজিটে পাড়ি দিতে হয় পায়ে হেঁটে। উৎপাদিত পণ্য বিপণনের জন্য হাটবাজারে নিয়ে যেতে যারপর নেই পোহাতে হয় দুর্ভোগ। অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। চরে গরুর গাড়ি সহজে চলে না। গরুর গাড়ি গ্রামের মাটির কাঁচা সড়কে যতটা সহজে চলতে পারে চরের চিকন বালির ওপর দিয়ে গরু সেভাবে টানতে পারে না। গরুর শক্তি ঘোড়ার চেয়ে কয়েকশ’ গুণ কম। এমন অবস্থায় চরের মানুষের জীবনযাপন যখন চরম দুর্বিষহ তখন বিশেষ ধরনের ঘোড়ার গাড়ি তা দূর করে দিয়েছে। ঘোড়ার শক্তিকে রূপক করে ইঞ্জিনের শক্তিকে আজও বলা হয় ‘হর্স পাওয়ার’। ঘোড়ার শক্তিকেই কাজে লাগিয়েছে চরের মানুষ। কাজলা চরের আবুল কালাম বললেন, মোটর গাড়ির চাকার পুরানো টায়ার, রিং আনুষঙ্গিক জিনিস ঠিকঠাক করে বাঁশ কাঠের কাঠামোর সঙ্গে এঁটে দিয়ে অনেকটা গরুর গাড়ির আদলে ঘোড়াচালিত গাড়ি তৈরি করেন। যমুনার ওপারে জামালপুরের মাদারগঞ্জ হাট থেকে ঘোড়া কিনে আনেন। তারপর গাড়ির সঙ্গে এক ঘোড়াজুড়ে চরের ওপর দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে পরিবহন করেন যাত্রী ও উৎপাদিত পণ্য। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে প্রতিবার অন্তত দশ মণ (৪০ কেজিতে এক মণ হিসাবে) করে পরিবহন করা যায়। উৎপাদিত ফসল ও নানা পণ্য চরের ওপর দিয়ে এভাবে পরিবহন করে নিয়ে যান দূরের হাটবাজারে ও দূরে কোথাও। বোহাইল গ্রামের আফজাল বললেন তার ঘোড়া গাড়ি এক চর থেকে আরেক চরে লোকজন নিয়ে যায়। মোটরের টায়ারের চাকায় ঘোড়া তার শক্তিতে চরের ওপর দিয়ে দ্রুতই টানতে পারে। ঘোড়া গাড়ি চালিয়ে চরের অনেক মানুষ রোজগারের বাড়তি আয় খুঁজে পেরেছে। চালুয়াবাড়ির মনসুর আলী বললেন ঘোড়াসহ তার গাড়ি তৈরিতে খরচ পড়েছে ৩৫ হাজার টাকা। ঘোড়ার কদর কমে যাওয়ায় ঘোড়ার দামও এখন কম। একদার ঘোড়ায় চালিত টমটম গাড়িও প্রায় উঠেই গিয়েছে। ঘোড়ার খাবারের যোগান দিতে না পাড়ায় কেউ ঘোড়া পালন করে না। ঘোর সওয়ার, কোচওয়ানদের সংখ্যা অনেক কমেছে। শহরের কোন র‌্যালি কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে কেউ শখ করে টমটম ভাড়া করে আনে। বোঝা টানার জন্য চরে যে শক্তির গরু দরকার তা মেলে না। তাছাড়া গরুর গাড়ির জন্য দুই গরু দরকার। দামও বেশি। চরের ওপর দিয়ে এক ঘোড়া যে পরিমাণ বোঝা বহন করতে পারে এক জোড়া শক্তিশালী গরু তা পারে না। যে কারণে চরের যোগাযোগে ঘোড়ার গাড়ি বড় ভূমিকা রাখছে। লোকজন বলতে শুরু করেছে চরের জাহাজ ঘোড়ার গাড়ি। যমুনায় এখনও যে কয়টি খেয়া ঘাট টিকে আছে খেয়া পারাপারের পর লোকজন খোঁজে চরের ঘোড়া গাড়ি। এই গাড়িগুলো আশপাশেই থাকে। লোকজন দেখলেই বাসের কন্ডাকটরের মতো হাঁক দেয়। বড় ঘোড়া গাড়িতে ১০-১২ জন যাত্রী বসতে পারে। ছোট ঘোড়া গাড়িতে বসতে পারে ৬-৭ জন। মালামাল পরিবহন করতে পারে ১০-১২ মণ। ঘোড়া গাড়ি বড় হলে আরও ২/-১ মণ বেশি মালামাল বহন করতে পারে। একটা সময় রেলস্টেশনের কাছে ঘোড়ায়চালিত টমটম গাড়ি থাকত। বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র যমুনার চরের পারাপারে থাকে ওই ঘোড়ার গাড়ি। সারিয়াকান্দি থেকে অনেকটা দূরের ধারাবর্ষা চরের লোকজনের কথাÑ মোটরগাড়ির চাকার এই ঘোড়া গাড়ি চরে আসায় যোগাযোগের যে সমস্যা ছিল তা অনেকটাই দূর হয়েছে। তারা এখন ব্যবসা-বাণিজ্যে পণ্য পরিবহনে, বিয়ে-শাদীসহ সামাজিকতায় অনুষ্ঠানে চরের ঘোড়ায়চালিত গাড়ির ওপর নির্ভরশীল। দেশে ঘোড়ার সংখ্যা কমে যাওয়ার পরও চরের যাত্রী ও পরিবহনে ঘোড়াকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। ঘোড়ার শক্তি বলে কথা!
×