ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পরিশ্রমী নারী

ক্ষেতের আলু তুলে সংসারে সচ্ছলতা, চাষীরাও ব্যস্ত

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২১ মার্চ ২০১৭

ক্ষেতের আলু তুলে সংসারে সচ্ছলতা, চাষীরাও ব্যস্ত

শংকর লাল দাশ ॥ অঞ্জলী, শেফালি, প্রতিমা, নূরজাহান, কোহিনূর এরা কেউ তীব্র অভাবী পরিবারের মেয়ে কিংবা বধূ নন। কারও কাছে হাত পাততে হয় না। তবুও তারা মাঠে নেমেছেন। দিনভর ক্ষেতে আলু তোলার কাজ করেন। বিনিময়ে প্রত্যেকে মাথাপিছু দৈনিক ১০ কেজি করে আলু পান, যা সংসারে আরও সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনছে, দিচ্ছে বাড়তি সচ্ছলতা। তাদের আরও স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করছে। তাদের মতো আরও কয়েক শ’ নারী এ মুহূর্তে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মাটির নিচ থেকে গোলআলু তোলার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তাদের কাজ করার এ দৃশ্য পাল্টে দিয়েছে এলাকার চিরায়ত প্রথা, যা সমাজ-সংসারে এগিয়ে দিচ্ছে পরিশ্রমী এই নারীদের। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার কয়েকটি গ্রামে এবার চার শ’ হেক্টরেরও বেশি জমিতে গোল আলুর চাষ হয়েছে। স্থানীয় কৃষি বিভাগের মতে, এবার উৎপাদনের পরিমাণ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে। টাকার অঙ্কে যা ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকায় বিক্রি হবে। উপজেলা শহর সংলগ্ন মুরাদনগর, উত্তর বোয়ালিয়া, দক্ষিণ বোয়ালিয়া, পক্ষিয়া, চরখালীসহ কয়েকটি গ্রামে এ মুহূর্তে ক্ষেত থেকে আলু তোলার ভর মৌসুম চলছে। প্রতিদিন ট্রলার-ট্রাক ভর্তি আলু যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন মোকামে। আলুচাষীরা তাই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, আলু চাষীদের প্রচ- ব্যস্ততার নানান খ-চিত্র। তারা মহাজনদের সঙ্গে দরদাম করছেন। টাকা গুনছেন। মোবাইল ফোনে মোকামে কথা বলছেন। হিমাগারের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে। কেউ কেউ আলুর স্তূপ ওজন করছেন। বস্তায় ভরছেন। এমন অসংখ্য খ-চিত্রের মাঝেই দেখা গেল ভিন্নতর দৃশ্য। ক্ষেতের মাটির নিচ থেকে আলু তোলার কাজটি কেবল নারীরাই করছেন। নারীরা আবার সাজি-ডালা ভর্তি করে আলুর স্তূপ দিচ্ছেন। মাটির নিচ থেকে আলু তোলার আগে পুরুষরা কেবল লাঙল দিয়ে মাটি আলগা করে দিচ্ছেন। আর বাকি সব কাজ নারীরাই করছেন। নারীদের আবার বেশির ভাগই গৃহবধূ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ক্ষেতে নারী শ্রমিকদের অধিকাংশ তেমন অভাবী পরিবারের নন। হাতে গোনা দুই চারজন অভাবী। বাকিরা মোটামুটি সচ্ছল। আর কিছু না হোক দুই বেলা খেয়ে পড়ে ভাল আছেন। পরিবারে তেমন অভাব না থাকা সত্ত্বেও নারীদের ক্ষেতে কাজ করার এ চিত্র স্বাভাবিক কারণে যে কাউকে কৌতূহলি করে তোলে। আর সে কৌতূহলের জবাব দিতে গিয়ে দক্ষিণ বোয়ালিয়া গ্রামের গৃহবধূ প্রতিমা রানী পাল জানান, তাদের যে জমিজমা আছে, তাতে বছরের খোরাকী হয়ে যায়। এরপরেও স্বামী যখন যা পান, সে কাজ করেন। তিনি ছেলেমেয়ে দেখাশোনাসহ ঘরসংসারী করেন। বাড়ির পাশের জমিতে চাষী আলু চাষ করেছে। বহু দূরের গ্রাম থেকে নারীরা এসে তার বাড়ির পাশের ক্ষেতে কাজ করছে দেখে তিনিও নেমে পড়েছেন। এতে তার কোন লজ্জা নেই। দুই সন্তানের জননী আনোয়ারা বেগম জানান, রান্নাবান্না সেরে সকালে ক্ষেতের কাজে আসেন। দুপুরে ভাত খেতে বাড়ি যান। আবার বিকালে এসে সন্ধ্যায় ফিরে যান। এতে সংসারের কাজে কোন সমস্যা হয় না। তাই তিনি আলু তোলার কাজ করেন। কোলে ৭-৮ মাসের বাচ্চা নিয়ে ক্ষেতে আসা মনোয়ারা বেগম জানান, দৈনিক ১০ কেজি আলু পান। এভাবে দেড়-দুই মাস ক্ষেতে কাজ করে চার-পাঁচ শ’ কেজি আলু পাবেন। এতে গোটা বছরে যেমন আলু কিনতে হবে না। আবার অন্তত দেড়-দুই শ’ কেজি আলু বিক্রি করে হাতে কিছু টাকাও আসবে। যা সংসারে সহায়তা করবে। বিশ-বাইশ বছরের গৃহবধূ অঞ্জলি রানী জানান, গত বছর আলু তুলে প্রায় আট হাজার যোগাড় করেছেন। এবার তার চেয়ে বেশি আয় করবেন। যা দিয়ে তিনি দুধেল গাই কিনবেন। এতে সংসারে দুধের চাহিদা মিটবে। দুপুরের কড়া রোদে ঘাম ঝড়িয়ে দিয়েছে। তবু ক্লান্তি নেই চায়না নামের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রীর। দুই হাতে আলু তুলে যাচ্ছিল। সে জানায়, ৫-৬ দিন ধরে মায়ের সাথে আলু তোলার কাজ করছে। তার ইচ্ছে মজুরির আলু বিক্রি করে নতুন জামা কিনবে। আলুচাষী মোঃ বাবুল জানান, তিনি প্রায় ৬ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করেছেন। তার ক্ষেতে ১৮-২০ জন নারী কাজ করছেন। পুরো ক্ষেতের আলু তুলতে অন্তত ১৫-২০ দিন লেগে যাবে। এরপরই এ নারী শ্রমিকরা আবার অন্য ক্ষেতে যাবে। শফি কেরানী জানান, আলু তোলার কাজে পুরুষদের তুলনায় নারীদের মজুরী কম। তারপরও তারা কাজ করেন বেশি। তাই তারা নারীদের দিয়ে এ কাজটি করান। মজুরি বৈষম্য যাই থাক আলু তোলার মধ্যে দিয়ে বহু নারী মাত্র দেড় দুই মাসেই আরও অনেকটা স্বাবলম্বী হচ্ছেন, হাতে টাকা-পয়সা গুনতে পারছেন, এটি তাদের অনেক বড় পাওয়া। এর বাইরে সংসারের কাজেও সে অর্থ কাজে লাগছে, এটিকেই বড় ভাবছেন অনেক। এর মধ্যে দিয়ে এলাকার চিরায়ত প্রথা তথা নারীরা ঘরেই বন্দী থাকবে, এ ধারণাও ভেঙ্গে পড়ছে, এটিকে ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছেন পুরুষরাই-যা সমাজকে নিঃসন্দেহে এগিয়ে নিচ্ছে।
×