ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশেষজ্ঞদের অভিমত

ভূগর্ভের পানি অধিকহারে উত্তোলনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২১ মার্চ ২০১৭

ভূগর্ভের পানি অধিকহারে উত্তোলনে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটতে পারে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীবাসীর পানি প্রাপ্তির অন্যতম প্রধান উৎস ও ভরসাস্থল এখন ভূগর্ভস্থ স্তরের পানি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকহারে ভূগর্ভস্তরের পানি উত্তোলন প্রতিবছর ভূগর্ভস্তরের পানি নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে ভূগর্ভস্তরে ভারি ধাতু ও শিশার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াসহ ভূগর্ভস্তরের পানিও অধিকহারে দূষিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ওয়াসা বলছে, ঢাকা শহরের চাহিদার ৮৬ ভাগ পানি ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে যোগান দেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানান, ভূগর্ভস্তরের পানি অধিকহারে উত্তোলনের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও সৃষ্টি করতে পারে। এ বিষয়ে পানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম আশরাফ আলী বলেন, স্বাভাবিক নিয়মে ভূগর্ভস্থ পানির যে স্তরটুকু খালি হয় তা পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিকভাবেই পূরণ হওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকাসহ আরও কিছু এলাকায় তা হচ্ছে না। ভূগর্ভের পানি শুধু কমছেই বাড়ছে না। আগে থেকে অপরিকল্পিত ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে অতিমাত্রায় নলকূপ বসিয়ে ইচ্ছামতো পানি তোলায় এমন অবস্থা হয়েছে যে এখন আর পানি নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়েও পানি সঠিকভাবে নিরাপদ করা যাচ্ছে না মূলত মারাত্মকভাবে নদী দূষণের কারণে। এছাড়া বিভিন্ন দূষিত পদার্থের উপস্থিত কারণে গভীর নলকূপের পানিও এখন আর নিরাপদ থাকছে না ভূগর্ভস্ত পানি নেমে যাওয়ায়। সেখানে নানা ধরনের দূষিত পদার্থ পানি স্তরের জমা হয়ে স্তরকে দূষিত করে ফেলছে। এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ পরিচালিত ওয়াটার কোয়ালিটি টেস্টিং ল্যাবরেটরির এক গবেষণায় বলা হয়েছে বাংলাদেশের অধিকাংশ নলকূপের পানিতে ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও মাঙ্গানিজ নামের ভারি ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভারি এ ধাতুটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাটির নিচে পানির স্তরে ভারি ধাতুর উপস্থিতির কারণেই তা পানে অযোগ্য হয়ে পড়ছে দিনদিন। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর সমুদ্রের পানির উচ্চতার চেয়ে ৩-১০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে যায়। ভূগর্ভ থেকে প্রতিবছর যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে তা বৃষ্টি ও বন্যার মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে না। সম্প্রতি গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বঙ্গোপসাগরের পানির গড় উচ্চতার তুলনায় নিচে নেমে যাওয়ার কারণে সাগরের লোনা পানি অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে ঢাকা শহরের ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এখনই এ বিষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে তাহলে আগামী এক থেকে দেড় দশকে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ভূগর্ভের ফাঁকা জায়গা প্রাকৃতিক নিয়মে পূর্ণ করবে সমুদ্রের লোনা পানি। রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় দেখা দেবে সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার এক প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকা শহরের পানির স্তর এখন সাগরের চেয়ে ১৭০ ফুট এবং রাজশাহীতে ১৮ থেকে ২৯ ফুট নিচে চলে গেছে। ফলে সাগরের লোনা পানি দক্ষিণাঞ্চল পার হয়ে এখন ঢাকা মহানগরীসহ দেশের মধ্যাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের দিকে আসছে। অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে ঢাকার পানিতে লবণাক্ততা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, রাজধানী ঢাকাসহ প্রাকৃতিকভাবে যেসব এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপদ সুপেয় পানির উৎস ছিল, অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে সে জায়গাগুলোতেও বর্তমানে পানি সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। এ সঙ্কট মানবিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য পানির অপচয়, দূষণরোধ ইত্যাদির প্রতি মনোযোগী হতে হবে এখনই। এ সঙ্কট মোকাবেলায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। এজন্য ভূ-উপরিস্থ পানির উৎসগুলোকে আরও শক্তিশালী বা সমৃদ্ধশালী করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় ঢাকাতে প্রতিনিয়ত মানুষের চাপ বেড়েই চলেছে। ফলে অন্যান্য চাহিদার পাশাপাশি এ বিশাল জনসংখ্যার জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরে পানির চাহিদা মেটাতে ৮৬ ভাগ পানি ভূগর্ভস্থ থেকে তোলা হচ্ছে। নদীর পানি এত পরিমাণ দূষিত হয়ে পড়ছে যে এই পানি বিশুদ্ধ করে সাপ্লাই করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়াও সম্প্রতি গবেষণায় নদীর পানিতে ভারি ধাতব পদার্থের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। ফলে শোধন করে পানি বিশুদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমাগত। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছে এভাবে ভূগর্ভের পানির ওপর চাপ বৃদ্ধি পেলে আগামীতে ভূগর্ভস্থ পানিতে ভয়ানক দূষণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এছাড়াও পানি বেশি মাত্রায় নিচে নেমে গেলে আগামীতে চাহিদার প্রয়োজনীয় পানিও সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীবাসীর পানি চাহিদা রয়েছে ২২০ থেকে ২৩০ লিটার। ঢাকা ওয়াসা এই পানি সরবরাহ করছে। তবে ওয়াসার এ পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ ও ময়লা আবর্জনা থাকার অভিযোগ রাজধানীবাসীর দীর্ঘদিনের। তারা অভিযোগ করছেন দীর্ঘ সময় ধরে ফুটিয়ে এসব পানি দুর্গন্ধমুক্ত করে পানযোগ্য করা যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির ১৪ ভাগ আসছে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার থেকে শোধন করে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আর পানি ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা থেকে এনে শোধন করা হচ্ছে। তবে নদীর দুটির দূষণ পরিস্থিতি এতই অবনতি হয়েছে যে তা শোধন করেও পানযোগ্য করা যাচ্ছে না।
×