ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি শুরু, নতুন রং লেগেছে চারুকলায়

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২০ মার্চ ২০১৭

মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি শুরু, নতুন রং লেগেছে চারুকলায়

মনোয়ার হোসেন ॥ চলছে বাংলা পঞ্জিকার শেষ মাস চৈত্র। বাজছে নতুন বঙ্গাব্দের আগমনী বার্তা। ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে নতুন বাংলা বছর ১৪২৪ বঙ্গাব্দ বরণের নানামুখী তৎপরতা। সেই সুবাদে নতুন রং লেগেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। শিল্পাচার্য জয়নুলের স্মৃতিধন্য সবুজ-শ্যামল আঙিনায় বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। নববর্ষের মাসখানেক আগেই যেন এখানে হাজির হয়েছে পয়লা বৈশাখ। বাঙালীর প্রাণের উৎসবকে বরণ করতে সচল হয়েছে শিল্পীর রং-তুলির আঁচড়। ছড়িয়েছে প্রাণে দোলা দেয়া ঢাক-ঢোলের মুখরিত শব্দধ্বনি। আর এসব কিছুর মধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে কল্যাণের বারতা দেয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি। এবারও অনুষদের চারুশিক্ষার্থী ও শিক্ষক শিল্পীদের নিবিড় প্রয়াসে বের হবে এই শোভাযাত্রা। অশুভকে হটিয়ে মঙ্গলালোকে সিক্ত হবে লাল-সবুজের বাংলাদেশÑসেই প্রত্যাশায় রবিবার থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি পর্বের সূচনা হয়। অন্য যে কোন বছরের চেয়ে এবারের শোভাযাত্রা হবে আরও বেশি তাৎপর্যময়। এর নেপথ্যে রয়েছে গত বছর ইউনেস্কোর স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। তাই এবারের শোভাযাত্রা হবে আরও বেশি রূপময়। বরাবরের মতো বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সকল অনুষঙ্গই যুক্ত হবে নববর্ষ উদ্্যাপনের সবচেয়ে বেশি রং ছড়ানো এ আয়োজনে। তবে এখনও নির্ধারিত হয়নি শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য বা বিষয়। একইভাবে শোভাযাত্রার মূল অনুষঙ্গ শিল্প কাঠামোর সংখ্যাও নির্ধারণ হয়নি। এসব নিয়ে চলছে ভাবনা। এরই মাঝে শোভাযাত্রার খরচ তুলতে শুরু হয়ে গেছে অর্থ সংগ্রহের কাজ। আগামী ১৩ এপ্রিল, চৈত্রসংক্রান্তির দিন পর্যন্ত চলবে এ প্রস্তুতি পর্ব। রবিবার চৈত্রের দুপুরে চারুকলা অনুষদে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে ছবি আঁকাআঁকির দৃশ্য। শোভাযাত্রার ব্যয় মেটাতে চারুশিক্ষার্থীরা টেবিলে ছড়িয়ে দিয়েছে রংয়ের কৌটা। সেগুলো থেকে রং তুলে চলছিল চিত্রকর্ম সৃজন। এই শিল্প সৃজনের মাঝে কথা হয় অনুষদের অঙ্কন বিভাগের শিক্ষক শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামীর সঙ্গে। তিনিই জানান, প্রতিবছরের মতো এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রার খরচ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা নিজেদের শিল্পকর্ম বিক্রি করে সংগ্রহ করবেন। আর সে পর্বের সূচনা করেছেন অধ্যাপক রফিকুন নবী। তিনিসহ অধ্যাপক সৈয়দ আবুল বারক্্ আলভী, শিশির ভট্টাচার্যও ছবি এঁকেছেন। এছাড়া আর দুই-তিন দিন পরে শিক্ষার্থীরা সরাচিত্র আঁকা শুরু করবেন। সে সঙ্গে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে শিল্পকাঠামো তৈরি করা হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতির উদ্বোধন করেন বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন চারুকলা অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক সৈয়দ আবুল বারক্্ আলভী, ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য, অনুষদের শিক্ষক শহীদ কাজী, বিশ্বজিৎ গোস্বামী প্রমুখ। এ সময় বেজে ওঠা ঢাক-ঢোলের বোলের তালে ছবি আঁকেন শিক্ষক শিল্পীরা। সেই শব্দের স্ফুরণের মাঝেই উপস্থিত সবার কপালে মাখিয়ে দেয়া হয় আবিরের তিলক। এছাড়াও উৎসবের অংশ হিসেবে মুড়ি-মুড়কি ও খৈ-বাতাসা দিয়ে করানো হয় মিষ্টিমুখ। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে চারুকলা অনুষদের ১৮ ও ১৯তম ব্যাচ। মুখোশ, সরাচিত্র, চিত্রকর্ম, শোভাযাত্রার শিল্পকাঠামো প্রভৃতি অনুষঙ্গ নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এসব ব্যাচের শিক্ষার্থীদের। ভাগাভাগি করা এই কাজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছেন সাগর হোসেন সোহাগ, পলাশ সাহা, আরিফ সিদ্দিকী নিটোল ও সবুজ দাস। এসব দেখতে দেখতে কথা হলো শিল্পী রফিকুন নবীর সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, যেহেতু মঙ্গল শোভাযাত্রা বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে তাই এবারের আয়োজনে ভিন্ন মাত্রা যোগ করার প্রচেষ্টা থাকবে। আশা করছি, শোভাযাত্রাটি আরও বর্ণাঢ্য ও বিস্তৃত হবে। সর্বসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণও বাড়বে। আপাতত ছবি আঁকার মাধ্যমে শোভাযাত্রার প্রাথমিক সূচনা হলো। সেই সঙ্গে অর্থ সংগ্রহের কাজটিও শুরু হলো। পরবর্তীতে মুখোশসহ আরও অনুষঙ্গ তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে বিশাল এ কর্মযজ্ঞের ব্যয় তুলে আনা হবে। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তারপরও নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে অতিক্রমের চেষ্টা রয়েছে। এবারের শোভাযাত্রার অনুষঙ্গ প্রসঙ্গে শিল্পী বলেন, মূলত এদেশের লোকজ সংস্কৃতির রকমারি অনুষঙ্গকে প্রাধান্য দিয়ে বের হবে ১৪২৪ বঙ্গাব্দের মঙ্গল শোভাযাত্রা। নিরাপত্তার বিষয়ে রফিকুন নবী বলেন, আমাদের চারপাশে নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে। তাই এবারের শোভাযাত্রায় আমাদের আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। এজন্য প্রতিবছরের মতো এবারও আমরা আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা আশা করছি। আগামী ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখ রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের প্রভাতী অনুষ্ঠান শেষে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। উদ্বোধন করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। বিভিন্ন লোকজ অনুষঙ্গ আর বিশাল আকৃতির সব বাহন নিয়ে এ শোভাযাত্রা চারুকলার সামনে থেকে বের হয়ে ইন্টার কন্টিনেন্টাল (সাবেক রূপসী বাংলা) হোটেল চত্বর ঘুরে আবারও চারুকলার সামনে এসে শেষ হবে। বিশ্ব ঐতিহ্যে পরিণত হওয়া চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রাটি প্রথম যাত্রা করে ১৯৮৯ সালে। প্রথম বছরে নববর্ষ উৎসব উদযাপনকারীদের নজর কেড়ে নেয় এই আনন্দ শোভাযাত্রা। প্রথম শোভাযাত্রায় ঠাঁই পায় পাপেট, ঘোড়া ও হাতির শিল্পকাঠামো। পরের বছরে চারুকলার সামনে থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। এ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। এরপর থেকে এটা বাংলা বর্ষবরণের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা নাম বদলে পরিণত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রায়। ২০১৬ সালের ৩০ নবেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
×