ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিক্রীত বেশিরভাগ বিশুদ্ধ নয়

জার, ক্যান ও বোতলজাত পানি সরাসরি খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২০ মার্চ ২০১৭

জার, ক্যান ও বোতলজাত পানি সরাসরি খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণে রাজধানীর বেশিরভাগ হোটেল, রেস্তরাঁয় ও বাসাবাড়িতে ব্যবহার হচ্ছে নীল জার, ক্যান ও বোতলজাত পানি। তবে এসব বোতলজাত পানি কতটা নিরাপদ তা নিয়েই যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। খোদ বিএসটিআইয়ের অভিযানে দেখা গেছে, রাজধানীর অনেক অবৈধ প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়াই পানি বোতলজাত করে বাজারজাত করছে। কিন্তু বোতলজাত করার সঠিক কোন নিয়ম তারা অনুসরণ করছে না। তাদের উৎপাদিত পানির মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই বোতলজাত ও জারজাত পানির একটি বড় বাজার রয়েছে। বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণে বেশিরভাগ মানুষ এখন বোতলজাত পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আর এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা জার ক্যান ও বোতলজাত করে পানি বাজারে বিক্রি করছে। অথচ তাদের পানির মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এটা কতটা নিরাপদ বা খাওয়ার উপযোগী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোম্পানিগুলোর অসাধুতায় ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যে পানি সরবরাহ করে, তা সরাসরি পান করা ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি ফুটিয়ে, ফিল্টার করেও গন্ধমুক্ত পানের উপযোগী করা যায় না। আর বিশুদ্ধ খাবার পানির এই সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যক্তিরা রমরমা বাণিজ্য করছে। বিশুদ্ধ পানির নামে বোতলজাত পানি অথবা জারে বিক্রির ব্যবসা এখন রমরমা। কিন্তু রাজধানীসহ সারাদেশে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিরা জারে যে পানি বিক্রি করে তার বেশিরভাগই বিশুদ্ধ নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তারা বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স না নিয়েই ওয়াসার পানি কোন রকম পরিশোধন ছাড়াই জারে ভরে বিক্রি করছে। বিএসটিআই জানিয়েছে, খোদ রাজধানীতে এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। বিএসটিআইয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করায় এর আগে এক শ’রও বেশি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসার নামে ওয়াসার পানি সঠিক উপায়ে শোধন না করেই সরাসরি বোতলজাত করে বিক্রি করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানই জারে পানি রিফিল করার সময় জারগুলো জীবাণুুমুক্ত করছে না। জীবাণুমুক্ত করতে হাইড্রোজেন পার অক্সিসাইড ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই পদার্থের কোন ব্যবহার করা হয় না। এছাড়া জারে পানি রিফিল করার সময় ফিলিং মেশিন ব্যবহার করার কথা থাকলেও শুধু ফিল্টার ব্যবহার করে পানি ভর্তি করা হচ্ছে জারে। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিএসটিআইয়ের অনুমোদন না নিয়ে যারা পানি উৎপাদন করছে অভিযান চালিয়ে দেখা গেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানে ফিলিং মেশিনের আল্ট্রাভায়োলেট রে’ নেই। পানির ময়লা ছাঁকতে ফিল্টার ব্যবহার করলে এতে পানির ময়লা ছেঁকা হলেও জীবাণু ছেঁকা যায় না। মূলত রে’র মাধ্যমে জীবাণু ধ্বংস করা হয়। একটি প্রমাণ সাইজের রে’র বাল্বের মূল্য পনেরো হাজার টাকা। একবার এ বাল্ব নষ্ট হলে তা পরিবর্তন করাও হয় না। অনেক প্রতিষ্ঠানে আল্ট্রাভায়োলেট রে’ মেশিনটিই পাওয়া যায়নি অভিযানের সময়। নিয়ম অনুযায়ী জারে বা বোতালে পানি বাজারজাত করতে হলে অবশ্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে একজন করে কেমিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক। অথচ অনেক প্রতিষ্ঠানে কেমিস্ট ছাড়াই পানি বোতলজাত করা হচ্ছে। পানি উৎপাদন করে প্রতি ব্যাচ পানি একজন কেমিস্ট পরীক্ষার পর তা বাজারজাত করা উচিত। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা জানান, এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে ২-১টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোথাও কেমিস্ট পাওয়া যায় না। একটি ল্যাবরেটরি থাকা বাধ্যতামূলক হলেও কিছু কারখানায় ল্যাব পাওয়া গেলেও তা ব্যবহার হয় না। অনেক ক্ষেত্রে এসব ল্যাবে ধুলার স্তর জমে থাকতে দেখা যায়। অনেক কারখানায় পানি পরীক্ষার রিপোর্টও পাওয়া যায়নি। বিএসটিআই এক কর্মকর্তারা জানান, বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে অবৈধ কারখানা বন্ধের অভিযান পরিচালনা করে চলেছে। তবে দেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য অবৈধ পানির শোধন প্লান্ট রয়েছে যেগুলো তাদের নজরের বাইরে থেকে যায়। এসব প্লান্ট বন্ধের জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেরি ক্যানের পাশাপাশি যারা পানি বিশুদ্ধ করতে বাসায় ফিল্টার ব্যবহার করছে তারাও নিরাপদ নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানি বিশুদ্ধকরণের অন্যতম সহজ পদ্ধতি ফুটিয়ে পান করা। কিন্তু পানি ফোটানোর সঠিক পদ্ধতি সবার জানা থাকে না। নিয়ম না মেনে পানি ফোটানো হলেও তার কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। তাদের মতে, নদীর দূষিত পানি সরাসরি ফুটিয়ে পান করাও বিপজ্জনক। নদীতে পানিতে যে পরিমাণ বিষাক্ত ভারি ধাতু থাকে তা ফুটিয়ে জীবাণু মুক্ত করা সম্ভব হয় না। তবে পানি বিশুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে উন্নত শোধন যন্ত্রের সাহায্যে সঠিক নিয়ম মেনে বিশুদ্ধ করা হলে তা ব্যবহারের অনেকটাই নিরাপদ বলে মতো দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকার সরকারী পরিবেশ সংরক্ষণ এজেন্সির (ইউএসইপিএ) মতে, ফিল্টারকৃত থিতানো পানি ১ মিনিট ধরে পূর্ণমাত্রায় ফুটালেই কাজ হবে। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার পানির জন্য ১ মিনিট টগবগ করে ফুটানোই যথেষ্ট। তবে অনেকে বলছেন, এটা পানি ফুটানোর এ পদ্ধতিও সবচেয়ে অদক্ষ পদ্ধতি। পৃথিবীর কোন পানির শোধনাগারে জীবাণু মুক্ত করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় না। আবার অনেকে পানি দীর্ঘসময় ধরে ফুটান। এটা খুবই ক্ষতিকর। দীর্ঘ সময় ধরে পানি ফুটালে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। আর পানিতে মিশ্রিত ধাতব উপাদানের মাত্রা বেড়ে যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য অপকারী। এ জন্য পানি বিশুদ্ধ করণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্ক পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে উন্নত শোধনযন্ত্রের সাহায্যে পানি বিশুদ্ধ করেও পান করা যেতে পারে।
×