ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

শততমে ‘জয় বাংলা’

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২০ মার্চ ২০১৭

শততমে ‘জয় বাংলা’

মিথুন আশরাফ ॥ হেরাথ বল ছুড়লেন। মিরাজ সুইপ করলেন। শর্ট ফাইন লেগ দিয়ে বল গড়িয়ে যাচ্ছে। রান নিচ্ছেন আর ননস্ট্রাইকে থাকা অধিনায়ক মুশফিক বারবার আনন্দে আকাশে উড়তে চাইছেন। দৌড়ে দুই রান নিতেই বাংলাদেশ দলের সব ক্রিকেটার মাঠে দৌড়ে ছোটাছুটি করতে লাগলেন। ততক্ষণে যে শততম টেস্টে ৪ উইকেটের জয় মিলে গেছে বাংলাদেশের। শ্রীলঙ্কাকে কলম্বো টেস্টে হারানো নিশ্চিত হতেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান সব ক্রিকেটার। সেই সঙ্গে আনন্দের বন্যায় ভাসলেন দেশবাসী। টেস্ট জিতে ততক্ষণে উৎসবের রঙে রঙিন বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কার ৩৩৮ রানের জবাবে যে সাকিবের সেঞ্চুরিতে ৪৬৭ রান করে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকে, সেটিই আসলে কাজে দেয়। প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থাকা মানে টেস্টে জয়ের সম্ভাবনায় থাকা। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে যখন সাকিব (৪/৭৪) ও মুস্তাফিজের (৩/৭৮) বোলিং তোপে শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত ৩১৯ রানে গুটিয়ে যায়, বাংলাদেশের সামনে জিততে ৭৪ ওভারে ১৯১ রানের টার্গেট দাঁড় হয়। এ রান অতিক্রম করতে গিয়ে তামিমের ৮২ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে ৬ উইকেট হারিয়ে ৫৭.৫ ওভারে ১৯১ রান করে জেতে বাংলাদেশ। শততম টেস্টে ঐতিহাসিক টেস্ট জয় করল বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজে ১-১ ড্র করে। প্রথমবারের মতো লঙ্কানদের বিপক্ষে টেস্টও জিতে। শ্রীলঙ্কার ছুড়ে দেয়া টার্গেট যে অতিক্রম করে ফেলবে বাংলাদেশ তা সবাই বুঝে যায়। কিন্তু মাঝপথে এসে খানিক এলোমেলো হয়ে যায় দল। আগেরদিন ৮ উইকেটে ২৬৮ রান করেছিল শ্রীলঙ্কা। পেরেরা ২৬ ও লাকমাল ১৬ রানে অপরাজিত ছিলেন। এ দুইজনের উইকেট দ্রুতই তুলে নেয়া সম্ভব। এমন ভাবনাই সবার ভেতর জন্মায়। কিন্তু পঞ্চমদিনের সকালে গিয়ে সেই ভাবনা উল্টে যেতে থাকে। একদিকে মুস্তাফিজ, আরেকদিকে সাকিব টানা বল করতে থেকেও কাজ হচ্ছিল না। একদিকে ওভার যাচ্ছিল, সময় গড়াচ্ছিল; আরেকদিকে রানও স্কোরবোর্ডে জমা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ৩১৮ রানে গিয়ে রান আউট হন পেরেরা (৫০)। ১ রান যোগ হতেই লাকমালকেও (৪২) আউট করে দেন সাকিব। দিনটিতে ৫১ রান হয়। অলআউট হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। ১৯১ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে শুরুতেই ২ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। হেরাথ টানা দুই বলে সৌম্য ও ইমরুলকে আউট করে দেন। সবার ভেতর যেন শঙ্কা কাজ করে। কিন্তু তৃতীয় উইকেটে তামিম ও সাব্বির মিলে সেই ভয় শুধু দূরই করেননি, বাংলাদেশকে জয়ের দ্বারপ্রান্তেও নিয়ে যান। তামিম সেঞ্চুরি থেকে ১৮ রান দূরে থাকেন। মনে হয়, সেঞ্চুরি দিয়েই আজ তার যে ২৮তম জন্মদিন সেটি উদযাপন করবেন। কিন্তু একটি বাজে শটে ৮২ রান করে সাজঘরে ফেরেন তামিম। তামিম-সাব্বিরের জুটি ১০৯ রানে গিয়ে ভেঙ্গেও যায়। তখন জিততে ৬০ রানের দরকার থাকে। ১৩১ রানে গিয়ে তামিম আউট হওয়ার পর সাব্বিরও (৪১) খুব বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেননি। সাকিবও (১৫) যখন দ্রুতই আউট হন, তখন আবার এলোমেলো হয়ে যায় বাংলাদেশ। জিততে ২৯ রান লাগে তখন। হাল ধরার জন্য মুশফিক, সৈকত ও মিরাজরা থাকেন। তাই ভরসাও থাকে। তবে ৫ উইকেট হারিয়ে একটু হলেও বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। সেই বিপাক দূর করেন মুশফিক ও সৈকত মিলে। আর কোন উইকেটই পড়ত না। বাংলাদেশ ৫ উইকেটেই জিতত। কিন্তু যখন জিততে ২ রান দরকার, এমন মুহূর্তে গিয়ে মুশফিকের সঙ্গে ২৭ রানের জুটি গড়ে আউট হন সৈকত (১৩)। এরপর ব্যাট হাতে নেমে প্রথম দুই বলে কোন রান নিতে পারেননি মিরাজ। তৃতীয় বলে সুইপ করে ২ রান নেন। তাতেই বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টেস্ট জয়টি মিলে যায়। ২২ রানে অপরাজিত থাকা মুশফিকও তাই আকাশে ওড়ার অনুভূতি দেখান। বিদেশের মাটিতে যে সবচেয়ে উজ্জ্বল জয়টি পেয়ে যায় বাংলাদেশ। সেটি আবার মুশফিকের নেতৃত্বে। আবার বাংলাদেশের শততম টেস্টে। শততম টেস্টে এরআগে অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তানই জিততে পেরেছিল। সেই তালিকায় বাংলাদেশ নিজেদের নাম লেখায়। শততম টেস্টে এসে নবম টেস্ট জয়টিও তুলে নেয় বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে চতুর্থ জয় পায়। দেশের মাটিতে পাঁচটি টেস্টে জেতে বাংলাদেশ। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে চারটি ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি টেস্ট জেতে। আর বিদেশের মাটিতে এরআগে তিনটি টেস্ট জেতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুর্বল দলের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে দুইবার এবং জিম্বাবুইয়ের উন্নতির চেষ্টায় থাকা দলটির বিপক্ষে জিম্বাবুইয়ের মাটিতে একবার টেস্ট জেতে বাংলাদেশ। এবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যে জিতল বাংলাদেশ, এই সময়ের সেরা দলটিই শ্রীলঙ্কা। তাই টেস্ট জয়টি বিদেশের মাটিতে টাইগারদের সেরা জয়ই বলা যায়। সেই জয় পেয়ে ক্রিকেটাররা উচ্ছ্বাসিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহীম বলেছেন, ‘সকল টাইগারভক্তদের এই জয় উৎসর্গ করলাম। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে জয়টা বিশেষ ছিল। এটা ভাল জয়। বিদেশের মাটিতে প্রভাব বিস্তার করা জয়। এই জয়টা আমাদের ওয়ানডে সিরিজের আগে আরও বেশি প্রেরণা দেবে।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘শ্রীলঙ্কা ভাল দল। কিছুদিন আগে তারা অস্ট্রেলিয়াকে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়েছে। তাই ওদের বিপক্ষে এই জয়টা আমাদের উজ্জীবিত করবে। শততম টেস্টের সফরটা সহজ ছিল না। অনেক কিছু পেরিয়ে আমরা শততম ম্যাচ খেলতে নেমেছিলাম।’ প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি করেন সাকিব। তার এ সেঞ্চুরিতেই লিড নেয় বাংলাদেশ। সেটিই বেশি কাজে লাগে। দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে গল টেস্টে ২৫৯ রানে হারের পর কলম্বো টেস্টে যে বাংলাদেশ জেতে, সেটির পেছনে সাকিবের অবদান অনস্বীকার্য। শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতেও যে ৪ উইকেট তুলে নেন। তাই সিরিজ সেরাও হন সাকিব। বাংলাদেশের সেরা এ অলরাউন্ডার বলেন, ‘শ্রীলঙ্কায় টেস্ট জেতা দারুণ অনুভূতি। নিজেদের শততম টেস্টে জয় পেয়েছি। এ জয়ের চেয়ে ভাল কিছু নেই।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘যেভাবে আমরা দিন দিন উন্নতি করছি তাতে সামনে আমরা আরও ম্যাচ জিতব। দেশের মাটিতে আমরা ভাল সময় কাটাচ্ছি। হোম সিরিজের পাশাপাশি দেশের বাইরেও আমাদের আরও ভাল খেলতে হবে।’ সাকিব যেখানে দলকে একটি অবস্থানে নিয়ে গেছেন, তেমনি ওপেনার তামিম ইকবালের ৮২ রানের দুর্দান্ত ইনিংসটি না হলে বিপদেই পড়ত বাংলাদেশ। তার এই ইনিংসেই অনেকদূর এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। জয়ের দ্বারপ্রান্তেও পৌঁছে যায়। তামিম তাই বলেন, ‘এটা অসাধারণ একটি জয়। উইকেটে বোলারদের জন্য অনেক কিছু ছিল। কিন্তু আমরা লম্বা সময় ধরে ব্যাট করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম।’ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকার ফলই মিলেছে। শততম টেস্টকে উৎসবের রঙে রাঙিয়ে তুলেছে বাংলাদেশ।
×