ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা দুই ম্যাচের সিরিজ ড্র, কলম্বোয় দ্বিতীয় টেস্টে মুশফিকরা জয়ী ৪ উইকেটে

বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে সেরা জয়

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ২০ মার্চ ২০১৭

বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে সেরা জয়

মিথুন আশরাফ ॥ জয়ের সুবাতাস আগেরদিনই মিলেছিল। শততম টেস্টে সেই জয়ের স্বপ্ন সফল করেই ফেলল বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো কোন শক্তিশালী দলকে তাদের মাটিতে হারিয়ে ইতিহাসও গড়ল বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কাকে ৪ উইকেটে হারিয়ে শুধু ইতিহাসই গড়ল তা নয়, শ্রীলঙ্কার মাটিতে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজেও ড্র করল বাংলাদেশ। গল টেস্টে ২৫৯ রানে হারের পর কলম্বো টেস্টে জিতল বাংলাদেশ। তাতে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ১-১ ড্র হলো। এরআগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৭ টেস্টে খেলে একটিতেও জিততে পারেনি। দুটি টেস্টে ড্র করেছিল। হেরেছিল বাকি ১৫টি টেস্টে। এবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৮তম টেস্টে খেলতে নেমে জয় তুলে নিল বাংলাদেশ। সেটি আবার শ্রীলঙ্কার মাটিতেই জয় আসল। আবার বাংলাদেশের শততম টেস্টে। চতুর্থদিন শ্রীলঙ্কা ১৩৯ রানে এগিয়ে ছিল। হাতে ছিল দুই উইকেট। সেই দুই উইকেট পড়ল যখন, তখন বাংলাদেশের সামনে জিততে টার্গেট দাঁড় হলো ১৯১ রান। এই রান অতিক্রম করতে গিয়ে ম্যাচ সেরা তামিম ইকবালের ৮২ রানের ইনিংসের সঙ্গে তামিম-সাব্বির রহমান মিলে যে তৃতীয় উইকেটে ১০৯ রানের জুটি গড়েছেন, সেটিই দলকে জয়ের কাছাকাছি নিয়ে যায়। এরপর ৬ উইকেট হারিয়ে ১৯১ রান করে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। কলম্বো টেস্টের পঞ্চম ও শেষদিনের শেষ সেশনে গিয়ে খেলার ১৬ ওভার বাকি থাকতে জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। জয়টি আরাম-আয়েশে হওয়ার কথা থাকলেও, শ্বাসরুদ্ধকর জয়ই হলো। সিরিজের নায়ক হন সাকিব আল হাসান। যার হাত ধরে মূলত ঐতিহাসিক ম্যাচেও ইতিহাস গড়া জয়টি পায় বাংলাদেশ। যদিও ম্যাচ সেরা হন তামিম। দ্বিতীয় ইনিংসে তার ৮২ রানের ইনিংসই যে জয়ের কাছাকাছি নিয়ে যায় বাংলাদেশকে। শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংসে ৩৩৮ রান করেই বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। সেই চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়ে দ্বিতীয়দিনেই বিপদে পড়ে যায় বাংলাদেশ। এরপর সেই বিপদ থেকে দলকে টেনে তোলেন সাকিব। দ্বিতীয় দিনের শেষবেলায় ব্যাট হাতে নেমে এলোমেলো ব্যাটিং করতে থাকা সাকিব তৃতীয়দিনে পরিণত ব্যাটিং করেন। তাতেই সেঞ্চুরি তুলে নেন। ১১৬ রান করে সাজঘরে ফেরেন। তার সঙ্গে মুশফিকুর রহীম ও অভিষিক্ত মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের হাফ সেঞ্চুরিতে জবাবটা ভালই দেয় বাংলাদেশ ৪৬৭ রান করে। প্রথম ইনিংসেই ১২৯ রানে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। এই এগিয়ে থাকাতে যে কতটা উপকার হয়, তা বোঝাই যায়। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে চাপে পড়ে শ্রীলঙ্কা। চতুর্থদিন পর্যন্ত ৮ উইকেটে ২৬৮ রান করে শ্রীলঙ্কা ১৩৯ রানে এগিয়ে থাকে। পঞ্চমদিনে বাংলাদেশের মূল টার্গেটই ছিল দুটি। এক, যেভাবে হোক যতদ্রুত শ্রীলঙ্কার হাতে থাকা দুই উইকেট শিকার করা যায়। দুই, এরপর টার্গেট অতিক্রম করা। দ্রুত উইকেট তুলে নেয়া যায়নি। দিলরুয়ান পেরেরা (১৭৪ বলে ৫০ রান) ও সুরঙ্গ লাকমাল (৪৮ বলে ৪২) মিলে দলকে এগিয়েই নিতে দ্রুত রান তুলতে থাকেন। ৩১৮ রানে গিয়ে পেরেরা রান আউট হয়ে যান। আর ১ রান যোগ হতেই লাকমালকে আউট করে দেন সাকিব। অলআউট হয়ে যায় লঙ্কানরা। ৮০ বলেই ৫১ রান করে ফেলে শ্রীলঙ্কা। চার উইকেট তুলে নেন সাকিব। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সামনে জিততে ১৯১ রানের টার্গেট দাঁড় হয়। ব্যাট হাতে নিজেকে মেলে ধরার পর বল হাতেও সাকিব দেখান ঝলক। সেই ঝলকানি এমন পর্যায়েই যায়, বিশ্বের সেরা পাঁচ বাঁহাতি স্পিনারের কাতারে চলে আসেন। ৪৯তম টেস্ট খেলতে নামা সাকিবের টেস্ট উইকেট এখন ১৭৬টি। টেস্ট ইতিহাসের বাঁহাতি স্পিনারদের রেকর্ড পাতায় তার সামনে আছেন কেবল মাত্র চারজন স্পিনার । শ্রীলঙ্কার রঙ্গনা হেরাথ (৩৭২ উইকেট), নিউজিল্যান্ডের ডেনিয়েল ভেট্টরি (৩৬২ উইকেট), ইংল্যান্ডের ড্যারেক আন্ডার উড (২৯৭ উইকেট), ভারতের বিষেন সিং বেদী (২৬৬ উইকেট) আছেন। তবে সাকিব দ্বিতীয় ইনিংসে সেই ঝলক ধরে রাখতে পারেননি। উজ্জ্বলতা ছড়িয়েছেন তামিম ও সাব্বির। শুরুতে সৌম্য সরকার ও ইমরুল কায়েস ব্যর্থ হলেও এরপর তামিম ও সাব্বির মিলে যে জুটি গড়েন সেই জুটিই দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যায়। ২২ রানে দুটি উইকেট পড়ার পর তামিম ও সাব্বির মিলে দলকে ১০৯ রানের জুটি উপহার দেন। দুইজন মিলে দলকে ১৩১ রানে নিয়ে যান। জিততে আর ৬০ রান লাগে, এমন মুহূর্তে তামিম পাগলামি করে আউট হয়ে যান। দলকে এতদূর এনে সেঞ্চুরি থেকে আর ১৮ রান দূরে থেকে বাজেভাবে শট খেলে আউট হন বাংলাদেশ ওপেনার। তাতে প্রধান কোচ চন্দিকা হাতুরাসিংহেও ক্ষেপে যান। সামনে এগিয়ে এসে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে আউট হয়ে যান বাঁহাতি এই ওপেনার। তামিম আউট হয়ে ফিরতেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন বাংলাদেশের প্রধান কোচ হাতুরাসিংহে। টেলিভিশন ক্যামেরায় দেখা যায় সেই দৃশ্য। বাংলাদেশের ড্রেসিং রুমে বসেছিলেন হাতুরাসিংহে। তামিম আউট হতেই উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় থাকা ক্যাপ খুলে ছুড়ে মারেন তিনি। এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন লঙ্কান এই কোচ। তামিমের এই আউট কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না হাতুরাসিংহে। দিলরুয়ান পেরেরার একটি বল ডাউন দ্য উইকেটে এসে মারতে যান তামিম। কিন্তু ব্যাটে-বলে ঠিকমতো না লাগায় বলটি মাঠ পার হতে পারেনি। ধরে ফেলেন বাউন্ডারির কাছাকাছি থাকা দিনেশ চান্দিমাল। আক্ষেপ নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় বাঁহাতি এই ওপেনারকে। তামিমের আউটের পর ৪১ রান করা সাব্বিরও ১৪৩ রানে সাজঘরে ফেরেন। চার উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। এরপর যখন জিততে ২৯ রানের প্রয়োজন, সাকিবও (১৫) আউট হয়ে যান। বিপদে পড়ে যায় বাংলাদেশ। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার তৈরি হয়। এরপরও স্বপ্ন জয়েরই থাকে। কারণ উইকেটে মুশফিক থাকেন। সেই সঙ্গে আরও চার উইকেট থাকে। এরমধ্যে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ও মেহেদী হাসান মিরাজ তো নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানই। মুশফিক ও মোসাদ্দেক মিলেই শেষ পর্যন্ত দলকে জয়ের একেবারে কাছাকাছি নিয়ে যান। ষষ্ঠ উইকেটে দুইজন মিলে ২৭ রানের জুটি গড়ে দলকে ১৮৯ রানে নিয়ে যান। জিততে ২ রানের প্রয়োজন থাকে। এমন মুহূর্তে সৈকত (১৩) আউট হয়ে যান। মেহেদী হাসান মিরাজ ব্যাট হাতে নেমে ‘বার্থ ডে’ বয় রঙ্গনা হেরাথের বলে সুইপ করে শর্ট ফাইন লেগ দিয়ে ২ রান নেন মিরাজ। ম্যাচ জিতে যায় বাংলাদেশ। শততম টেস্টে জয় তুলে নেয়। এরআগে বাংলাদেশ ৮ টেস্টে জিতেছিল। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে পাঁচটি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুটি ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একটি টেস্ট জিতেছিল বাংলাদেশ। এরমধ্যে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে একটি ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুটি টেস্টে জয় মিলেছিল তাদেরই দেশে। কিন্তু জিম্বাবুইয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোন দলই এত আহামরি ছিল না। শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে প্রথমবারের মতো হারিয়ে নবম টেস্ট জয়টি তুলে নিল বাংলাদেশ। সেটি আবার বাংলাদেশের শততম টেস্টেই জয় মিলল। অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের পর শততম টেস্টে চতুর্থ দল হিসেবে জিতল বাংলাদেশ। এরআগে ১৯১২ সালে ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজেদের শততম ম্যাচটিতে জয় পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ১৯৬৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শততম টেস্টটিতে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৭৯ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শততম টেস্ট ম্যাচ জিতেছিল পাকিস্তান। রবিবার নিজেদের শততম টেস্টে জিতল বাংলাদেশ। ইতিহাস গড়ল।
×