ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আগাম মুকুল ॥ বৈরী আবহাওয়া আমের ক্ষতি করতে পারেনি

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২০ মার্চ ২০১৭

আগাম মুকুল ॥ বৈরী আবহাওয়া আমের ক্ষতি করতে পারেনি

স্টাফ রিপোর্টার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ বিভিন্ন অঞ্চলে আমের উৎপাদনে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন শিবগঞ্জ ও ভোলাহাট অঞ্চলে দুর্যোগ মোকাবেলা করেও আম চাষীরা লাভবান হবে বলে একাধিক কৃষি বিজ্ঞানীর অভিমত। শিবগঞ্জে এলাকার একাধিক আম বাগান মালিক জনকণ্ঠকে জানান, এবার আগাম বৃষ্টি হওয়ার কারণে তাদের বাগান পরিচর্যার খরচ দ্বিগুণের অনেক উপরে থাকবে। তবে আশানুরূপ ফলন ও চড়ামূল্য থাকলে অনেকেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। আর এই সুযোগে বহুজাতিক কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটার ও ওষুধ বিক্রেতা রিপ্রেজেনটেটিভ ইতোমধ্যেই বাগান মালিক ও ফলকর ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে। বিশেষ করে এবার সীমান্তের ওপারের কেমিক্যাল বিক্রেতারা মালদহ মুর্শিদাবাদ ছাড়িয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চাচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলে। ইতোমধ্যে চোরাকারবারিদের সহযোগিতায় ভারতীয় প্রতিনিধি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকা সফর করেছে। একই সঙ্গে তারা রাজশাহী অঞ্চলে ঘুরে এসেছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ভারতীয় একাধিক কেমিক্যাল ব্যবসায়ী এই অঞ্চলে আসছে। তারা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বহুজাতিক কোম্পানির লোকজনের প্রখর দৃষ্টি এই অঞ্চলের উপর পড়ায় এনজিও ও বেসরকারী সংস্থা জেলাজুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের দেয়া অর্থ নিয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভা করে চলেছে। সবার লক্ষ্য আমের উন্নয়ন হলেও আড়ালে বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ দেখভাল করা হচ্ছে। এসব সংস্থার প্রতি সরকারী নজরদারী না থাকার কারণে বিশাল অংক ব্যয়ে যারা আম উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তি ও কেমিক্যাল মুক্ত আম উৎপাদনে উদ্ধুদ্ধ সভা করে বেড়াচ্ছে তারা কারা? এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অভিমত ১৪ হাজার হেক্টর আম বাগান রয়েছে শিবগঞ্জে ধারণা করা হচ্ছে এখানে এবার আমের উৎপাদন হবে আশাতীত। যদিও দুর্যোগের কারণে অন্যান্য উপজেলায় আম উৎপাদন ব্যাহত হলেও শিবগঞ্জে তার ব্যতিক্রম। উপরন্ত আগাম গুটি এসে পড়ায় এবং মৌসুমী প্রভাবে টানা তিনদিনের বৃষ্টিতে প্রতিটি ডগার গুটি আমের স্থায়ীত্ব আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। উপজেলায় আম গাছের সংখ্যা ১০ লাখ ৫২ হাজার হওয়ার কারণে এবার আমের উৎপাদন নিয়ে এই অঞ্চলের কৃষক বিব্রত থাকবে। বিশেষ করে কানসাট, শাহবাজপুর, দাইপুকুরিয়া, চককীর্তি, মোবারকপুর, রানীহাটিতে আমগাছের প্রতিটিতে রয়েছে থোকা থোকা আম। সে মোতাবেক আম উৎপাদনে কোন ঘাটতি হবে না। বিশেষ করে শিবগঞ্জে আশ্বিনার ৩৯৯৫ গাছে, ফজলি ৩৪৮৮, ল্যাংড়া ২০২১ গাছে, গোপালভোগ এক হাজার গাছে, খিরশা ১২শ’ গাছে, বোম্বাই, লখনা, গোড়মতি, আম্রপালি, মল্লিকা ১৬০০ গাছে, অন্যান্য উন্নত গুটি জাত রয়েছে তিন হাজার। মোট ২২ হাজার ৯শ’ ৯৫ গাছে নেই কোন আমের ঘাটতি। এর মধ্যে এক থেকে ২০ বছর পর্যন্ত গাছের পরিমাণ ৪০ শতাংশ। ছোট গাছে আমের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি তবে ২১ থেকে ৬০ তদুর্র্ধ গাছেও এবার কা- ও ডালভেদ করে মুকুল আসায় আম হয়েছে আশাতীত। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, শুধু শিবগঞ্জ এলাকায় ৯ লাখ ৮০ হাজার গাছের আম পুরো দেশের চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থাকবে। পাশাপাশি ভোলাহাট উপজেলার ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৪টি ও গোমস্তাপুরে ৩ লাখ ৩২ হাজার ৪৫১টি, আশ্বিনা ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, খিরশাপাতসহ বিভিন্ন উন্নত জাতের আম রয়েছে প্রায় ১১টি। সব গাছেই আমের ছড়াছড়ি। আমের গুটি ঝরে না পড়ার বিষয়ে সচেতনতামূলক উপদেশ আসার পর কৃষক ইতোমধ্যে পাঁচ ৫ কোটি টাকার কমিক্যাল ছিটিয়েছে। তারা আমের পরিপক্কতা আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আরও ১০ কোটি টাকার কেমিক্যাল স্পে করবে বলে বিভিন্ন এলাকার বেসরকারী জরিপে উঠে এসেছে। তবে বৃহত্তর রাজশাহীর তিন উপজেলার ৬১ ইউনিয়নে শিবগঞ্জের আদলে আমের ফলন বা উৎপাদন হবে বলে কৃষি সম্প্রসারণ ও ফল গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা আশা করছেন। যদিও এবার মুকুল দেরিতে আসায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের কৃষকরা তাদের সাড়ে চার লাখ গাছের ক্ষতি হয়েছে বৃষ্টির কারণে। তবু তারা আশা করছে এবার আমের দাম উর্ধমুখী থাকলে ও ভারতীয় আমের বৈধ আমদানি বন্ধ থাকলে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। তারপরেও বৈরী আবহাওয়া ও দুর্যোগ কাটিয়ে এক লাখ ৩০ হাজার ২৪০ মেট্রিক টন আম উৎপাদন করতে সক্ষম হবে তারা। বর্তমানে জেলার পাঁচ উপজেলায় গাছের সংখ্যা বেড়ে ১৭ লাখ ৬৪ হাজার অতিক্রম করেছে। গত এক বছরে নতুন করে আম গাছের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিন লাখের কাছাকাছি। স্থানীয় ভাষায় এইসব কেড়া আম গাছে আমের ফলন সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি আকারেও অনেক বড় হয়ে থাকে। এসব গাছের আমে রোগ বালাই কম হওয়ার কারণে ও ব্যাগ পদ্ধতির আওতায় থাকায় মৌসুমের একেবারে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গাছে থাকে। ফলে কৃষক অফ সিজিনের সুবিধা পেয়ে থাকে। দামও পেয়ে থাকে কয়েকগুণ বেশি। এর বাইরে একই ধরনের নতুন গাছের সংখ্যা (কেড়া গাছ) শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট অঞ্চলে খুবই বেশি। কয়েক বছর ধরে বরেন্দ্র অঞ্চলের নাচোল, নিয়ামতপুর, গোদাগাড়ি ও তানোরে নতুন আম বাগান হয়েছে দুই হাজারের বেশি। এমনকি পোরশাও সংলগ্ন বরেন্দ্রর সাত উপজেলায় সাড়ে তিন হাজার আম বাগান রয়েছে। অধিকাংশ আম বাগান করা হয়েছে বরেন্দ্রর লাল মাটি ধানের জমিতে। দ্রুত ও মৌসুম শেষের আম হওয়ার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে মল্লিকা ও আম্রপালি জাতের গাছ লাগানোর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এসব অঞ্চলে এই দুটি জাতের আম গাছের সংখ্যা ইতোমধ্যেই তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এসব ছোট ছোট গাছের আম মৌসুমের একেবারে শেষে পাকে এবং মিষ্টতার পরিমাণ খুবই বেশি। তাছাড়া সংরক্ষণে অধিক সময় নিয়ে থাকে। পাকলেও আম শক্ত থাকবে বলে বাজারমূল্য মৌসুমী আমের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি হয়ে থাকে। একই চিত্র রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিয়াড় অঞ্চলে। পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা, পুনর্ভবাসহ ১২টি ছোট বড় নদী বিধৌত চরাঞ্চলের বালু মাটিতে আমের বাগান করার হিড়িক পড়েছে। কারণ এক যুগের বেশি সময় বালুকাময় চরাঞ্চলে কোন ফসল হচ্ছিল না। আম বাগান করার পর পতিত এসব অনাবাদি জমিতে আম চাষ করে অনেক পয়সা পাচ্ছে কৃষক। এতদিন চরাঞ্চলের জমি পানির দরে বেচাকেনা হলেও এখন তা চড়ামূল্যে কেনবেচা হচ্ছে। সব মিলিয়ে চরাঞ্চলে আম গাছের সংখ্যা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী মিলে পাঁচ লাখের কাছাকাছি। এসব গাছেও এবার আগাম মুকুল আসায় বৈরী আবহাওয়া ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি তেমন ক্ষতি করতে পারেনি।
×