ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

টেকনাফের পাহাড়ে অস্ত্র মজুদ হচ্ছে, চলছে জঙ্গী প্রশিক্ষণ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৯ মার্চ ২০১৭

টেকনাফের পাহাড়ে অস্ত্র মজুদ হচ্ছে, চলছে জঙ্গী প্রশিক্ষণ

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র লড়াইয়ের নামে সক্রিয় হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা জঙ্গী গ্রুপ আল এ্যাকিন। বহুল আলোচিত বিদ্রোহী সশস্ত্র এই সংগঠনটি টেকনাফে পুরান পল্লানপাড়ার উঁচু পাহাড়ে অস্ত্র মজুদ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, রোহিঙ্গা জঙ্গী হাকিম ডাকাত সংগঠনটির সামরিক প্রধান হিসেবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বলে জানা গেছে। টেকনাফ থানা সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা জঙ্গী হাকিম ডাকাতের বিরুদ্ধে আনসার ক্যাম্পে অস্ত্র লুট ও আনসার হত্যার অভিযোগ, অপহরণ, অস্ত্র আইন, ডাকাতি, মাদক ও বৈদেশিক নাগরিক আইন লঙ্ঘনসহ অর্ধ ডজন মামলা রয়েছে। পুলিশ তাকে ধরতে ব্যাপক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। টেকনাফ মডেল থানার পরিদর্শক ও আনসার ক্যাম্পের অস্ত্র লুট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেখ আশরাফুজ্জামান বলেন, লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার হওয়া মামলায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এখন মামলাটির তদন্তের গতি বৃদ্ধি পাবে এবং ঘটনার হোতাদের চিহ্নিত করা সহজ হবে। টেকনাফ পৌরসভার মেয়র হাজী মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, হাকিম ডাকাতের অত্যাচারে পুরান পল্লানপাড়া ও নাইট্যংপাড়ার মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হাকিম ডাকাতের বিরুদ্ধে এতগুলো মামলা থাকার পরও কেন সে গ্রেফতার হচ্ছে না। নিরীহ লোকজনকে অপহরণ করে তার আস্তানায় নিয়ে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করছে। তার বিরুদ্ধে দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান পৌর মেয়র। এদিকে আল এ্যাকিনের প্রধান অস্ত্র প্রশিক্ষক হাকিম ডাকাত সংগঠনের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরে ইতোপূর্বে ভিডিও বার্তায় বলেছে, এখানে তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে তৈরি হচ্ছে। আরএসও, আরএনও, এআরআইএফসহ কয়েকটি বিদ্রোহী রোহিঙ্গা সংগঠন থেকে বাছাই করে রোহিঙ্গা যুবকদের অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তারা মিয়ানমারে ফিরে শীঘ্রই কিছু করবে। এছাড়া মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি এলাকার লোকজনকে হুমকি-ধমকি দিয়ে তাদের সংগঠনের কাজে সহযোগিতা ও যোগ দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে ওই ভিডিওবার্তায়। সূত্র জানায়, এ অন্যায় কাজের মদদ ও অর্থ যোগান দিচ্ছে শহরের রোমালিয়ারছড়া চৌধুরীপাড়ায় বসবাসরত মৌলবি শফিক, মৌলবি আবদুর রহিম ও নুর হোসেন। অস্ত্র প্রশিক্ষণের পেছনে ভূমিকা রয়েছে রোহিঙ্গা মাস্টার আয়ুবের। সূত্রে প্রকাশ, কিছু সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাকে নিয়ে ’১২ সালে আরাকান বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন ‘আল এ্যাকিন’ আত্মপ্রকাশ করে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আবু আম্মর জুনুনীর নেতৃত্বে বিভিন্ন পাহাড়ে তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ চলছে। টেকনাফে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে পুরান পল্লানপাড়ার পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ঘাঁটি বানিয়েছে হাকিম ডাকাত। একাধিক সূত্র জানায়, প্রায় ৮ বছর আগে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে টেকনাফ শাহপরীরদ্বীপে বসবাস শুরু করে মংডু দক্ষিণ বড়ছড়ার জয়নাল আলী ওরফে জানে আলমের ছেলে হাকিম ডাকাত। কয়েক বছর পর তার ৫ ভাই যথাক্রমে বশির, কবির, নজির, হামিদ হোছনকেও নিয়ে আসে এপারে। এরপর শক্তি সঞ্চয় করে হাকিম সাগর নদীতে ডাকাতি ও অপহরণ বাণিজ্য শুরু করে। তার অপকর্মের বিরুদ্ধে শাহপরীরদ্বীপের লোকজন সোচ্চার হলে তারা ৬ ভাই টেকনাফে এসে বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করতে থাকে। পুরান পল্লানপাড়ার জহির আহমদের মেয়েকে বিয়ে করে টেকনাফ বন রেঞ্জের (উপজেলা প্রশাসনিক ভবনের উত্তর-পশ্চিম দিকে) আনুমানিক এক কি.মি পর্যন্ত বনভূমি দখল করে। এর পর হাকিম ডাকাত আল এ্যাকিন বিদ্রোহী রোহিঙ্গা জঙ্গী সংগঠনে যোগ দেয়। বর্তমানে ঐ জঙ্গী সংগঠনের সামরিক প্রধান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছে। টেকনাফের একাধিক সমাজপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডাকাত হাকিমের ৫ ভাইসহ শ্বশুর পক্ষের লোকজন জাফর আলম, মোঃ রফিক, নুরুল আলম, আনোয়ার, ফরিদ উল্লাহ, ইউনুছ, আলম ডাকাত, সাব্বির আহমদ, সেলিম মিস্ত্রি ও তার ছেলে নুরুল আবছার নুরুকে নিয়ে শক্তিশালী ডাকাত দল গঠন করে প্রতিনিয়ত দস্যুতা, চাঁদাবাজি, চাঁদা না দিলে নির্যাতন, অপহরণ করে খুন, খুনের পর গুম করার ঘটনা করে চলছে হাকিম বাহিনী। ওসব ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-আবদুল লতিফের ছেলে নুরুল কবির, সিএনজি ড্রাইভার মোঃ আলী, মু-ি সেলিম ও নতুন পল্লানপাড়ার সিরাজ মেম্বার, আবদুল হাফিজ ও তোফায়েল হত্যাসহ অহরহ ঘটনার নায়ক এ আবদুল হাকিম ডাকাত। তারা জানান, আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংস্থার সঙ্গে আল এ্যাকিনের যোগাযোগ রয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের ঘটনায় আল এ্যাাকিনের সশস্ত্র গেরিলা ট্রেনিং আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংস্থার সমর্থন আদায় করতে পেরেছে। স্থানীয়রা বলেছেন, ক্ষমতাধর কয়েক নেতার ছয়ছায়ায় হাকিম ডাকাতের নেতৃত্বে উঁচু পাহাড়ে অবস্থান করে তাদের অবৈধ ও বেআইনী কার্যক্রম চালাচ্ছে। পুরান পল্লানপাড়া, জাহালিয়াপাড়া ও বরইতলী এলাকার কয়েকজন লোক তাদের সহযোগিতা করে আসছে। পুরান পল্লানপাড়ার নুরুর কাছ থেকে ৮ লাখ, সেলিমের কাছ থেকে ৫ লাখ, টমেটোর কাছ থেকে ৪০ হাজার, ছুহুরা খাতুনের কাছ থেকে ৪০ হাজার, শাহপরীরদ্বীপে বসবাসরত বার্মাইয়া জানে আলমের কাছ থেকে ১০ লাখ, শফিউল্লাহ মাঝি থেকে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করেছে হাকিম ডাকাতের বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা। ওদিকে মিয়ানমারে সীমান্তরক্ষী বাহিনী পুলিশের তিনটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়ে বিজিপির ৯ সদস্যকে হত্যা এবং বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটের ঘটনার ভিডিও বার্তায় দায় স্বীকার করেছে আল এ্যাকিন। সম্প্রতি টেকনাফে আব্দুল হাকিম ডাকাতের বাড়িতে বিজিবি অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ হাকিম ডাকাতের ভাই কবির আহমেদ, স্ত্রী ইসমত আরা বেগম ও মিয়ানমার মংডু সিকদার পাড়ার মরহুম মোঃ আলীর পুত্র নুর আমিনকে গ্রেফতার করেছে। এ সময় উদ্ধার করা হয় ৪ দিন ধরে মুক্তিপণের জন্য আটক রাখা শাহপরীরদ্বীপ জালিয়াপাড়ার নুর মোহাম্মদের ছেলে সেলিমকে। টেকনাফ কায়ুকখালী ব্রিজের ওপর থেকে তাকে অপহরণ করে পুরাতন পল্লানপাড়ায় হাকিম ডাকাতের ঘরের একটি রুমে হাত-পা বেঁধে রেখে মোবাইলে পরিবারের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে আসছিল।
×