ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিত্য বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, ছড়াচ্ছে পানিবাহিত রোগব্যাধি

রাজধানীর অর্ধেক মানুষ বিশুদ্ধ পানির যোগান বঞ্চিত

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৯ মার্চ ২০১৭

রাজধানীর অর্ধেক মানুষ বিশুদ্ধ পানির যোগান বঞ্চিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিশুদ্ধ পানির অভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ। এক গবেষণায় দেখা গেছে মানবদেহে প্রায় ৭০ ভাগ রোগের জন্ম বিশুদ্ধ পানির অভাবেই। পানি বিভিন্ন উৎস দূষিত হয়ে পড়ায় বিশুদ্ধ পানির যোগানও সীমিত হয়ে আসছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ধারণের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার একান্ত আবশ্যক হলেও জরিপে দেখা গেছে রাজধানীর অর্ধেক মানুষ বিশুদ্ধ পানির যোগান থেকে বঞ্চিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন তারা বলেন পানিবাহিত রোগের একমাত্র উৎস বিশুদ্ধ পানির অভাব। দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে হেপাটাইটিসসহ টাইফয়েড, ডায়ারিয়া, কলেরা, আমাশয় জন্ডিসের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। মারণব্যাধি ক্যান্সারেও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে কারণে। প্রতিনিয়ত রাজধানীতে জনসংখ্যা বাড়ছে। তাদের পানির চাহিদা পূরণের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে ওয়াসার পানির ওপর। অথচ ওয়াসার সরবরাহ লাইনের পানি নিয়ে অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রায়ই ওয়াসার পানিতে ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহের অভিযোগ পাওযা যাচ্ছে। এছাড়াও পয়ঃনিষ্কাশনের বর্জ্য, নর্দমা ও ড্রেনের ময়লাসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক পদার্থ পানি সঙ্গে মিশে দূষিত হয়ে পড়ছে। আবার ঢাকার চার নদীর পানি এত দূষিত যে তা ট্রিটমেন্ট করেও দূষণমুক্ত করা যাচ্ছে না। ওয়াসা জানিয়েছে রাজধানীরবাসীর পানি চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বেশি। এ কারণে ভূগর্ভস্থ স্তরের পানি দিন দিন নেমে যাচ্ছে। দূষিতও হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এক সময় রাজধানী ঢাকার পানি প্রধান উৎস ছিল চার নদী। বর্তমানে এই চার নদী এত পরিমাণ দূষিত যে পানিতে অক্সিেেজনের মাত্রা শূন্যে নেমে গেছে। পরিবেশ অধিদফতরের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার পানি সারা বছরই ব্যবহারের অনুপযোগী থাকছে। এমনকি এর পাড় দিয়ে চলাচল করা এখন স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন কোন পানি ব্যবহারের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা প্রতি মিলিলিটারে থাকতে হবে ৫ এর ওপরে। এর নিচে নেমে গেলেই সেই পানি আর ব্যবহার করার উপযোগী থাকবে না। অথচ ঢাকার চার নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ১ থেকে দশমিকে নিচে অবস্থান করছে বলে পরিবেশ অধিদফতরের জরিপে রেদখা গেছে। এ কারণে ওয়াসা বলছে নদীর পানি ট্রিটমেন্ট প্লন্টের পরিশোধন করা যাচ্ছে না। এছাড়াও সম্প্রতি গবেষণায় নদীর পানিতে ভারি ধাতব পদার্থের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। তারা বলছেন, নদীর পানি দূষণের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমাগত। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ পানিতে নানা ধরনের দূষণ মিশে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ স্তরের পানি উন্মুক্ত হয়ে পড়ার কারণে নদীর দূষিত পানি ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিশে দূষিত করছে। তাদের মতে পানি স্তর বেশি মাত্রায় নিচে নেমে গেলে আগামীতে চাহিদার প্রয়োজনীয় পানিও সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিদিন প্রায় ২৩০ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন। সেখানে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করতে পারছে প্রায় ২১০ কোটি লিটার। ফলে নদী বা বোতলজাত পানির উপর ভরসা করছেন অনেকেই। যাতে ভয়াবহ আকারে ধারণ করছে রোগ-বালাই। এদিকে পানির এই সঙ্কটকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর অসাধু পানি ব্যবসায়ী বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণের কথা বলে অশুদ্ধ পানির রমরমা ব্যবসা খুলে বসেছেন। সুপেয় ও নিরাপদ পানি সরবরাহের কথা বলে অনেক সময় ব্যবসায়ীরা ফিটকিরি ও চুন জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করে পানি বিশুদ্ধ করছে। অনেক সময় আবার নদীর পানি অপিরিশোধিত অবস্থায়ই বোতলজাত করে বিক্রি করছে এক ধরনের অস্বাধু ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফ পরিচালিত (বিবিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওয়াসার সাপ্লাই পানিতে ১ থেকে ১০০ কলোনি ফার্মিং ইউনিটস (সিএফইউ) কোলা-ই-ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, যা থেকে ক্যান্সারের মতো জটিল ব্যাধি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন মানবদেহের ৭০ ভাগই হলো পানি। বিশুদ্ধ পানি ও ব্যবহারে ২১ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যুঝুঁকি হ্রাস করা যেতে পারে। যদি খাবার পানি বিশুদ্ধ না হয় তাহলে মানবদেহে রোগব্যাধি বাসা বাঁধবে স্বাভাবিক। শরীরে জীবাণু বাহিত রোগের অন্যতম মাধ্যম এটা। পানি পানের মাধ্যমে জীবাণুগুলো খাদ্যনালি হয়ে মানুষের রক্তে মিশে যায়। ফলে কলেরা, টাইফয়েড, জন্ডিস, হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস, আমাশয়, পেটেরপীড়া ও স্কিন ডিজিজসহ নানারকম রোগ হতে পারে। পরিবেশ সংগঠন পবার এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, চার নদীর পানিতে দূষণের কারণে অক্সিজেনের মাত্রা শূন্যের কোঠায় চলে গেছে। সংগঠনের নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর পানি দূষণ একটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর দূষিত পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় পানির প্রয়োজন মেটাতে আমরা নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছি। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি উজানে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী দূষণমুক্ত ও পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করা না হলে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে পানির অভাবে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এখনই সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন উল্লেখ করেন।
×