ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্ঘুম রাত কাটে সহস্রাধিক পরিবারে

ভাঙ্গা বাঁধ মিশে গেছে নদীতে

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ১৯ মার্চ ২০১৭

ভাঙ্গা বাঁধ মিশে গেছে নদীতে

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ১৮ মার্চ ॥ চেনা জনপদকে এখন মনে হয় অচেনা। তিন বছর আগে নামকাওয়াস্তে ব্লক ফেলে, পাইলিং দিয়ে ভাঙ্গন রোধের কোনমতে চিহ্ন দেখা যায়। উঁচু বেড়িবাঁধটি কৃষিজমির চেয়েও নিচু হয়ে গেছে। এখন শুকনা মৌসুমেও জোয়ারের পানি বাড়িতে হানা দেয়। দুটি বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে সকল পরিবারে চাষাবাদ বন্ধ। নৌকায় চলাচল। পানিবন্দীদশায় পুরো মৌসুম। যেন এক অমানিশার দুঃখে পরিণত হয়েছে এই জনপদ। নিজামপুর গ্রামের মানুষের দুর্দশার ছিটেফোঁটা বর্ণনা মাত্র। হাঁস-মুরগির খাওয়ানোর কুড়া পর্যন্ত নেই। বর্ষায় রান্না তো দূরের কথা; গোসল, পায়খানা করার সুযোগও নেই। যার সঙ্গতি রয়েছে তিনি গ্যাসের সিলিন্ডার কিনে কোনমতে ভাত রান্না করে বুটের ডাল দিয়ে চলছে একেকটি দিন। দুটি বছরের এ দুর্ভোগ আর এক মাস পর তিন বছরে পড়বে। এখানকার নারী এবং শিশুদের দুর্ভোগ যেন আরও বেশি। যোগাযোগের সিলকোটের রাস্তাটি গেল বছরের অস্বাভাবিক জোয়ারে ভেসে গেছে। অন্তত আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। আরও আংশিক বিধ্বস্তপ্রায় দুই কিলোমিটার বাঁধ। এখন এসব মানুষের হয়েছে মরণদশা। এদেরই একজন ষাটোর্ধ আব্দুল হক গাজী। চোখ দুটি ছল ছল করছিল। একপর্যায়ে বলতে গিয়ে চোখে জলের প্লাবন শুরু হয়। তার ভাষায়, ‘নদী আর বাড়ি এক অইয়া গ্যাছে। জায়গা নাই, নাই জমি। আর বাড়ি সরানোর কোন জমিও নাই। কই যামু। খাওয়ান যোগাইতে পারি না। বাড়িতে থাকতে পারি না। ঘরের বেড়াগোড়া সব ভাসাইয়া নেছে।’ পাঁচজনের সংসারে এ মানুষটির ভরসা ছেলে বেল্লাল গাজী যেদিন গাঙ্গে মাছ পায় সেদিন খাবার মেলে, নয়ত উপোস। এ মানুষটি এখন নিঃস্ব। বাড়ি পাল্টাতে পাল্টাতে আর পেছনে সরানোর জায়গা নেই। গেল বছর কয়েকটি ব্লক দিয়ে ঢেউ সামলে নিতেন। এ বছর তাও নেই। এখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে সন্তান-সন্তুতি নিয়ে আছেন আন্ধারমানিক নদীর তীরে। একই দশা আলমগীরের। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে সংসারের যোগান দেবেন না ঘরবাড়ি পাল্টানোর পথ খুঁজবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। একই দশায় হাতেম গাজী, ছলেমান গাজী, সালাম হাওলাদার, খলিল গাজী, মোস্তফা চৌকিদারসহ গ্রামটির দেড় শতাধিক পরিবারের। বাঁধ মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। এ পয়েন্টের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে ভেসে যায় পুরাতন মহিপুর, কোমরপুর, সুধিরপুর, ইউসুফপুরের মানুষের বাড়িঘর। এসব মানুষ এখন কী করবেন তা নিজেরাও জানেন না। শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না চার মাস। শনিবার ওই এলাকা পরিদর্শন করে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড কনসার্ন হেডকোয়ার্টার আমেরিকার ওয়াশিংটন এবং শিয়াটল থেকে আসা একটি প্রতিনিধি দল, যার নেতৃত্ব দেন স্টিভ ডেলফ। এ সময় কেফি টপ, টিম কিল নিওব্লোকার, কান্ট্রি ডিরেক্টর প্রদীপ দাওয়াসহ নেতৃবৃন্দ এসব মানুষের দুরবস্থা দেখে হতবাক বনে যান। পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা দেখে অভিভূত হয়ে যান। এ জনপদে এখন মানুষ দায় ঠেকে বসতি রেখেছেন। কারণ তদের স্থানচ্যুতের নতুন কোন জায়গা নেই। আসছে বর্ষা মৌসুমে এসব মানুষকে বিপদমুক্ত করতে ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ মেরামতে কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, নিজামপুরের বেড়িবাঁধ ভাঙ্গার কারণে দুর্ভোগের বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বহু আগেই অবগত করানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে ওই এলাকার মানুষের ভাষ্য, তাদের যদি নিজেদের শ্রম দেয়ার প্রয়োজন হয় তাহলেও তারা তা দেবেন। কিন্তু বাঁধ মেরামতের ব্যবস্থা করার দাবি তাদের এবং তা বর্ষা আসার আগেই করা প্রয়োজন। নইলে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা রয়েছে।
×