ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাঙ্গামাটিতে ‘পাকি দোস্ত’ ত্রিদিব রায়ের নামে এখনও সড়ক!

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৮ মার্চ ২০১৭

রাঙ্গামাটিতে ‘পাকি দোস্ত’ ত্রিদিব রায়ের নামে এখনও সড়ক!

ফিরোজ মান্না ॥ উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের নামের স্থাপনা এখনও উচ্ছেদ হয়নি। দেশের অনেক এলাকায় রাজাকার আলবদর আলশামসদের নামফলক জ্বল জ্বল করছে। স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও অজানা ভয়ে ওইসব নামফলকে হাতও দেয় না। সম্প্রতি রাঙ্গামাটি শহরে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের নামে সড়ক ও এলাকার নাম চোখে পড়ল। পাকি দোস্ত ত্রিদিব রায়ের নামে রাস্তা ও এলাকার নাম অপসারণ কেন হয়নি তা খুঁজে দেখার ইচ্ছেটা মনে প্রবল হয়ে উঠল। রাঙ্গামাটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে তার নামে সড়ক ও এলাকার নামফলক এখনও কেন শোভা পাচ্ছে। এমন কৌতূহল থেকে রাজাকার ত্রিদিব রায় সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভয়ঙ্কর এই রাজাকারের রোমহর্ষক ইতিহাস। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ত্রিদিব রায়ের নামে সড়ক ও জায়গার নাম কেন এখানে রয়েছে এমন প্রশ্নের সহজ জবাব বেরিয়ে এলো স্থানীয়দের মুখ থেকে। তারা বলেন, গত বছরের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব স্থাপনা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলার নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে ৬০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে শিক্ষা সচিব ও স্থানীয় সরকার সচিবকে নির্দেশ দেয়া হয়। ৬০ দিন পার হয়েছে বহু আগে কিন্তু রাজাকার ত্রিদিবের নামফলক তেমনি রয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ দেশব্যাপী বেশ কয়েকটি স্থাপনা থেকে যুদ্ধাপরাধীদের নাম অপসারণ করেছে। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের নামে থাকা সড়ক ও জায়গার নাম পরিবর্তন করা হয়নি এখনও। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন বলেছে ত্রিদিব রায় মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকা-ে জড়িত ছিল কিনা সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি যদি স্বাধীনতাবিরোধী হন তাহলে তার নামে সড়কের নামফলক তুলে নেয়া হবে। ‘ত্রিদিব নগর ও ত্রিদিব সড়কের’ পুনঃনামকরণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে রাঙ্গামাটি শহরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজন মানববন্ধন করে আসছে। তারা দাবি জানালেও কর্তৃপক্ষ কান দিচ্ছে না। পার্বত্য সমঅধিকার আন্দোলন, রাঙ্গামাটি পার্বত্য বাঙালী ছাত্রপরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ দাবি জানিয়ে আসছে। কয়েক দফা ডিসির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। ১৯৭১ সালে ত্রিদিব রায়ের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী পাক দালাল হিসেবে চিহ্নিত এক উপজাতি নেতার (রাজা ত্রিদিব রায়) সহযোগিতায় পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনী রাঙ্গামাটিতে এসে চুপিসারে অবস্থান নেয়। খবরটি মুক্তিযোদ্ধাদের জানা ছিল না। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ওত পেতে থাকা পাকি সৈনিকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ফেলে। এ দলে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাঙ্গামাটির আবদুল শুক্কুর, এস এম কামাল, শফিকুর রহমান, ইফতেখার, ইলিয়াস, অবদুল বারী, মোঃ মামুন ও আবুল কালাম আজাদ। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র আবুল কালাম আজাদ ও ফুড ইন্সপেক্টর আবদুল বারী ছাড়া অন্যদের পাকবাহিনী নির্মমভাবে অত্যাচার চালিয়ে মানিকছড়িতে নিয়ে হত্যা করে। ত্রিদিব রায়ের সহযোগিতায় পাকিস্তানিরা পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রবসহ আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই হত্যা করেছে। ১৯৭১ সালের নবেম্বরে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায় মিয়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান সরকার তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে ওই বছরই ব্যাংকক পাঠায়। জাতিসংঘের ১৯৭২ সালে জেনারেল এ্যাসেম্বলিতে বাংলাদেশের সদস্য পদ প্রদানের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়ার পর পাকি সরকারের পক্ষে ত্রিদিব রায়কে প্রধান করে একটি প্রতিনিধিদল পাঠায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রাজা ত্রিদিব রায়ের ভূমিকা যেমন জঘন্য তেমনি আরও কয়েক জনের ইতিহাস সুখকর নয়। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং বান্দরবান থেকে এ এস প্রু চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান এ্যাসেম্বলিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। তৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি ইলেকশনে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এই তিন জনপ্রতিনিধির কেউই মুক্তিকামী জনগণের পাশে দাঁড়াননি। ত্রিদিব রায় দেশের মুক্তিকামী জনতার পাশে না দাঁড়িয়ে যোগ দেন পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে। অন্যদিকে এ এস প্রু চৌধুরী যোগ দেন মালেক সরকারের মন্ত্রিসভায়। চাকমা রাজা হিসেবে ত্রিদিব রায় তার প্রভাবাধীন হেডম্যান-কারবারিদের ব্যবহার করে চাকমা যুবকদের দলে দলে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করেন। তাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়ে লেলিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী জনতার বিরুদ্ধে। এ সময় ত্রিদিব রায় ও তার রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একের পর এক হামলা পরিচালনা করে। এতে নির্মমভাবে শহীদ হন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। কয়েকটি অপারেশন ত্রিদিব রায়ের নেতৃত্বে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় তৎকালীন রাজাকার বাহিনী এবং তাদের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে একাধিক হামলা ও হত্যাকা- চালানো হয়েছিল। সেই পাকি দোস্ত জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ নিয়ে কোন অনুতাপ স্বীকার করেনি। মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করে গেছেন। সেই রাজাকারের নামে এখনও সড়কের নামকরণ শোভা পাচ্ছে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল মালেক জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী ৭ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটা করতে হলে একটা সভা করতে হবে। সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী ত্রিদিব রায়ের নামফলক তুলে নেয়া হবে। রাঙ্গামাটি ডিসি মোহাম্মাদ মাঞ্জেুরুল মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, ত্রিদিব রায়ের নামের রাস্তার নামকরণ খুব শীঘ্রই পরিবর্তন করা হবে। পৌরসভার মেয়রসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে একটা মিটিং করা হবে। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে সড়কের নাম ও জায়গার নাম পরিবর্তন করতে হবে। পাহাড়ের বিষয়টা অন্য এলাকার মতো নয়। এখানে কিছু করতে হলে চিন্তাভাবনা করেই করতে হবে। তবে বিষয়টি জেলা প্রশাসনের চেয়ে পৌরসভার দায়িত্ব বেশি। তারা উদ্যোগ নিলে আমরা সহযোগিতা দিতে পারি। এ বিষয়টি পৌরসভার সঙ্গে যৌথভাবেই করা হবে। পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য স্বাধীনতার পরপর আদালতের নির্দেশে যে ১২ জনের নাগরিকত্ব বাতিল ও সহায়-সম্পত্তি ক্রোক করা হয় তার চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়ের বাবা তৎকালীন রাজা ত্রিদিব রায় অন্যতম। বিভিন্ন নথিপত্র থেকে জানা যায়, রাঙ্গামাটিতে ত্রিদিব রায়ের নেতৃত্বে চাকমারা পাকিস্তানের পক্ষে গণহত্যা চালায়।
×