ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশী জঙ্গীদের কোন আইএস কানেকশন নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৮ মার্চ ২০১৭

বাংলাদেশী জঙ্গীদের কোন আইএস কানেকশন নেই

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশে জঙ্গীবাদের প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে সাড়ে সাতশ’ জঙ্গীর জবানবন্দীর পর্যালোচনা চলছে। জবানবন্দীতে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক কোন জঙ্গী গোষ্ঠীর সরাসরি সম্পৃক্ততার তথ্য মেলেনি। এমনকি হালের আলোচনায় থাকা আইএসের সঙ্গেও বাংলাদেশী কোন জঙ্গী গোষ্ঠীর ন্যূনতম যোগাযোগ থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশী জঙ্গীদের আইএসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করার তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশী জঙ্গীরা আইএসের অনুসারী। তবে আইএসের কাছ থেকে বাংলাদেশী জঙ্গীদের কোন সাহায্য সহযোগিতা পাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশী জঙ্গীদের সঙ্গে বাংলাদেশে থাকা কোন কোন জঙ্গীর যোগাযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে থাকা জঙ্গীরা আইএসের আদলে তৎপরতা চালাতে আগ্রহী। বাংলাদেশী জঙ্গীরা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের একাধিক জেলাকে দীর্ঘদিন ধরে তাদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জঙ্গীরা সে চেষ্টায় খানিকটা সফল হয়েছিল। পরবর্তীতে তা ভেস্তে যায়। সারাদেশে চলমান ধারাবাহিক অভিযানে জঙ্গীরা গ্রেফতার হলেও অনেক জঙ্গী জামায়াত-শিবির, এমনকি সরকারী বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের কর্মী বলে পরিচয় দিয়ে জামিনে ছাড়া পেয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা গেছে, আফগান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই দেশে জঙ্গীবাদের গোড়াপত্তন হতে থাকে। জঙ্গীরা নিজেদের মতো সংগঠিত হচ্ছিল। তবে সুযোগ না থাকায় তারা তৎপরতা চালাতে পারেনি। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর জঙ্গীবাদের ভয়াবহ উত্থান ঘটে। দেশে ধারাবাহিক বোমা হামলা শুরু হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত ২১ আগস্ট ও সিরিজ বোমা হামলাসহ মোট ৯৮টি বোমা ও গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর সেই ধারাবাহিকতায়ই দেশে একের পর ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক, ধর্মযাজক ও সেবায়েত হত্যার ঘটনা ঘটে। আনসার আল ইসলামের নামে এসব হত্যার দায় স্বীকার করে আইএসের তরফ থেকে সাইট ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে বিবৃতি প্রকাশিত হতে থাকে। সর্বশেষ গত বছরের ১ জুলাই হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার পর জঙ্গীরা ১৭ জন বিদেশীসহ ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এমন নৃশংস হত্যার দায় স্বীকার করে আইএসের নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এরপর থেকেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোন কোন গোষ্ঠী বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব এবং তৎপরতা রয়েছে অভিযোগ করে আসছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো বলছে, দেশে আইএস বা আন্তর্জাতিক কোন জঙ্গী সংগঠনের তৎপরতা নেই। তবে আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীর অনুসারী রয়েছে। ওইসব অনুসারীদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর কোন যোগাযোগ থাকারও তথ্য প্রমাণ মেলেনি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, হলি আর্টিজানে ঘটনার পর থেকে সারাদেশে জঙ্গী গ্রেফতারে ধারাবাহিক অভিযান চলছে। অভিযানে গ্রেফতার ছাড়াও আগে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের একটি আলাদা প্রযুক্তি নির্ভর ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। সেই ডাটাবেজ স্থান পেয়েছে ২ হাজার জঙ্গীর তথ্য। এদের মধ্যে বিদেশে পলাতক থাকা অনেক জঙ্গী সম্পর্কেও তথ্য রয়েছে। ডাটাবেজে স্থান পাওয়া জঙ্গীদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক জঙ্গীকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও ভয়ঙ্কর হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। যারা বিভিন্ন অপারেশনাল কর্মকা-ে জড়িত ছিল। বাকি দেড় হাজারের মধ্যে এক হাজার জঙ্গী অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ। আর পাঁচ শতাধিক জঙ্গী বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের গোয়েন্দা কার্যক্রম, মনিটরিং, তথ্যপ্রযুক্তি শাখাসহ বিভিন্ন কাজে জড়িত ছিল। তারা কোন অপারেশনে অংশ নিত না। অপারেশনের জন্য তথ্য সরবরাহ করতো। ডাটাবেজে স্থান পাওয়া জঙ্গীরা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হরকাতুল জিহাদ (হুজি), আল্লাহর দলসহ নামে বেনামে জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত ছিল। পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় শাখার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের মধ্যে সাড়ে সাতশ জঙ্গীর জবানবন্দী পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে দেড় শতাধিক জঙ্গীকে টিএফআই (টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন) সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে আরও পাঁচ শতাধিক জঙ্গী সম্পর্কিত তথ্য ছাড়াও নতুন নতুন জঙ্গীর নাম, নতুন নতুন জঙ্গী সংগঠনের নাম এসেছে। নাম আসা জঙ্গীরা ছদ্মনামে পরিচিত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদে তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে জড়িত জঙ্গীদের সম্পর্কে তথ্য ছাড়াও সুইসাইডাল স্কোয়াড, জঙ্গীদের অর্থায়নকারী দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, এনজিও, রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশস্থ একাধিক দূতাবাস, শিক্ষা, আর্থিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক, বীমা প্রতিষ্ঠান, লিজিং কোম্পানি ও ব্যাংকের নাম এসেছে। এই কর্মকর্তা বলছেন, জঙ্গীদের দেয়া জবানবন্দীতে বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব ও তৎপরতা থাকার কোন তথ্য মেলেনি। তবে বাংলাদেশে থাকা জঙ্গীদের প্রায় শতভাগই বর্তমানে আইএসের অনুসারী বলে জানা গেছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে জানা গেছে, আল কায়েদা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি কয়েক বছর আগে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা (একিউআইএস) খোলার ঘোষণা দেন। এমন ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আইএসের ভয়াবহ উত্থান ঘটে। আইএসের কাছে প্রচুর অর্থ রয়েছে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অনেকেই বিভিন্ন দেশ থেকে এবং বেশ কয়েকজন বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশ হয়ে ইরাক ও সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে নানাভাবে বাংলাদেশী জঙ্গীদের যোগাযোগ হয়েছে। আইএসে যোগদানকারীরা মোটা অঙ্কের অর্থ পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশে আইএসের শাখা খুলতে পারলে জঙ্গী সংগঠনটির কাছ থেকে প্রচুর অর্থ পাওয়া যাবে। সেই টাকায় দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা করা হবে। আইএসের মত কোন আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠী যেকোন জঙ্গী সংগঠনকে সরাসরি সহায়তা করে না। সহায়তা পাওয়ার জন্য আলোচিত কর্মকা-ের মাধ্যমে আইএস বা আন্তর্জাতিক জঙ্গী গোষ্ঠীর নজরে আসতে হয়। মূলত আইএসের নজরে আসতেই বাংলাদেশে একের পর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঘটাতে থাকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও নব্য জেএমবি। এসব নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর বাংলাদেশী জঙ্গীরাই আনসার আল ইসলামের নামে সাইট ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে আইএসের নামে সাইট ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে এসব হত্যায় দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রকাশের ব্যবস্থা করে। তবে এখন পর্যন্ত আইএসের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন জঙ্গী সংগঠনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ এবং আইএসের মদদ থাকার কোন তথ্য মেলেনি। আইএসের মদদ পেতেই মরিয়া হয়ে নব্য জেএমবি দেশে একের পর এক নৃশংস জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে। এ ব্যাপারে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলে আসছেন, বাংলাদেশে আইএসের তৎপরতা নেই। তবে বাংলাদেশে আইএসের অনুসারী রয়েছে। বাংলাদেশী জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে নব্য জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আইএসের নজরে আসতে দেশে একের পর নৃশংস জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে। নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তামিম আহমেদ চৌধুরী ইতোমধ্যেই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। আর ব্লগার, লেখক, প্রকাশক হত্যার নেপথ্য কারিগর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের মাস্টারমাই- সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টাকারী মেজর জিয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
×