ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শততম টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান সাকিব

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১৮ মার্চ ২০১৭

শততম টেস্টের সেঞ্চুরিয়ান সাকিব

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ ‘আমার মনে হয় বাংলাদেশে একজন ক্রিকেটার আছেন, যিনি মহাতারকাদের সমপর্যায়ের। সাকিব আল হাসানই বাংলাদেশের সেই ক্রিকেটার, যিনি আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন।’ বাংলাদেশ অলরাউন্ডার সাকিবকে নিয়ে এ কথাগুলো বলেছেন ভারতের গ্রেট ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকর। টেন্ডুলকর যে ভুল বলেননি, তার প্রমাণ যেন কলম্বো টেস্টেও দিলেন সাকিব। বাংলাদেশের শততম টেস্ট এটি। সেই টেস্টে সেঞ্চুরি করে দেখালেন সাকিব। বিপত্তিতে পড়ে যাওয়া দলকে টেনে তুললেন। ভারতের কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকর ও অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্নের মধ্যকার দুটি দল ভাগ হয়ে যখন ‘ক্রিকেট অল স্টার্স’ নামে ২০১৫ সালে টি২০ টুর্নামেন্টটি শুরু করেন, সেই টুর্নামেন্টে বিশ্বের সেরা সব তারকা অংশ নেন। বাংলাদেশ থেকে কোন ক্রিকেটার খেলার যোগ্যতা রাখেন? এমন প্রশ্নে টেন্ডুলকর এমন জবাব দেন। কলম্বো টেস্টে সাকিব দ্বিতীয়দিনে এলোমেলো ব্যাটিং করলেও তৃতীয়দিনে সাবলীলভাবে খেলে সেঞ্চুরিই তুলে নেন। শেষপর্যন্ত ১১৬ রানে গিয়ে থামেন। ততক্ষণে অবশ্য বাংলাদেশ দল শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংসে গড়া রানটে টপকে অনেক দূর চলে যায়। ৪২১ রান করে ফেলে। ৮৩ রানের লিডও নেয়া হয়ে যায়। এমন সময় ১৫৯ বলে ১০ চারে ১১৬ রান করা সাকিব আউট হয়ে যান। সান্দাকানের বলে দুর্দান্ত একটি ক্যাচ ধরেন চান্দিমাল। চা বিরতির কাছাকাছি সময় এসে পড়ে। এমন সময়ই ভুলটি করলেন সাকিব। সান্দাকান বলটি ঝুলিয়ে দেন। সাকিবের লোভ লেগে যায়। লোভ সামলাতে না পেরে উড়িয়ে মারেন। তাতেই বিপদ ঘনিয়ে আসে। মিড অনে দারুণ ক্যাচ ধরেন চান্দিমাল। প্রথমদিনে এলোমেলো ব্যাটিং করতে থাকেন সাকিব। তাতে করে একবার আউট হওয়া থেকেও বাঁচেন। আরেকবার আউটের সম্ভাবনা উঁকি দেয়। কিন্তু দিনের শেষমুহূর্তে বেঁচে যান। সাকিব যেন টি২০ স্টাইলে ব্যাটিং করতে থাকেন। ৮ বলেই ১৮ রান করে অপরাজিত থাকেন। মনে হচ্ছিল, দ্বিতীয় দিনেও এমন পাগলামি করা ব্যাটিং করবেন। সাকিবের প্রথমদিনের ব্যাটিং দেখে বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং কোচ থিলান সামারাবিরা বিস্মিতই হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমার মাথায় কিছু আসছে না।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘স্বাভাবিক খেলা ঠিক আছে, তবে প্রতিপক্ষ কী করছে, কীভাবে ফিল্ডিং সাজাচ্ছে, কী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, এটা তো মাথায় রাখতে হবে। প্রতিদিন আপনি আপনার সহজাত খেলাটা খেলতে পারবেন না। এটা তো একদিনের ক্রিকেট নয়। পাঁচ দিনের ক্রিকেটে আপনাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে।’ ভারতের বিপক্ষে হায়দরাবাদ টেস্টে সাকিব একবার বাজেভাবে শট খেলে আউট হওয়ার পর বলেছিলেন, ‘আমি এভাবেই খেলি। আমি এভাবেই খেলে আসছি গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে। এভাবেই খেলে যাব। আমি শটস খেলেই ৮২ করেছি, ১০ রানেও আমি আউট হয়ে যেতে পারতাম।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘দেখুন, আমি অতশত চিন্তা করে ব্যাটিং করি না। শট খেলেছি ওটা কানেক্ট হয়নি, তাই আউট হয়েছি। ব্যাটিংয়ের সময় আমার শট খেলতে ভাল লাগে। এটাই আমার স্বাভাবিক খেলা। সব সময় এভাবেই খেলতে পছন্দ করি। আমার ব্যক্তিগত কোন লক্ষ্য নেই, চেষ্টা করি দলের জন্য ভাল কিছু করার।’ সাকিবের সেই কথার সূত্র ধরেই দ্বিতীয় দিনের এলোমেলো ব্যাটিং দেখে সামারাবিরা আক্ষেপ করে কথাগুলো বলেন। কিন্তু সাকিব এভাবেই খেলে চলেছেন। আর তাতে করে বার বার আউট হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলেও কলম্বো টেস্টে সেঞ্চুরি না করে মাঠ ছাড়েননি তিন টেস্ট আগেই বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ২১৭ রান (নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে) করা সাকিব। সহজাতভাবে খেলেই, তৃতীয়দিন আরেকটু বুঝে খেলে বাজিমাত করেছেন সাকিব। বৃহস্পতিবার ১১ রানে জীবন পেয়ে সেটাকে খুব ভাল করেই কাজে লাগান সাকিব। বাংলাদেশের সেরা এই অলরাউন্ডার বেশ কয়েকটা ‘সুযোগ’ দিলেও সেগুলো কাজে লাগাতে পারেননি লঙ্কান ফিল্ডাররা। আর তাতেই বেঁচে যান সাকিব, বেঁচে যায় যেন বাংলাদেশও। সেই সুযোগটি পেয়ে সেঞ্চুরিই করে ফেলেন সাকিব। তৃতীয় দিনেও আউট হওয়ার সম্ভাবনায় থাকা কয়েকটি সুযোগ থেকে বাঁচেন। শেষপর্যন্ত পেরেরার লেগ স্টাম্পের বাইরে বলটি সুইপ করে চার হাঁকান। লঙ্কানদের বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করেন। বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের মধ্যে পঞ্চম সেঞ্চুরি করেন সাকিব। সেঞ্চুরির তালিকায় মুশফিকের সঙ্গেই সাকিবের বসবাস। তার উপরে মোহাম্মদ আশরাফুল (৬ টেস্ট সেঞ্চুরি) ও তামিম ইকবালই (৮ টেস্ট সেঞ্চুরি) আছেন। এই শতকটি করে আবার রেকর্ডের পাতাতেই নাম লেখালেন সাকিব। শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করলেন সাকিব। শততম টেস্টটি রাঙিয়ে তুললেন। শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করা অষ্টম ব্যাটসম্যান হচ্ছেন সাকিব। সেঞ্চুরি করে ১৪০ বছরের ইতিহাসে ঢুকে গেছেন। কিন্তু বিশেষ কোন উদযাপন করেননি। সঙ্গী মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত জড়িয়ে ধরেছেন সাকিবকে। একটু পর সাকিব ব্যাট উঁচু করে ধরেছেন। মুচকি হাসিও দিয়েছেন। উদযাপন বলতে এই যা। দ্বিতীয় দিনে এলোমেলো ব্যাটিং করে সমালোচনা তীরে বিদ্ধ হওয়া সাকিবই তৃতীয় দিনের সেঞ্চুরিয়ান হয়ে গেলেন! দেশের শততম টেস্টে সেঞ্চুরির এমন কীর্তি ক্রিকেট বিশ্ব প্রথম দেখেছিল ১৯১২ সালে। অস্ট্রেলিয়ার শততম টেস্টে চার্লস কেলেওয়ে আর ওয়ারেন ব্র্যাডসলি সেঞ্চুরি করেছিলেন। ৩৭ বছর পর ১৯৪৯ সালে এই কীর্তি গড়েন দক্ষিণ আফ্রিকার বিলি ওয়েড। এরপর ১৯৭২ সালে নিউজিল্যান্ডের শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করেন বেভান কংডন আর মার্ক বারগ্রেস। কংডনের সেঞ্চুরিটি ছিল আরও বিশেষ। দেশের শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করা প্রথম অধিনায়ক যে তিনি। এরপর ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের শততম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করেন ওপেনার মাজিদ খান। অধিনায়ক হিসেবে শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করা কংডনের রেকর্ডকে পরে স্পর্শ করেন জিম্বাবুইয়ে অধিনায়ক গ্রায়েম ক্রেমার। গত বছরের নবেম্বরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জিম্বাবুইয়ের শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন অধিনায়ক ক্রেমার। শুক্রবার সাকিব শততম টেস্টে সেঞ্চুরি করার রেকর্ডে ঢুকে গেলেন। সেই সেঞ্চুরিটি বাংলাদেশকেও ভাল অবস্থানে নিয়ে গেল।
×