ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মনোবল চাঙ্গা রাখে সাপ্তাহিক রণাঙ্গন

প্রকাশিত: ০৩:২৭, ১৮ মার্চ ২০১৭

মনোবল চাঙ্গা রাখে সাপ্তাহিক রণাঙ্গন

একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্য দিয়ে সারা দেশের মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু তার আগে ৩ মার্চ রংপুরে পাকিস্তানবিরোধী মিছিলে পাকবাহিনীর গুলিবর্ষণে কিশোর শঙ্কু সমাদ্দারের মৃত্যু রংপুরে বিদ্রোহের আগুন জ্বালায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় রংপুরের সর্বস্তরের মানুষ। মহান মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রংপুর থেকে হাতে গোনা ৩/৪ টি বই এবং স্বল্প সংখ্যক পত্রিকা, স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মুক্তিযুদ্ধে রংপুর’ লেখক-মুকুল মোস্তাফিজ, যুদ্ধকালীন ডিস্ট্রিক্ট লিডার, মুজিব বাহিনী (বিএলএফ) বৃহত্তর রংপুর জেলা, ‘রংপুরের মুক্তিযুদ্ধ’ লেখক-লে. কর্নেল (অব) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক, ‘মুক্তিযুদ্ধে রংপুর : গণহত্যার ভয়াল স্মৃতি’ সম্পাদনা করেছেন ডা. অশোক কুমার ভদ্র। মোহমুক্ত, পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শহীদ পরিবারের স্বজনরা যে দুঃখগাঁথা লিখেছিলেন, ডা. অশোক কুমার ভদ্র তাকে উপজীব্য করে আপন অভিজ্ঞতায় একাত্তরের গণহত্যার ভয়াল স্মৃতি বিধৃত করেছেন তাঁর বইটিতে। গণহত্যার নৃশংস ইতিহাস এবং বধ্যভূমিগুলোর বিস্তারিত বিবরণ স্থান পেয়েছে তাঁর গ্রন্থে। নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের গবেষকরা প্রয়োজনীয় উপাদান খুঁজে পাবেন এ বই থেকে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘মুক্তিযুদ্ধে রংপুর’ গ্রন্থের লেখক প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মুকুল মোস্তাফিজ তাঁর বইটিতে পরম মমতায় লিপিবদ্ধ করেছেন মুক্তিযুদ্ধে রংপুরের ইতিহাস। এ অঞ্চলের স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার, আল-বদর, আল-সামস সদস্য এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও প্রকাশ করেছেন তিনি তাঁর বইটিতে। মুক্তিযোদ্ধা মহানগর কমান্ডার সদরুল আলম দুলু বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় এ বইটিকে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচনা করে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই করতে এ বইটি যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। মুকুল মোস্তাফিজ তাঁর বইয়ের ভূমিকায় দুঃখ করে লিখেছেন, ২০০০ সালে বইটির পা-ুলিপি লেখা শেষ হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : দলিল; ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমি ৬৪ জেলার লেখকদের কাছে পা-ুলিপি চায়। কিন্তু পরবর্তীতে অজ্ঞাত কারণে ঢাকার বাইরের কোন লেখকের বই ছাপানো হয়নি। অর্থের অভাবের কারণে ১১ বছর পর ২০১১ সালে তিনি নিজ খরচে বইটি প্রকাশ করেন। চলতি বছরের চলতি মাসে ‘বীরযোদ্ধা উত্তরাঞ্চল’ নামে আট খ-ের বিশাল গ্রন্থ প্রকাশ করেছে এরিয়া সদর দপ্তর, রংপুর সেনানিবাস। বইটি এখনও বাজারে আসেনি। সেখানে বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে রংপুরসহ গোটা উত্তরবঙ্গের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। অনেক অজানা তথ্য, প্রচুর প্রামাণ্য চিত্র এবং দুর্লভ ছবি বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে রজতজয়ন্তী উদযাপন কমিটি, রংপুর স্মরণিকা প্রকাশ করে। এটি সম্পাদনা করেন মুক্তিযোদ্ধা সমর চন্দ্র পাল। স্মরণিকাটিতে বিভিন্ন লেখকের লেখায় উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, পাকবাহিনী ও তার দোসরদের নৃশংস বর্ররতা ও গণহত্যার ভয়ংকর চিত্র, এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও বীরত্ব গাথা। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শাহ আব্দুর রাজ্জাক, মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম গোলাপ, মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াছ আহমেদ, সাংবাদিক মাহবুব রহমান, মাহবুব আলম, এসএম খলিল বাবু ও সোহরাব দুলাল প্রমুখ। এছাড়া নানা উপলক্ষে বিশেষ করে জাতীয় দিবসগুলোতে রংপুরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত মাসিক, সাপ্তাহিক বা স্মরণিকাগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী প্রকাশিত হয়ে আসছে। তবে দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত যে সমস্ত পত্রিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে, তার মধ্যে রংপুরের ‘সাপ্তাহিক রণাঙ্গন’ পত্রিকাটি উল্লেখযোগ্য। রংপুরের প্রবীন সাংবাদিক (সাবেক এমপি) মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বাটুল এ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি জানান, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা পর আমরা রংপুরের কিছু যুবক মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারতে পালিয়ে যাই। আশ্রয় নেই জলপাইগুড়ির ‘সিতাই রিফিউজি ক্যাম্পে’। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। আমার মাথায় একটা অন্য চিন্তা আসে। সেটি হলো- মুক্তিযুদ্ধে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হলে জনমত তৈরি করা জরুরী। সেক্ষেত্রে মিডিয়া কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করা, সে সময়কার সার্বিক পরিস্থিতির নিখুঁত তথ্য প্রদানের জন্য নিজস্ব প্রকাশনার প্রয়োজন। সে চিন্তা থেকে ভারতের সিতাই রিফিউজি ক্যাম্প থেকে ‘সাপ্তাহিক রণাঙ্গন’ নামে পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই পত্রিকা গোপনে ভারত থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করে মুক্তিযোদ্ধারা। এর মাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের খবরা-খবর। যে কারণে পরবর্তীতে এর নাম দেয়া হয় ‘দৈনিক দাবানল’ যা এখনও রংপুর থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। পত্রিকাটির মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের খবর ফলাও করে প্রচার করে মুক্তিবাহিনীর মনোবল চাঙ্গা রাখার কৌশল নিই। -আব্দুর রউফ সরকার, রংপুর থেকে
×