ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষাবার্তা ॥ পঁচিশ বছরের শিক্ষা ব্যবস্থার দর্পণ

প্রকাশিত: ০৭:০২, ১৭ মার্চ ২০১৭

শিক্ষাবার্তা ॥ পঁচিশ বছরের শিক্ষা ব্যবস্থার দর্পণ

এ এন রাশেদা সম্পাদিত ‘সম্পাদকীয় শিক্ষাবার্তা (১৯৮৭-২০১২) ২৫ বছরের শিক্ষা ব্যবস্থার দর্পণ : সম্পাদকীয় শিক্ষাবার্তা’ বইটি মূলত শুরু থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত শিক্ষাবার্তার সম্পাদকীয়র ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। শিক্ষার গবেষণামূলক এই বইটি প্রকাশ করেছে এ এন রাশেদা, শিক্ষাবার্তা প্রকাশনা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন আহমেদ কাউসার। সম্পূর্ণ অর্থায়ন প্রকাশনা সংস্থাটির। বইটি যেহেতু মুক্তচিন্তার সঙ্গে সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য রন্ধনকে স্পষ্ট করার তাগিদ থেকে বের করা হয় সঙ্গত কারণেই বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে চিন্তার জগতে স্বাধীন এবং স্বচ্ছন্দ গতিতে পথ চলা বিশিষ্ট স্থপতিদের। ফলে উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী ‘শিক্ষাবার্তা’ সাময়িকীটির প্রধান প্রতিপক্ষ। উৎসর্গের প্রথম নামই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. ইউনূস তিনি ২০০৪ সালে ঘাতক জঙ্গীগোষ্ঠীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন। এরই পথপরিক্রমায় যেসব মুক্তচিন্তার লেখককে অকালে, অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় উগ্র সন্ত্রাসবাদীদের হাতে পর্যায়ক্রমে প্রত্যেকের নাম এই উৎসর্গ অধ্যায়ে স্থান পায়। সর্বশেষ নাম দুটো হলো ড. অভিজিৎ রায় এবং অধ্যাপক এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী। দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে সম্পাদক এ এন রাশেদা বিস্তারিতভাবে শিক্ষাবার্তার ২৫ বছরের কর্মসূচী এবং প্রকাশনার ওপর এক বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করেন। শিক্ষাবার্তার প্রথম সম্পাদক অধ্যাপক, গোলাম সামদানী কোরায়শীর হাত ধরে সাময়িকীটির যাত্রা শুরু এবং সমকালীন হরেক রকমের শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ের ওপর আলোকপাত করার এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সকলের এই শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। এমন একটি বার্তাকে সামনে রেখে ‘শিক্ষাবার্তা’ নিষ্ঠার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালনে সদাতৎপর ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল শিক্ষাবার্তার সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ। ফলে ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম সাময়িকীটিকে নানামাত্রিকে উদ্দীপ্ত করেছে। সম্পাদক অত্যন্ত সাবলীলভাবে সম্পাদকীয়তে এসব তথ্য এবং কার্যক্রম পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে সচেষ্ট হয়েছেন। পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা শিক্ষাবার্তার কার্যক্রমে ঝড় তুলেছে এবং দেশবিরোধীদের অশুভ চক্রান্তে সোচ্চার হয়েছেÑ এই প্রসঙ্গও সম্পাদকীয়তে স্থান পেয়েছে। সাময়িকীটি মূলত গোছানো হয়েছে ২০০৩ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ১২২টি সম্পাদকীয় লিপিবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে। অবশ্য বইটির শিরোনামই নির্দেশ করে এর আলোচ্য বিষয়বস্তু। এসব সম্পাদকীয়তে সন্নিবেশিত হয়েছে সমকালীন শিক্ষা ব্যবস্থা, ভাষা আন্দোলনের প্রতি দায়বদ্ধতা, স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যিক চেতনাসহ শিক্ষার সামগ্রিক অঙ্গনে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংযোজন। প্রসঙ্গক্রমে ভর্তি যুদ্ধের তাৎপর্য, এর ত্রুটিবিচ্যুতি এবং এর থেকে উত্তরণের উপায়ও নির্দেশিত হয়েছে অনেক সম্পাদকীয়তে। চিন্তার জগতে স্বাধীন মনোবৃত্তি, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য এবং আদর্শিক চেতনাকে যখন বাকরুদ্ধ করার অপচেষ্টায় মেতেছে ঘোর প্রতিপক্ষরা, তার বিরুদ্ধেও ক্ষুরদার লেখনী চালিয়েছে শিক্ষাবার্তা। সময়ের সচেতন পথিক হিসেবে শিক্ষাবার্তার এই ন্যায়নিষ্ঠতা, সচেতনবোধ, দেশের প্রতি আন্তরিক মমতা সেই কালপর্বের সম্পাদকীয়তে দীপ্যমান হয়ে আছে। শিক্ষা খাতে বাজেটের অপ্রতুলতাও কয়েকটি সম্পাদকীয়তে জায়গা করে নেয়। শিক্ষা একটি জাতির মেরুদ-। অন্ধকারময় বিভীষিকাতে আলোর দ্যুতি ছড়ানোর প্রয়োজনীয় মাধ্যম। সুতরাং প্রদত্ত বাজেটেরও এর গুরুত্ব অপরিসীম। ২০০৪ সালে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের অকাল প্রয়াণের সম্পাদকীয় পাঠক সমাজকে এক বিষণœ আবহে নিয়ে যায়। ২০০৯ সালের সম্পাদকীয় সাজানো হয় মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে ড. খুদার শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে ভিত্তি করে। সর্বক্ষেত্রে এখনও বাংলা ভাষার প্রচলন না হওয়ায় একুশের চেতনা যে আজ বিপন্ন সেটারও উল্লেখ পাওয়া যায় অন্য একটি সম্পাদকীয়তে। যে শিক্ষা জ্ঞানের আলো বিকিরণ করে তা আজ পণ্য বাণিজ্যে রূপ নেয়ার আশঙ্কাও উঠে এসেছে কয়েকটি লেখায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ সমস্ত ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তার দাবিও ব্যক্ত করা হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অপতৎপরতা যেভাবে নিয়ন্ত্রণহীনতার শৃঙ্খলে আটকে পড়ে আছে সেখান থেকে বের হওয়ার উপায়কেও সময়ের দাবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আধুনিক এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষা এবং কর্মজীবনের নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে কি উপায়ে পরিচ্ছন্ন জীবন তাদের দেয়া যেতে পারে সেটাও ভাবতে হবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে। অর্থাৎ ‘শিক্ষাবার্তা’কে সৎ, নিষ্ঠাবান এবং পূর্ণাঙ্গ মানুষ গড়ে তোলার অন্যতম বাহন হিসেবে চিহ্নিত করলে খুব বেশি বলা হয় না। প্রায় ৩০ বছর ধরে চলে আসা ‘শিক্ষাবার্তা’র সামগ্রিক কার্যক্রম শিক্ষা, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ঘিরে আবর্তিত। গল্প, উপন্যাস, কবিতা কিংবা প্রবন্ধ পড়া নয় এ যেন সময়ের নির্দিষ্ট গতিতে চলা বিশেষ বিশেষ কালপর্বের জীবন্ত চালচিত্র। যা পাঠককে সমাজ, সমকালীন ঘটনা প্রবাহ, ব্যক্তিত্ব, আদর্শবোধ, অপসংস্কৃতির আগ্রাসন, আর্থিক সুবিধা কিংবা দুর্বিপাকÑ সব কিছুর ওপর একটি স্পষ্ট এবং পরিচ্ছন্ন ধারণা দেবে। গ্রন্থটির বহুল প্রচার এবং সর্বাঙ্গীন সফলতা কামনা করছি।
×