ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

দ্যা স্কুল অব এথেন্স রেনেসাঁ যুগের অমর শিল্প

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১৭ মার্চ ২০১৭

দ্যা স্কুল অব এথেন্স রেনেসাঁ যুগের অমর শিল্প

নিজস্ব মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, সৃজনশীলতা ও স্বকীয়তা দ্বারা যে শিল্পী শিল্পকলার ইতিহাসে নবদিগন্ত উন্মোচন করেন তিনি রেনেসাঁ যুগের শিল্পীদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী শিল্পী রাফায়েল। স্বকীয় ধারা নির্মাণের ফলে অন্যদের থেকে তাঁকে সহজে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। উচ্চ রেনেসাঁসের আদর্শের সঙ্গে তাঁর শিল্পকলা যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। শিল্পের তত্ত্বজ্ঞান অনুসন্ধানে তিনি ছিলেন যতœশীল। রাফায়েলকে বলা হতো নন্দনশিল্পী। তাঁর চিত্রকর্মের কম্পোজিশন ছিল খুবই শক্তিশালী। ফিগারগুলো সহজ, স্বাভাবিক ও কমনীয়। ধর্মীয় বিষয়কে কাব্যিকতার মোড়কে মুড়ে উপস্থাপিত করেছন। রাফায়েল তাঁর চিত্রে যে আঙ্গিক ও রঙের সমাহার ঘটিয়েছেন তার কোন গভীর অর্থ নেই। সম্পূর্ণ নিজের মতো করে সৌন্দর্য চর্চা ও ধর্মীয় অনুভূতিকে তুলে ধরাই ছিল রাফায়েলের চিত্রকর্মের মূল বৈশিষ্ট্য। ‘দ্য স্কুল অব এথেন্স’ ফ্রেস্কো চিত্রটি রেনেসাঁ যুগের অনন্য বিখ্যাত চিত্র। শিল্পী রাফায়েল মাত্র ২৭ বছর বয়সে এ চিত্রটি আঁকেন। চিত্রটির দৈর্ঘ্য ৭৭০ সেন্টিমিটার। এটি আসলে কোন বিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। বরং প্লাটফর্ম, যেখানে প্রাচীনকালের বিখ্যাত দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, কবি, সবাই একত্রে উপস্থিত হয়েছেন। চিত্রটি ১৫০৯ থেকে ১৫১১ সালের মধ্যে আঁকা হয়েছে। চিত্রে বিশাল গম্বুজবিশিষ্ট একটি হলঘর দেখা যায়। ফিগারগুলোকে মাঝ বরাবর সরলভাবে সাজানো হয়েছে। একটি অংশে প্লেটো এবং অপর অংশে এরিস্টটলকে দেখা যাচ্ছে। তাদের চারপাশে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প-িতবর্গ। প্লেটো কিছুটা বৃদ্ধ যা তাকে জ্ঞানী হিসেবে প্রকাশ করছে। অপরদিকে এরিস্টটল তারুণ্য ও প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর। প্লেটোর হাতে আছে তাঁর বই, এরিস্টটলের হাতে তাঁর পুস্তক। প্লেটোর অংশে দেখানো হয়েছে প্রাচীনকালের দার্শনিকদের একাংশ। যারা দর্শন ও তত্ত্বকথা নিয়ে আলোচনায় মগ্ন। আর এরিস্টটলের অংশে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের সমাবেশ। যারা প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে আলোচনায়রত। প্লেটো ভাববাদী দার্শনিক। তাই উভয়ের দিকে আঙ্গুল দিয়ে এরিস্টটলকে এই জগতের দৃশ্যমান জিনিসের বাইরেও কিছু মহান জ্ঞান আছে সে রকম কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তাঁর ভাবনার অনেকটাজুড়ে ছিল ধর্মবিশ্বাস, আত্মার অমরত্ব ইত্যাদি। অপরদিকে এরিস্টটলের হাত নিচের দিকে। তিনি প্লেটোকে হয়ত বোঝাতে চাচ্ছেন আগে আমাদের জগতকে বুঝতে হবে। প্লেটোর পরনে যে পোশাক তার রঙের অর্থ বাতাস এবং আগুন। দুটাই ভরহীন জিনিস। অপরদিকে বাস্তববাদী দার্শনিক এরিস্টটলের পোশাকের রঙের অর্থ পৃথিবীর মাটির রং ও পানির রং। দুটো মিলেই পৃথিবীর ভরের বৃহদাংশ। রঙের উজ্জ্বল্য এবং গভীরতা সৃষ্টিতে, আলোছাঁয়ার সঠিক বিন্যাসে শিল্পী অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। পূর্ণ সাম্য ও সঙ্গতি ছবিটিতে বিদ্যমান। এই সাম্য ও সঙ্গতি শুধু তাঁর রচিত আকৃতি ও বিন্যাসে নয়, মানসিকতা হতেও পরিস্ফুট। চিত্রটিতে ধর্মীয়ভাব ও ধর্ম নিরপেক্ষ চিন্তাধারার যথার্থ সমন্বয় হয়েছে। আকৃতিগুলো আদর্শবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাতে আছে মর্যাদা ও মহত্ত্বের প্রকাশ। মহান দার্শনিক শিক্ষকদের তিনি সমসাময়িক কালের বিখ্যাত মানুষদের আদলে রূপ দিয়েছেন। পুরো ছবিটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি পশ্চাৎদৃশ্যে স্থান দিয়েছেন সেন্ট পিটার্সের অসমাপ্ত প্যাসিলিকাটিকে। নাটকীয়তা সৃষ্টির জন্য রৈখিক পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহার করা হয়নি। সিঁড়িতে আলু-থালু ভাব ভঙ্গিতে বসে আছেন সক্রেটিস। বামদিকে ওপরে আছে মিউজিক লাইট, আর্চারির দেবতা এ্যাপোলো। ডানদিকে জ্ঞানের দেবী এথেনা। পুরো চিত্রটি রহস্যে ঘেরা। অনেকগুলো প্রতিকৃতির মধ্যেও একটি ভারসাম্য তৈরি হয়েছে এবং শিল্পী রং, রেখা এবং চরিত্রগুলোতে একটি সমগ্রতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিকৃতিগুলোর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও সমগ্রতা সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যটি রাফায়েলের একেবারে নিজস্ব স্টাইল। চিত্রে বাম বরাবর পিথাগোরাসকে লিখতে দেখা যাচ্ছে। সামনের অংশে হেরোক্লিটাস একাকী চিন্তামগ্ন হয়ে বসে আছেন। ফর্ম এবং রেখার মাধ্যমে ফিগারগুলোর মধ্যে মৌলিকত্ব ফুটে উঠেছে। চিরাচরিত রং ও আলোর ব্যবহারের পরিবর্তে ফিগারগুলোকে ভেতর থেকে আলোকিত করে তুলেছেন। সম্মুখ ভাগের ফিগারগুলোর নিশ্চল আরষ্ঠ ভঙ্গির বদলে সহজ গতি ভঙ্গি তুলে ধরা হয়েছে। পেছনের ফিগারগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব কমিয়ে এনে একটা কর্মতৎপরতা এবং স্বতঃস্ফূর্ততা তৈরি করা হয়েছে। ফলে চিত্রটি হয়ে উঠেছে সাবলীল ও প্রাণবন্ত। প্রতিকৃতিগুলো অনেক প্রাণবন্ত ও গতিশীল। কম্পোজিশনের দিগন্ত রেখা বিস্তৃত ও প্রসারিত। বিষয়বস্তুতে আছে বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধি। চিত্রটিতে শিল্পী সময়কে মূর্ত করে তুলেছেন নিপুণ হাতে। চিত্রের ডান দিকে ইউক্লিভ শিষ্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় একটি প্রতিপাদ্য বিশ্লেষণ করছেন। একেবারে ডানদিকের কোনায় রাফায়েল নিজেকে দেখিয়েছেন। জ্ঞানীদের মাঝে জানতে আগ্রহী এক তরুণের মতো তাঁকে দেখা যাচ্ছে। রাফায়েলের বহুমুখী শিল্প সাধনার উৎকর্ষতার চরম প্রকাশ এ চিত্রটি। এখানে তিনি একজন ম্যুরালিস্ট। এ কাজে সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছেন তিনি। প্রমাণ করেছেন শ্রেষ্ঠত্ব। পোশাকের ভাঁজ এবং অভিব্যক্তিতে সবাই এখানে স্বতন্ত্র। ছবিটিতে রাফায়েল দেখিয়েছেন নানা মুগ্ধতার সমন্বয়, একটি বিস্তৃত বিন্যাস রঙের উজ্জ্বল তারতম্যে আলোছাঁয়ার বলিষ্ঠ পদচারণা। দীপ্যমান ও জমকালো মনুমেন্টাল স্থাপত্যের মধ্যে কোলাহল পূর্ণ এ চিত্রটি ১৬শ শতাব্দীর একটি দুঃসাধ্য ও সাহসী পরিকল্পনা। ছবিটিতে এখনও ঝুলছে ভ্যাটিক্যানের প্রাসাদে। জ্ঞানের চার দিগন্ত যথা, ধর্মশাস্ত্র, আইন, কাব্য ও দর্শন থেকে বাণী উৎকীর্ণ করে মহান কতগুলো ফিগার অঙ্কন করেন এ চিত্রে যাকে পাশ্চাত্য ধারায় রেনেসাঁয় উপলব্ধির প্রকাশ বলা চলে। উদ্দেশ্য হলো মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার চারটি স্তম্ভকে চিহ্নিত করা, আবার পোপের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এমন সমস্ত শিক্ষা ও গুণাবলিকে প্রতিষ্ঠিত করা। এই ধারণাকে আরও পরিপূর্ণ রূপ দিতে দেয়ালের কম্পোজিশনে রাফায়েল হাই রেনেসাঁয় শৈল্পিক রীতি এবং আধ্যাত্মিক অনুভূতি দুটিই একসঙ্গে উপস্থাপন করেন ‘স্কুল অব এথেন্সে’।
×