ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

পারিবারিক সহিংসতার শিকার এক বিদেশী নারী সংসদ সদস্য

প্রকাশিত: ০৬:৫৩, ১৭ মার্চ ২০১৭

পারিবারিক সহিংসতার শিকার এক বিদেশী নারী সংসদ সদস্য

গোটা বিশ্ব যখন উন্নয়নের জোয়ারে গা ভাসিয়েছে তখন নারী ও শিশু নির্যাতন মহামারী আকারেই বিস্তৃত হচ্ছে। এর সমাধান কোথায়? কেন এই সহিংস আচরণ, কেন এই সামাজিক অবক্ষয়। সমাজ যেন কোনভাবেই এটা থেকে বের হতে পারছে না। শিক্ষিত পরিবারে যেমন, তেমনি অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারেও প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেÑ নারী। নারীকে প্রতিদিন প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করে চলতে হচ্ছে। রাজনীতি থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি ক্ষেত্রে নারী দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে অবস্থা এখনও অপরিবর্তনীয়। প্রতিবাদ করার মতো সচেতনতাবোধ অনেকেরই থাকে না আবার আত্মবিশ্বাসের অভাবেও অনেকে নির্যাতন প্রতিরোধ করতে পারে না। জরিপে জানা গেছে, বিশ্বের তিন ভাগের একভাগ নারী তাদের জীবনে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগ তাদের পরিবারের কাছের সদস্যদের দ্বারা। পারিবারিক সহিংসতা হচ্ছেÑ নারীর ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন। পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাবেই এমনটি হচ্ছেÑ বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন। আইনে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হয়েছে। ধর্মীয়ভাবেও তাই কিন্তু এই অধিকার সত্যিকার অর্থে নারীরা কতটুকু পায়। অনেক সময় নারী নির্যাতনের হোতা অন্য একজন নারীও হয়ে থাকে। যেমনÑ শাশুড়ি, ননদ বা গৃহকর্ত্রীর হাতে গৃহকর্মী। নারীর প্রতি বৈষম্য প্রতিরোধে জাতিসংঘের উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন গাইডলাইন। এছাড়া, সহিংসতা রোধে বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে পারিবারিক আদালত, ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০ ও ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, সিটিজেনশিপ এ্যাক্ট ২০০৮, হাইকোর্টে নির্দেশিত যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা ২০০৮ পাস হয়েছে, কিন্তু এতেও কি নারী সহিংসতা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। তাই আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা জরুরী। সামাজিক প্রতিরোধ শক্তিশালী করার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে হতে হবে নারীবান্ধব। নারীকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়। সহিংসতার প্রতিবাদ করতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের লিন্ডসের ফেডারেল মেমবার এমা হাসার এমপি সংসদে তার নিজের জীবনে যে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন সেই গল্প তুলে ধরে তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন পাশাপাশি নারী জাতির মাঝে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন সেই বক্তব্যটি ছিল এমনÑ মি স্পীকার, আমি আজ ভিন্ন কিছু নিয়ে বলতে চাই। এই জায়গায় আমি আমার প্রথম বক্তব্যে আমার ৩৬ বছর বয়সের ২৯ বছরই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছি তা তুলে ধরছি। প্রতিনিয়ত পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে টিকে থেকে এবং দীর্ঘ সময় ধরে সেই ক্ষত দূর করে আমি আজ এখানে দাঁড়িয়েছি। আমি জানি পৃথিবীতে অনেক মেয়ে এই নিপীড়নের শিকার কিন্তু নীরবে সহ্য করে যায়। আজ আমি তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছি। তারা ভয় পায় বলতে, তাই নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া গল্প বলে তাদের সাহস যোগাতে চাই যেন নারীরা ঘুরে দাঁড়ায়। এই ‘হুয়াইট রিবন ডে’তে আমি আমার জীবনের অন্ধকার জগতকে আলোয় ভরিয়ে দিতে চাই। আমার জীবনের প্রথম ১৩ বছর কেটে যায় পারিবারিক সহিংসতায় যেখানে আমার মাতাল বাবা দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে আমার মা। আমার বাবার বেড়ে উঠা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। দুজন জার্মান সৈন্য নানাভাবে অত্যাচার করেছে তার মাকে এবং সাত সন্তানকে। আমার বাবা এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছিল বাড়িতে যেখানে অত্যাচার একটি রীতি হয়ে উঠেছিল এবং সে সময় সমাজ এটাকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে চালিয়েছে। শৈশবে এই সহিংসতার হাওয়ায় আমার মা আক্রান্ত হয়। সেই বেদনা বইতে হয়েছে আমাকেও, যা জীবন্তভাবে ফুটে উঠে আমার চোখে ও মনে। সহিংসতার প্রতিটি পর্ব আমাকে ১৩ বছর ধরে দেখতে হয়েছে। বাবা অনেকবার ক্ষমা প্রার্থনা করেছে প্রতিজ্ঞা করেছে নানাভাবে কিন্তু সেটি ছিল ক্ষণিকের। এক সন্ধ্যায় আবার সহিংস হয়ে উঠলেন মায়ের ওপর। মা তখন আমাদের গাড়িতে করে আমাকে এবং আমার বোনকে নিয়ে একরকম পালিয়ে গিয়েছিল। আমার বাবার ওই এলাকা সম্বন্ধে ধারণা ছিল যথেষ্ট তাই এলাকা ছেড়ে আমরা উঠেছিলাম একটি হোটেলে যেখানে নিচে ছিল একটি পাব। কোলাহল ছিল প্রচ-, মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল আর মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে, আমি আমার নিজের বিছানায় নেই, নেই নিজের ঘরে। কারণ আমি সেখানে নিরাপদ নই। এক রাতে যখন আমার মা আমাকে এবং আমার বোনকে নিয়ে বের হওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করছিল তখন বাবা আমাদের ফাঁদে আটকাতে চেয়েছিল। কিন্তু পুলিশ আমাদের সে সময় নিয়ে যায়। আমার আজও মনে পড়ে আমরা বসে আছি পেনরিথ থানায় এবং সেখানকার পুলিশ আমাদের দুধ খেতে দিয়েছিল। এরপরও মা আবার বাসায় ফিরে যায়। আমরা জানি কেন নারীরা ফিরে আসে বারবার যেখানে তাদের জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, সঙ্গে তাদের সন্তানদেরও। আমি দোষ দিই আমার মাকে কেন তিনি ৯০ এর দশকেই বাবাকে ছেড়ে চলে যাননি যদিও এটা পারিবারিক সহিংসতার সমাধান না। অবশেষে যদিও বা সাহস সঞ্চয় হয়েছিল, মা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, বাবাকে ছেড়ে দিয়েছিল কিন্তু সেটিও আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনার পূর্বে নয়। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বলতে হয় সহিসংতার চাকা আমার শৈশব থেকে বেড়ে উঠা পর্যন্ত ১৬ বছর ধরে টানাই ঘুরছিল। আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি আমার প্রতিপক্ষের নেতা বিল শর্টেনকে তার প্রতিনিয়ত আমাকে সহযোগিতা করার জন্য আমার এই বর্তমান পরিস্থিতিতে। আমি আরও ধন্যবাদ দিচ্ছি আমার সহকর্মীদের যারা আমার গল্পটা জানে এবং আমাকে সমর্থন দিয়েছে। আমি স্মরণ করতে চাই পেনরিথ মহিলা সেবা কেন্দ্রের কথা যারা আমাকে ৩০ বছর ধরে সেবা দিয়ে আসছে এবং সঙ্গে আমার মা ও পরিবারের সদস্যদের। অনেক সময় অন্যেরা বলে না বলে সহিংসতার শিকার হয়েও কেউ মুখ খুলে না। আমি আশা করি আমার গল্প আমার ধৈর্য পরিবর্তন আনবে এবং হুয়াইট রিবন আন্দোলন আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস যোগায়। তাই আমাদের নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে হবে।
×