ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাটশিল্প মেলা ॥ নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১৭ মার্চ ২০১৭

পাটশিল্প মেলা ॥ নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য

৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবসকে গুরুত্ব দিয়ে ৯ মার্চ বৃহস্পতিবার থেকে ৫ দিনব্যাপী আয়োজন করা হয় পাটের বহুমুখী পণ্যের এক মনোজ্ঞ মেলা, ‘সোনালি আঁশের সোনার দেশ পাটপণ্যে বাংলাদেশ’ এই বার্তা সামনে রেখে পাটপণ্যের যে সম্ভার দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরা হয় তা যেমন আকর্ষণীয় একইভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নিয়ামকও। পাট বাংলাদেশের একটি সোনালি ঐতিহ্য। কারণ পাটকে কেন্দ্র করে দেশের প্রবৃদ্ধি, রফতানির সিংহভাগের নিয়ন্ত্রক সর্বোপরি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজন মেটানোর গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এক সময় পাটকে বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে এই পাটশিল্প তার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যিক মর্যাদাকে হারাতে বসে। তবে বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনাসহ বিভিন্ন কর্মযোগে এই শিল্প এখন আবার তার সোনালি অতীতে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রতিনিয়তই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই নতুন কর্মোদ্দীপনায় আমাদের পাটশিল্প যেমন ক্রমশ আকাশ ছোঁয়া সমৃদ্ধি স্পর্শ করছে একইভাবে নতুন নতুন উদ্যোক্তারা এই শিল্পে বিনিয়োগ বাড়িয়ে পাটজাত উৎপাদিত পণ্যের সম্ভার তৈরি করে সামগ্রিক অর্থনীতিতে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে যাচ্ছে। লক্ষণীয় এই পাটশিল্পে নারী উদ্যোক্তাদের সফল পুঁজি বিনিয়োগ পাটের বহুমুখী উৎপাদনের যে ধারা তৈরি করেছে ভবিষ্যত তা সমগ্র দেশের জন্য একটি শুভসঙ্কেত। কারণ অর্ধাশ নারী জাতি যদি এই সোনালি ফসলের অংশীদারিত্ব সমানভাবে নিতে না পারে তাহলে নারীরাই শুধু পেছাবে না একই সঙ্গে পাটশিল্পেরও উন্নয়ন ব্যাহত হতে পারে। এবারের মেলায় সেই আশঙ্কা কোনভাবেই দৃশ্যমান হয়নি। সারাদেশ থেকে আগত অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা তাদের পণ্যের বহুমুখী সম্ভার নিয়ে মেলাকে যেমন আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন করেছে একইভাবে উপচে পড়া দর্শনার্থীর চাহিদাকেও পূর্ণ করতে পেরেছে। মেলায় উপস্থিত হয়ে এই চমৎকার মিলনযজ্ঞ স্বচক্ষে না দেখলে এর মাহাত্ম্য অনুভব করা সত্যিই কঠিন। খুলনা থেকে আগত শাহারিয়া সুলতানার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় ‘খুলনা জুটেক্স’-এর একটি পাট শিল্পজাত কারখানার তিনি একজন নারী উদ্যোক্তা। ঢাকায় তার পণ্যসামগ্রী নিয়ে পাটমেলায় যোগ দেয়াটা তার জন্য একটি চমৎকার অনুভূতি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেয়ার পর এমবিএ কোর্সও সমাপ্ত করেন এই প্রতিষ্ঠান থেকে। সাহিত্যের ছাত্রী হয়ে কিভাবে পাটশিল্পের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন এমন একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান- ভেতরের বোধ আর আগ্রহ এবং দেশের সম্পদকে কাজে লাগানোর অদম্য ইচ্ছে থেকেই তিনি এই ব্যবসার সঙ্গে নিজের কর্মযোগকে সংযুক্ত করেন। তার মতে নিজের তত্ত্বাবধানে তৈরি পুতুল, ব্যাগ, শাড়িসহ আরও বিভিন্ন রকম সামগ্রী যখন ক্রেতাদের হাতে তুলে দিতে পারেন তার চাইতে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না। তার ওপর নিজের দেশের সোনালি সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করার মধ্যে যে তৃপ্তি এবং আনন্দযোগ থাকে তার কোন তুলনাই নেই। তার মতে শৈল্পিক বৈভবে তৈরি এসব বিচিত্র কর্মপ্রেরণা আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়াও এক রকম দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। ঢাকার অপর দুই নারী উদ্যোক্তা খালেদা সুলতানা এবং কাউসারী পারভিনও তাদের তৈরি বিভিন্ন রকমের পাটজাত পণ্যসামগ্রীর আবেদন নিয়ে দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করার চেষ্টা করেন। তারা যেমন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অবদান রাখতে চান একইভাবে নিজেকে কর্মক্ষম এবং যোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরিও করতে চান। তাদের সফল উদ্যোগে উৎপাদিত পাটপণ্য যখন সাধারণ ভোক্তাশ্রেণীর হাতে পৌঁছে যায় সেটার অনুভূতি এবং আবেগ সত্যিই অকল্পনীয়। নিজের অর্থায়ন এবং কর্মযোগে যে পণ্য সম্ভার দেশ ও মানুষের সার্বিক কল্যাণে আসে তা যেমন অমূল্য একইভাবে অভাবনীয়। আর এই পরিতৃপ্তিই তাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সাবরিনা ইরেন মিনা এবং অনন্যা দুই সফল নারী উদ্যোক্তা। মাঝখানে আছে প্রজন্মের ফারাক। মিনা এবং অনন্যা মেয়ে। মা-মেয়ে দুই জনের নামেই জুট ফেব্রিক্স এ্যান্ড হ্যান্ডিক্রাপ আছে। মেয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্রী। বাবাও এই জুট শিল্প কারখানায় নিজেকে যুক্ত করেছেন। অর্থাৎ পুরো পরিবারটি এই পাটশিল্পের সঙ্গে জড়িত। যার সোনালি আঁশের সোনালি স্বপ্নকে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবে। নতুন প্রজন্মের এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া বাংলাদেশের পাটশিল্পের অপার সম্ভাবনাকে তুলে ধরে বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রাথমিকভাবে পারিবারিক অর্থায়নে পুঁজি বিনিয়োগ করা হলেও বর্তমানে স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ করে এই শিল্পে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, যা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে চালিকাশক্তির ভূমিকা রাখবে। পাটপণ্য মেলায় নারীদের এই স্বতঃস্ফূর্ত এবং আন্তরিক অংশগ্রহণ পাটশিল্পের সোনালি গৌরবকে আরও মহিমান্বিত করবে। নারীরাও অর্থনতির বিচিত্রমুখী ধারা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখবে না। সমাজের অর্ধাংশ নারী জাতি উন্নয়নের গতিধারাকে নিজেদের প্রয়োজন এবং সমৃদ্ধিতে যদি লাগাতে না পারে তা হলে এগিয়ে যাওয়ার পথপরিক্রমার বিচ্যুতি ঘটতে পারে। আর তাই নারীরা যতই দেশের প্রবৃদ্ধির নিরন্তর গতির সহায়ক শক্তি হবে ততই দেশ ও সব মানুষের শুভযোগের কোন ব্যত্যয় হবে না।
×