ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিম্ন আয়ের পনেরো হাজার মানুষ গৃহহীন ॥ ৫ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি

কড়াইল বস্তিতে ফের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ॥ ৫ হাজার ঘর পুড়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৭ মার্চ ২০১৭

কড়াইল বস্তিতে ফের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ॥ ৫ হাজার ঘর পুড়েছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আবারও রাজধানীর বহুল আলোচিত কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। পুড়ে গেছে অন্তত পাঁচ হাজার আধাপাকা ঘর। যার মধ্যে অধিকাংশই বসতঘর। এছাড়া বেশ কিছু দোকানপাট রয়েছে। গৃহহীন হয়ে পড়েছেন অন্তত পনেরো হাজার নিম্ন আয়ের মানুষ। ভস্মীভূত হয়ে গেছে লাখ লাখ নগদ টাকা। ক্ষতি হয়েছে অন্তত পাঁচ কোটি টাকার সম্পদ। এ নিয়ে গত প্রায় সাড়ে তিন মাসে বস্তিটিতে তিন বার ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটল। ফায়ার সার্ভিসের ২০ ইউনিট প্রায় পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ঘটনাটি ফায়ার সার্ভিসের তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি খতিয়ে দেখছে। বস্তির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেখানে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করার কথা জানান ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। অগ্নিকা-ের কারণ নিয়ে বস্তিবাসীদের কেউ কেউ বলছেন, গ্যাসের চুলা থেকে আগুন লাগলেও, পরবর্তীতে পরিকল্পিতভাবে আগুন ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ দাবি করছেন, গ্যাসের চুলা থেকে আগুন লেগে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় কয়েক হাজার বসতঘর, আধাপাকা বাড়ি, দোকানপাট পুরোপুরি ভস্মীভূত হওয়া প্রায় অসম্ভব বিষয়। এটি পরিকল্পিত নাশকতা। পরিকল্পিত অগ্নিকা-। মূলত জমি দখল করে বাড়ি তৈরি করে ভাড়া দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেই একটি চক্র বস্তিতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বস্তির বাসিন্দা দীন ইসলাম (৪৫) বলছিলেন, বুধবার প্রতিদিনের মতো যথারীতি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত দুইটার দিকে আগুন আগুন বলে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে। তখন পুরো বস্তিবাসী ঘুমে অচেতন। বেরিয়ে দেখি আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। এ সময় মানুষজনের চিৎকার আর গগণ বিদারী আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। যে যার যার মতো কোনমতে ঘুমন্ত মানুষজনকে জাগিয়ে দ্রুত ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়। আমিও তিন সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে বের হয়ে পড়ি। তখন কড়াইল বস্তির ভেতরে থাকা বউবাজার জামে মসজিদের মাইক থেকে আগুন লেগেছে বলে বার ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল। সবাইকে যার যার মতো জীবন রক্ষা করতে বস্তি থেকে বেরিয়ে সামনের মূল রাস্তার দিকে যেতে বলা হচ্ছিল। এ সময় শত শত মানুষ চিৎকার করতে করতে ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে যায়। আগুন এতটাই দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে, কেউ ঘরে রাখা শার্টের পকেটে থাকা টাকাও নিয়ে বের হতে পারেনি। অনেকেই বস্তি লাগোয়া ঝিলে বেঁধে রাখা নৌকায় করে পার হয়ে গেছেন। ভেতরের রাস্তায় আগুন ছড়িয়ে পড়ায়, তারা আর রাস্তা দিয়ে বের হতে পারেননি। মাত্র আধঘণ্টার ব্যবধানে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুনে বাড়িঘরের টিন, ফ্রিজসহ অন্যান্য আসবাবপত্র দুমড়ে মুচড়ে গেছে। অন্তত ১০টি বিকাশের দোকান আর অন্তত ২০টি মুদি দোকান পুড়ে গেছে। দোকানগুলোতে লাখ লাখ নগদ টাকা ও বহু টাকার মালামাল ছিল। তা পুরোপুরি ছাই হয়ে গেছে। বহু গৃহহীন মানুষ বউবাজার বস্তিতে অবস্থিত জামে মসজিদের বারান্দায় ও অজুখানায় আশ্রয় নিয়েছেন। কুমিল্লার বাসিন্দা রাশেদ বলছিলেন, তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। অনেক দিন ধরে টাকা জমাচ্ছেন। ঘরে জমানো নগদ ৫০ হাজার টাকা ছিল। সেই টাকা পুড়ে গেছে। জমানো টাকায় গ্রামের বাড়িতে টিনের ঘর দেয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। কোনমতে ঘর থেকে ঘুমন্ত ছেলে আর আধা কাঁচা ঘুমের মধ্যেই স্ত্রী আর মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে বের করে জীবন বাঁচিয়েছি। পকেটে থাকা প্রায় ৫শ’ টাকারও আংশিক পুড়ে গেছে বলে দেখালেন। তার ঘরের ঠিক তিন ঘর সামনে বউবাজার মসজিদের পূর্ব দিকের একটি ঘর থেকে প্রথম আগুন ছড়ানোর দৃশ্য দেখা গেছে বলে জানান রাশেদ। ফায়ার সার্ভিস জানায়, ফায়ার সার্ভিস ঘটনা জানার পর পরই ঘটনাস্থলে পৌঁছতে সক্ষম হয়। তবে বস্তির ভেতরের রাস্তা সরু থাকায় ফায়ার সার্ভিসের বড় কোন গাড়ি প্রবেশ করতে পারেনি। ছোট ছোট গাড়ি দিয়ে ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকার বিভিন্ন স্টেশনের ২০টি ইউনিট সকাল সাতটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে দুপুর একটা নাগাদ ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে। ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আব্দুল মান্নান, সহকারী উপ-পরিচালক আব্দুল জলিল ও তেজগাঁও স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার ফয়সালুর রহমানের সমন্বয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয় ফায়ার সার্ভিসের তরফ থেকে। কমিটি ঘটনাটির তদন্ত শুরু করেছে। এর আগে গত বছরের ৪ ডিসেম্বর বস্তিটিতে আগুন লেগে প্রায় পাঁচ শ’ বসতঘর পুড়ে। চলতি বছরের ১৪ মার্চ বস্তিটির বউবাজার এলাকার কুমিল্লাপট্টিতে আগুন লেগে অর্ধশত ঘর পুড়েছিল। শেরপুরের বাসিন্দা দীন ইসলাম আরও জানান, তিনি ২৫ বছর ধরে বস্তিটিতে বসবাস করছেন। বস্তিটি অন্তত দেড় শ’ একর সরকারী জমির উপর গড়ে ওঠেছে। এতে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ঘর রয়েছে। সবমিলিয়ে বস্তিতে অন্তত লক্ষাধিক লোকের বসবাস। বর্তমানে ঘরের মালিকদের বেশিরভাগই দু’তলা ঘর তুলেছেন। এতে লাভ বেশি। খানিকটা আলো বাতাস পাওয়া যাওয়ার কারণে উপরের তলায় ভাড়াও বেশি। গত অন্তত দশ বছরে বস্তির দেড় শ’ একর জমির মধ্যে প্রায় ৫০ একর জমির উপর সরকারী বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে ওঠেছে। বাকি এক শ’ একর জমির উপর এখনও বস্তি রয়েছে। বস্তিটি নিয়ন্ত্রণ করছেন অন্তত ৫ হাজার স্থানীয় প্রভাবশালী। এরমধ্যে সব রাজনৈতিক দলের লোকজনই রয়েছে। তারা মিলে মিশে ভোগদখল করছেন। বস্তির একটি অলিখিত নিয়ম আছে। সেটি হচ্ছে, যে যত প্রভাব খাটিয়ে যত ঘর তুলতে পারবে, সেগুলো তার। এসব ঘর ভাড়া দিয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নেয় প্রভাবশালী চক্রটি। পঁচিশ বছর আগে প্রতিটি বস্তি ঘরের নামমাত্র ভাড়া ছিল। সেই বস্তি ঘরেই তিনি এখন সাড়ে ২৩শ’ টাকায় ভাড়ায় থাকছেন। তিনি যে মালিকের বাড়িতে ভাড়ায় থাকেন, সেই মালিকের ৬০টি ঘর রয়েছে। প্রতিমাসে তিনি অন্তত দেড় লাখ টাকা ভাড়া পাচ্ছেন। এরমধ্যে ৫০ হাজার টাকা খরচ থাকলেও, মাসে লাভ হচ্ছে লাখ টাকা। অধিকাংশ বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ অবৈধ। এরসঙ্গে বিদ্যুত ও গ্যাস বিভাগের সংশ্লিষ্ট কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। তারা প্রতিমাসে বাড়ির দখলদারদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে থাকে। বেশির ভাগ সময়ই মালিকরা ঘর তোলার পর তা কয়েক বছরের জন্য বা যতদিন বস্তি থাকে ততদিনের জন্য মোটা অঙ্কের টাকায় বিক্রি করে দেন। অনেক প্রভাবশালী ঘর তুলে বিক্রি করে দেয়ার পর, আবার তা কৌশলে দখল করে নিয়েছে। বস্তিতে আগুন লাগলে ভাড়াটিয়াদের চরম ক্ষতি হলেও, অনেক প্রভাবশালী গোষ্ঠী লাভ হয়। কারণ তারা এমন সুযোগে আবার জমি দখল করে ঘর তুলে ভাড়া ব্যবসা শুরু করে। বা ঘর বিক্রি করে। তারাই মূলত পরিকল্পিতভাবে জমি দখলের জন্য বস্তিতে রাতের অন্ধকারে আগুন লাগিয়ে দেয়। বস্তিবাসীরা চলে গেলে আবার জমি দখল করে বাড়িঘর দোকানপাট তুলে ভাড়া ও বিক্রির ব্যবসা করেন। বউবাজার মসজিদের নিচে বনানী থানা পুলিশের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প দেখা গেছে। সেখানে অন্তত ২০ পুলিশ সদস্যকে দায়িত্বরত দেখা গেছে। ক্যাম্পের ইনচার্জ বনানী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাফিজ উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ক্যাম্পের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় এবং অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে ক্যাম্প পুলিশ ক্যাম্প বসেছে। তারা বস্তির সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।
×