ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চার শতাধিক জঙ্গীর খোঁজে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৭ মার্চ ২০১৭

চার শতাধিক জঙ্গীর খোঁজে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

শংকর কুমার দে ॥ দেশব্যাপী জঙ্গীবিরোধী অভিযান জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। দেশের অন্তত ৭টি সংগঠনের ৪ শতাধিক জঙ্গীর তালিকা নিয়ে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজি-বি) এই তিনটি জঙ্গী সংগঠন খুবই ভয়ঙ্কর ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। সিøপার সেল পদ্ধতিতে সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য নিয়ে নাশকতা ও জঙ্গী হামলার জন্য আত্মগোপন করে আছে গোপন জঙ্গী আস্তানায়। এসব জঙ্গীর কাছে মজুদ রয়েছে ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্র, গ্রেনেড, বোমা, সুইসাইড ভেস্ট, বিস্ফোরক দ্রব্য, যা দিয়ে ভবন পর্যন্ত উড়িয়ে দেয়া যায়। যে কোন সময়ে বড় ধরনের নাশকতা ও জঙ্গী হামলার আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ এসব জঙ্গী গোষ্ঠীর মদদদাতা, অর্থদাতা, আশ্রয়দাতাসহ জঙ্গীদের নির্মূল ও নিয়ন্ত্রণ করাই হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের উচ্চ পর্যায় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, হুজি প্রধান ফাঁসির আসামি মুফতি আবদুল হান্নানকে আদালত থেকে কারাগারে নেয়ার সময়ে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টায় জঙ্গী হামলা, কুমিল্লায় যাত্রীবাহী বাস তল্লাশির সময়ে যাত্রীবেশী দুই জঙ্গীর পুলিশের ওপর আক্রমণ, চট্টগ্রামের সীতাকু-ের এক জঙ্গী আস্তানা থেকে জঙ্গী দম্পতি গ্রেফতার ও অপর জঙ্গী আস্তানায় পুলিশ, র‌্যাব, সোয়াত টিম ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সঙ্গে জঙ্গীদের সংঘর্ষে এক নারীসহ চার জঙ্গী নিহত হওয়ার ঘটনায় আবারও জঙ্গীরা যে সংগঠিত হয়ে তৎপরতা শুরু করেছে তার ভয়াবহ ইঙ্গিত বহন করছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন দেয়ার পর বুধবার আবারও জঙ্গী হামলার আশঙ্কায় নিরাপত্তাজনিত কারণে হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে আদালতে হাজির করা হয়নি। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ৭ জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীরা নতুন করে সংগঠিত হয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। এর মধ্যে হিযবুত তাহরির, জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), বাংলাদেশের জাগ্রত মুসলিম জনতা (জেএমজেবি), শাহাদাত আল হিকমা, হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও নব্য জেএমবি। এর মধ্যে কেবলমাত্র নব্য জেএমবি ছাড়া বাদ বাকি ছয়টি জঙ্গী সংগঠনই নিষিদ্ধ। এসব জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সারাদেশে সহস্রাধিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে মামলার এজাহারভুক্ত জঙ্গীদের মধ্যে অনেকেই জামিনে মুক্ত হয়ে বের হওয়ার পর আর হদিস নেই। আবার অনেকেই গ্রেফতার এড়িয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে এমন সংখ্যা চার শতাধিক জঙ্গী। নিষিদ্ধ করার পরও জঙ্গীরা এক জঙ্গী সংগঠন ছেড়ে অন্য জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে মিশে গিয়ে জঙ্গী তৎপরতা চালাচ্ছে। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলার ঘটনার তদন্তে দেখা গেছে, জঙ্গী সংগঠন জেএমবি নিষিদ্ধ করার পর নব্য জেএমবির ব্যানারে এসে জঙ্গী তৎপরতা চালায় জঙ্গীরা। এর মধ্যে জঙ্গী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীর দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এ ধরনের তথ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গী হামলার ঘটনা দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত হলে জঙ্গীবিরোধী অভিযান ব্যাপক, বিস্তৃত ও কঠোর করার পরও আবার নতুন করে জঙ্গীরা সংগঠিত হয়ে তৎপরতা শুরু করার ঘটনা ভয়াবহ অশনি সঙ্কেত বলে মনে করেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর অদূরে গাজীপুরে ফাঁসির আসামি হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য প্রিজনভ্যানে হামলা ও কুমিল্লায় পুলিশের ওপর জঙ্গীদের হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক হয়। বৈঠক থেকে জঙ্গী হামলার ও নাশকতার আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে দেশব্যাপী জঙ্গীবিরোধী অভিযান শুরু করার জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সুপারিশ করা হয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ দেয়ার পর সারাদেশে জঙ্গীবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। জঙ্গী সন্দেহে অর্ধশতাধিক জনকে গ্রেফতার, জিহাদী বই, লিফলেট, বিভিন্ন ধরনের সরকারবিরোধী বই ও প্রচারপত্র উদ্ধার করা হলেও ভয়ঙ্কর ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির মোস্ট ওয়ান্টেড কোন জঙ্গী গ্রেফতার হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন (জেএমবি), হিযবুত তাহরির, শাহদাত-ই-আল ইসলাম, আল্লার দল, নব্য জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াভহ জঙ্গী হামলা ও শোলাকিয়া ঈদের বৃহৎ জামাতে গ্রেনেড হামলার চেষ্টার পর গত বছর দেশব্যাপী পুলিশ জঙ্গীবিরোধী ধরপাকড় শুরু করা হয়। ঢাকা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর কল্যাণপুর আজিমপুর ও নারায়ণগঞ্জ, মিরসরাইসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বিশেষ অভিযান ও গোলাগুলিতে বহু জঙ্গী নিহত, আহত, গ্রেফতার হয়েছে। এরপর বেশ কিছুদিন জঙ্গী তৎপরতা থেমে যায়। অনেক ক্ষেত্রে কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ থেকে ১৪ মার্চ ঢাকায় ১৫টি দেশের পুলিশ প্রধানদের বৈঠকে জঙ্গীবাদ দমন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই আলোচনায় সিঙ্গাপুর ভিত্তিক গবেষণাভিত্তিক সংগঠনের পরিচালক রোহান গুনারতেœ গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়েছে আইএস, জেএমবি নয়..এমন বক্তৃতা দেয়ার পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ‘জঙ্গীবাদ ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ’ দমনে সহযোগিতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ আর অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া তিন দিনব্যাপী ১৫টি দেশের পুলিশ প্রধান ও ইন্টারপোলসহ কয়েকটি সংস্থার অংশগ্রহণে সম্মেলন শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার সিরিয়ায় এক বাংলাদেশী আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী নিয়াজ মোর্শেদ রাজার ভিডিও প্রকাশ করে আইএস, যা যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ এই ভিডিও প্রকাশ করে। এ বিষয় নিয়েও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, মুফতি আবদুল হান্নানকে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টাকালে টঙ্গীতে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী মোস্তফা কামাল ও কুমিল্লায় পুলিশের ওপর হামলাকারী জঙ্গী আহমেদ আজওয়াদ ইমতিয়াজ তালুকদার ওরফে অমি ও মাহমুদুল হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছেও বেশকিছু জঙ্গীর নাম পাওয়া গেছে, যারা খুবই ভয়ঙ্কর ও দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। এসব জঙ্গী হিযরত করার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে আত্মঘাতী হিসেবে গোপন জঙ্গী আস্তানায় আছে। পুলিশের ওপর আক্রমণ করতে গিয়ে কুমিল্লায় গ্রেফতার হওয়া অমি যেসব জঙ্গীর নাম বলেছে তার মধ্যে বুধবার গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী দম্পতির জসিমউদ্দিনের নামও ছিল। অমির দেয়া তথ্যানুযায়ী রাজধানীর আশকোনা থেকে সটকে পড়া মাঈনুল ইসলাম মুসা চট্টগ্রাম অঞ্চলের নব্য জেএমবির নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিকটবর্তী পাহাড় ঘেরা সীতাকু- এবং মিরসরাইয়ে গড়ে তোলা হয়েছে জঙ্গীদের একাধিক গোপন আস্তানা। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে ব্লক রেইড, টানা অভিযান এবং বন্দুকযুদ্ধে একের পর একাধিক জঙ্গী মারা যাওয়ার পর, নব্য জেএমবি অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে নতুনভাবে সংগঠিত করতে তারা বেছে নিয়েছে সাগর ও পাহাড় বেষ্টিত বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকাকে। গত সপ্তাহে কুমিল্লায় বোমা হামলা করে পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতার হাতে ধৃত জঙ্গী ইমতিয়াজ অমি ও মাহমুদুল হাসান বলেছে, গ্রেফতার হওয়া জসীম সংগঠনের শীর্ষ নেতা মুসার নির্দেশে ঢাকায় যাচ্ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেছে, গেত ৮ মার্চ রাতে মিরসরাইয়ে সন্ধান পাওয়া জঙ্গী আস্তানায়ও অবস্থান ছিল মুসার। তার নির্দেশনা অনুযায়ীই তৈরি করা হয়েছিল শক্তিশালী হ্যান্ড গ্রেনেড। কিন্তু অভিযানের আগেই লাপাত্তা হয়ে যাওয়ায় জালে আটকানো সম্ভব হয়নি মুসাকে। তাই ওই ডেরা থেকে বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মুসাকেও আসামি হিসেবে এজাহারভুক্ত করা হয়েছে। চট্টগ্রামে জঙ্গী দম্পতি গ্রেফতারের পর তাদের দেয়া জবানবন্দী অনুযায়ী অপর জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানো হলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ ঘটেছে। এসব তথ্য পাওয়ার পর জঙ্গীবিরোধী অভিযান মোকাবেলায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে ঢাকা থেকে গেছে বোম ডিসপোজাল টিম, বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সোয়াত টিম। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের জঙ্গীবিরোধী অভিযানের নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধান করেছেন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, জসিম ও আরজিনা নামের যে দুই জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে তারা আইএস নয়। এর আগে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসার পথে গ্রেফতার হওয়া ইমতিয়াজ অমি ও মাহমুদুল হাসানেরও আইএসের সঙ্গে কোন সম্পর্ক থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। যারা আমাদের দেশে আইএস আছে বলছে, তারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ হিসেবে একটি ইস্যু নিয়ে বলাবলি করছে। আমাদের দেশে কোন আইএস নেই, এখানে মধ্যপ্রাচ্যের আইএস আসেনি, যাদের আইএস বলা হচ্ছে তারা গ্রেফতার হওয়া নব্য জেএমবির জঙ্গীরাই। চট্টগ্রামে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ে প্রচুর বিদেশী কাজ করছেন। বিদেশীরা যাতে এই দেশে আসতে ভয় পায়-কাজ না করে চলে যায় সেই ভয় লাগাতেই জঙ্গীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রামের যেই অঞ্চলগুলোতে জঙ্গীরা সংগঠিত হচ্ছে, সেসব এলাকা জামায়াত-শিবিরের প্রধান এলাকা। রাজনৈতিক কোন অদৃশ্য মহল থেকে আবার জঙ্গীদের সংগঠিত করা হচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হতে পারে বলে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে নেতৃত্বদানকারী পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
×