ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অভিযানের টুকিটাকি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৭ মার্চ ২০১৭

অভিযানের টুকিটাকি

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামের সীতাকু- পৌর এলাকায় মাত্র দুই কিলোমিটার দূরত্বে দুটি জঙ্গী আস্তানা। বুধবার দুপুরের পর থেকে এ নিয়ে ব্যাপক উৎকণ্ঠা স্থানীয়দের মাঝে। আতঙ্কের একটি রাত কাটে আশপাশের বাসিন্দাদের। বৃহস্পতিবার সকালে আইনশৃঙ্খলার বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের সফল অভিযানে উৎকণ্ঠার অবসান ঘটে। একই এলাকায় জঙ্গীদের এমন দুটি অবস্থানের কথা ভেবে শিউরে উঠছেন পৌর এলাকার লোকজন। শেষ পর্যন্ত জঙ্গীবিরোধী অভিযানের সফল পরিসমাপ্তিতে এসেছে স্বস্তি। প্রথম যেভাবে সন্ধান লাভ ॥ জঙ্গীদের প্রথম আস্তানাটির সন্ধান মেলে পৌরসভার আমিরাবাদ এলাকার সাধন কুঠির নামের একটি ভবনের নিচতলায়। কাপড় ব্যবসায়ীর পরিচয় দিয়ে পরিবারটি চলতি মাসের ২ তারিখে সাড়ে ৬ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় ওঠে ভবনের একটি ফ্ল্যাটে। কিন্তু তাদের গতিবিধি শুরু থেকেই সন্দেহজনক মনে হয় বাড়ির মালিক সুভাষ দাশের পরিবারের সদস্যদের। বিশেষ করে সারাদিন দরজা-জানালা বন্ধ থাকা এবং ঘরের ভেতরেও সর্বদা হিজাব পরে থাকা মহিলা এবং অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে চলাফেরার চেষ্টা সন্দেহ জাগায়। বাড়ির মালিক সুভাষ দাশ জানান, জসিম নামের এ ব্যক্তি নিজেকে কাপড় ব্যবসায়ী পরিচয় দেয়। সে জানায়, চট্টগ্রাম শহর এবং ঢাকায় তার কাপড়ের ব্যবসা রয়েছে। সীতাকু-েও এ ব্যবসা চালু করতে চায় সে। মার্চ মাসের ১ তারিখে এক হাজার টাকা এডভান্স দিয়ে পরদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে তারা ফ্ল্যাটে ওঠে। সুভাষ জানান, কদিনের জন্য তিনি জামালপুরে ছিলেন। আসার পর তার মা জানান, ফ্ল্যাটে নতুন আসা ভাড়াটিয়াদের তার সন্দেহ হচ্ছে। এ তথ্য জেনে গত ১৩ মার্চ তিনি ফ্ল্যাটে যান কিছু টাইলসের কাজ করানোর অজুহাতে। সেখানে গিয়ে দেখেন বাসায় দুটি শীতল পাটি বিছানো। তার ওপর কিছু বৈদ্যুতিক তার, সার্কিট এবং ইলেকট্রনিকস ডিভাইস। জানতে চান, ‘এগুলো দিয়ে কি করা হয়। আপনারা তো কাপড়ের ব্যবসা করেন।’ জবাবে জসিম জানায়, তার এক শ্যালক সার্কিট তৈরি করেন। সুভাষ জানান, তিনি ওখান থেকে একটি সার্কিট এবং সব ধরনের একটি করে আইটেম নিয়ে এক মেকানিককে দেখান। ওই মেকানিক জানান, এগুলো বোমা তৈরির সরঞ্জাম, অর্থাৎ টাইমার। এরপরই তাদের বাসা ছেড়ে দিতে বললে তারা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তিনি তার স্ত্রী ও অপর দুই সহযোগী জঙ্গী দম্পতিকে পাকড়াও করে ফেলেন। অন্তত ২০ মিনিট চলে ধস্তাধস্তি। খবর পেয়ে পুলিশ এসে জঙ্গীদম্পতিকে তাদের শিশুসন্তানসহ আটক করে নিয়ে যায়। আস্তানা ছায়ানীড় ॥ সাধন কুঠির থেকে আটক জঙ্গীদম্পতিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর বেরিয়ে আসে প্রেমতলার ছায়ানীড়ে জঙ্গী আস্তানার তথ্য। দেরি না করে পুলিশ ছায়ানীড় ভবনটি ঘিরে ফেলে। সেখানে ভবনটির নিচতলায় মাসিক ৬ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গীরা। তাদের কোন পরিচয় এখনও জানা যায়নি। জঙ্গীরা ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয় গত প্রায় দু’মাস আগে। ফ্ল্যাটের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ থাকত। ভবনটিতে মোট ৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে। তন্মধ্যে নিচতলায় জঙ্গীরা ছাড়া অন্য তিনটিতে থাকে ভাড়াটিয়া। উপরের তলার চারটির একটির মধ্যে থাকে মালিক পরিবার। দুটিতে ভাড়াটিয়া। একটি রয়েছে খালি। সাধন কুঠির থেকে আটকদের তথ্য অনুযায়ী পুলিশ অভিযান চালাতে গেলে ভেতরে থাকা জঙ্গীরা পুলিশের প্রতি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। গ্রেনেডের পাশাপাশি গুলিও চালানো হয়। এতে পুলিশকে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে হয়। তবে খুব দ্রুতই বাড়িটির প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে আশপাশের সড়ক ঘিরে ফেলা হয়। সীতাকু- থেকে পাঠানো তথ্যে ছুটে যায় চট্টগ্রাম শহর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ। এছাড়া র‌্যাব, সোয়াত, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরাও সেখানে পৌঁছে যায়। রাত ১টা নাগাদ ঢাকা থেকে আসে সোয়াত টিমের সদস্যরা। তারা সমন্বয় বৈঠক করে করণীয় ঠিক করেন এবং ভোর ৬টার দিকে শুরু করেন অভিযান। এ অভিযানে নিহত হয় এক নারীসহ ৪ জঙ্গী। তন্মধ্যে নারীসহ ২ জঙ্গী মারা যায় পুলিশের গুলিতে। বাকি দু’জন আত্মঘাতী হয়। তন্মধ্যে একজনের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। সোয়াত, সিটিইউসহ পুলিশের তৎপরতা ॥ সীতাকু-ের এ দুটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান লাভের পর উর্ধতন মহলের নির্দেশে বুধবার থেকেই পুলিশ, র‌্যাব এবং পরবর্তীতে সিটিইউ (কাউন্টার টেরজিম ইউনিট) ও সোয়াত বাহিনীর সদস্যরা ভবন ঘিরে অবস্থান নেয়। সোয়াতের শক্তিশালী একটি দল ঢাকা থেকে গভীর রাতেই পৌঁছে। রাতভর পরিকল্পনার বিভিন্ন ছক করে বৃহস্পতিবার ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অভিযান শুরু হয়। অভিযানের শুরুতে জঙ্গীরা অভিযানকারীদের প্রতি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। অভিযানকারীদের প্রস্তুতিও ছিল একেবারে চূড়ান্ত। তারাও এর পাল্টা জবাব দেয়। এ পর্যায়ে ছাদে থাকা এক জঙ্গী গুলিবিদ্ধ হয় এবং তার শরীরে যে আত্মঘাতী বোমা ছিল তার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আরেকজন গুলিতে সিঁড়িতেই প্রাণ হারায়। এরপর নিচতলার কক্ষে প্রবেশ করার পর এক মহিলা ও এক পুরুষ জঙ্গী এবং সঙ্গে এক শিশুর মৃতদেহ পাওয়া যায়। জিম্মিদের উদ্ধার ॥ অভিযানের পর ফ্ল্যাটের নিচতলা ও দোতলায় ৫ ভাড়াটিয়া ও মালিক পক্ষের ফ্ল্যাটের দরজা-জানালা ভেঙ্গে তাদের উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে ভবন মালিক রেহেনা বেগম ও তার ছোটপুত্র নাসিরকে আটক করা হয়। এরপর বড় ছেলে যিনি চট্টগ্রাম মহানগরীর খুলশী এলাকায় থাকেন। তিনিও গিয়েছিলেন ঘটনা শুনে। পুলিশ তাকেও আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। উদ্ধারপ্রাপ্তদের বর্ণনা ॥ ছায়ানীড় ভবনে ৫টি পরিবার ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকত। তাদের মধ্যে যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন- সীতাকু-ের বাঁশবাড়িয়ার ইউপি সদস্য সেলিম উদ্দিনের পরিবার, একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আনিসুর রহমানের পরিবার, একটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির পরিবার, আবুল কাশেম নামের এক ব্যক্তির পরিবার, মিরসরাইয়ের মস্তাননগর হাসপাতালের এক নার্সের পরিবার এবং বাড়ির মালিক পরিবার। উদ্ধার পাওয়ার পর তাদের অনেকেই স্বস্তি প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আতঙ্কের একটি রাত কেটেছে। বুধবার দুপুর থেকে রাতভর এবং বৃহস্পতিবার সকালে অভিযান সমাপ্তির আগ পর্যন্ত তারা জীবন শঙ্কায় ছিলেন। জঙ্গীদের আল্লাহু আকবর ধ্বনি ॥ বৃহস্পতিবার ভোরে অভিযান শুরু হওয়ার পর জঙ্গীরা ক্রমাগতভাবে ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিতে থাকে। পাশাপাশি অভিযানকারীদের প্রতি লক্ষ্য করে গুলি ও হ্যান্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকে। শক্তিশালী একটি আত্মঘাতী গ্রেনেড বিস্ফোরণের পূর্বেও তারা উচ্চৈস্বরে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ধ্বনি দেয়। ঘড়ির কাঁটায় তখন ছিল সকাল ৬টা ২৮ মিনিট। ছায়ানীড় ভবনের পার্শবর্তী একটি ঘরের মালিক শহীদুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, রাত থেকে সকাল পর্যন্ত তিনি জঙ্গীদের কার্যক্রম কিছুটা প্রত্যক্ষ করেছেন। নিজেও প্রাণভয়ে ভীত ছিলেন। তার বাড়ি সংলগ্ন উঠান ও সন্নিহিত এলাকা এবং ছাদে জঙ্গীদের শরীরের টুকরো টুকরো অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। সোয়াতের বর্ণনা ॥ অভিযান শেষে সোয়াত বাহিনীর কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জঙ্গীদের এত বড় আস্তানা অর্থাৎ বিস্ফোরক ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জামাদির ভা-ার ইতোপূর্বে তারা পাননি। এসপি বললেন, দুঃসাহসিক অভিযান ॥ চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের পর তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বললেন, এটা একটি দুঃসাহসিক অভিযান। এক্ষেত্রে আশপাশের লোকজনের নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। যে কারণে বুধবার রাতে কোন এ্যাকশানে যাওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে আইজিসহ উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল। সে কারণে রাতভর তাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতিবার ভোরেই অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তিনি বলেন, নিজেদের নিরাপদ রেখে ও জিম্মিদের নিরাপত্তা বজায় রেখে অভিযান চালানো ছিল চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সফলভাবে অভিযান সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছি।
×