ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মীরসরাই-সীতাকুণ্ড জঙ্গীদের নতুন টার্গেট যে কারণে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৭ মার্চ ২০১৭

মীরসরাই-সীতাকুণ্ড জঙ্গীদের নতুন টার্গেট যে কারণে

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ দেশে যেসব জঙ্গী সংগঠন এখনও সহিংস সন্ত্রাসে তৎপর তার মধ্যে জেএমবি শীর্ষে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে স্বীকারও করা হয়েছে। এ জেএমবি নবরূপে স্থান বদল করে ঘাঁটি গেড়েছে মীরসরাই-সীতাকু- এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে। বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা অনুযায়ী একদিকে সমুদ্র ও অপরদিকে পাহাড়বেষ্টিত এই বেল্টটির অবস্থান বেশ বড়। এছাড়া ঘনবসতি অর্থাৎ জনবহুল। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজনের বসবাস এ এলাকায়। এই বেল্টটির বিশেষ করে মীরসরাইকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে বড় ধরনের একটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক জোন। যেখানে বিদেশী বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের অবস্থান ও আনাগোনা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে টিকতে না পারে জেএমবিসহ জঙ্গী সংগঠনগুলো চট্টগ্রামের এই বেল্টকে টার্গেটে এনেছে। বিশেষ করে উন্নয়ন কর্মকা-ে জড়িত বিদেশীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন প্রয়োজনে হত্যা করাই এদের মূল লক্ষ্য। সীতাকু-ের বিভিন্ন পয়েন্টে জেএমবি যে ঘাঁটি গেড়েছে তা প্রায় গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রচারের আলোতে এসেছে। এ নিয়ে পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তৎপর রয়েছে। সম্প্রতি কুমিল্লায় একটি বাসে তল্লাশি চলাকালে পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এরপর পুলিশী অভিযানে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার হয় দুই জঙ্গী। এদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে আরও নতুন তথ্য। ৭ মার্চ রাতেই মীরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। সেখান থেকে উদ্ধার হয় ২৯টি হাতবোমা, ৯টি চাপাতি ও ২৮০ প্যাকেট বিয়ারিংয়ের বল এবং ৪০টি বিস্ফোরক জেল। এরপর উর্ধতন পুলিশের নির্দেশে চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে ভাড়ায় বসবাসরতদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। পাশাপাশি চলতে থাকে ব্লক রেইড। এ পরিস্থিতিতে গত মঙ্গলবার সীতাকু-ের আমিরাবাদের সাধন কুটিরে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। সেখান থেকে গ্রেফতারকৃত এক জঙ্গী দম্পতিকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে প্রায় ২ কিলোমিটার অবস্থিত পৌর সদর এলাকারই প্রেমতলায় ছায়ানীড় নামক ভবনের নিচ তলার আরেকটি জঙ্গী আস্তানার তথ্য। মঙ্গলবার রাত থেকে পুরো ভবনটি ঘিরে ফেলার পর জঙ্গীরা দফায় দফায় শক্তিশালী গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায়। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করেও গ্রেনেড ছুড়ে। পুলিশ ফাঁকা গুলির মাধ্যমে পাল্টা জবাব দেয়। গভীর রাত থেকে পুলিশ ও জঙ্গীরা অনেকটা নীরব থাকে। পুলিশ অভিযানের ছক আঁটতে থাকে। আর অপরদিকে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে ভবনটির ছাদে ও বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু ফোকাস লাইট লাগিয়ে ভবন এলাকাটি আলোকিত করে রাখে। পাশাপাশি মাইক দিয়ে তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয় দফায় দফায়। কিন্তু এতে কোন ফল আসেনি। ফলে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সোয়াত ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যদের দিয়ে সাঁড়াশি অভিযানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যা শুরু হয় বৃহস্পতিবার সকাল ৬টার খানিক পর। এ অভিযানের সময় উভয় পক্ষের গোলাগুলি এবং জঙ্গীদের গ্রেনেড নিক্ষেপের পুরো এলাকা প্রকম্পিত হতে থাকে। এক ফাঁকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের নিয়ে ছায়ানীড় ভবনের নিচ তলার অবশিষ্ট তিনটি ফ্ল্যাটের জানালার গ্রিল ও দরজা ভেঙ্গে নারী-পুরুষ শিশুসহ ২২ বাসিন্দাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এরপর অভিযান শুরু হয় জঙ্গী অবস্থানের ফ্ল্যাটটিতে। পুলিশী অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে জঙ্গীরা প্রথমে একাধিক গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে সোয়াতর দুইজন সদস্য আহত হয়। এরপর সোয়াত ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা জঙ্গী আস্তানার ফ্ল্যাটটিতে প্রবেশ করলেও তার আগেই তারা সুইসাইড ভেস্ট দিয়ে আত্মঘাতী গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে এক মহিলাসহ ৪ জঙ্গী ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়। একমাত্র মহিলা জঙ্গীর মৃত দেহ ছাড়া অন্য তিনজনের দেহ ছিল ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। মাথার খুলি থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ উড়ে গেছে। ফ্ল্যাটের ফ্লোরজুড়ে ছিল রক্তাক্ত অবস্থায়। মীরসরাই ও সীতাকু- গত ৮ দিনে পর্যায়ক্রমে তিনটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনা প্রমাণ করে জঙ্গীরা এ অঞ্চলকে টার্গেট করেছে। গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের ধারণা, এ দুটি উপজেলা ঘনবসতির। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে এরা বিভিন্ন পয়েন্টে ঘর ভাড়া নিয়ে জঙ্গী সন্ত্রাসে লিপ্ত রয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সীতাক- এলাকাটি পুরোপুরি একটি বৃহত্তম ই-াস্ট্রিয়াল বেল্ট এখানে স্থানীয়দের পাশাপাশি বিদেশী বিশেষজ্ঞদের অবস্থান রয়েছে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী মীরসরাই উপজেলায় পুরোদমে এগিয়ে চলেছে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার কাজ। এসব উন্নয়ন কর্মকা-ে ব্যাঘাত ঘটাতেই জঙ্গীরা এ বেল্টে আস্তানা গেড়েছে বলে পুলিশের গোয়েন্দাদের ধারণা। সীতাকু--মীরসরাই এলাকার বড় একটি অংশ যেহেতু পাহাড় অধ্যুষিত সেহেতু সেসব পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে এদের ঘাঁটি রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের তথ্য রয়েছে। ইতোপূর্বে গ্রেফতারকৃত জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদে মীরসরাইয়ের সোনাপাহাড় নামক এলাকায় জঙ্গী প্রশিক্ষণ ঘাঁটি রয়েছে বলে তথ্য পায়। কারা সেখানে প্রশিক্ষণ দিত তাদের নামও উঠে আসে। জঙ্গীদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত একটি গোপন চিঠিও উদ্ধার হয়েছিল। যেখানে তাদের জঙ্গী কর্মকা-ের ফিরিস্তিও মিলে। কিন্তু এ নিয়ে জোরালো কোন অভিযান চলেনি। সম্প্রতি জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা জেলা আইনশৃঙ্খলার মতবিনিময় সভায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুছা নামের এক জঙ্গী কমান্ডারের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বিস্তৃতি ঘটানো হয়েছে বলে দাবি করেন। মুছা বৃহত্তর চট্টগ্রামের জঙ্গী সন্ত্রাসের সমন্বয়ক বলেও তিনি উল্লেখ করেন। বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে কুমিল্লার ঘটনার পর আটক দুই জঙ্গী মাহমুদুল ও জসিমকে জিজ্ঞাসাবাদের পর। বৃহস্পতিবার জেলা পুলিশ সুপার আবারও জানিয়েছেন, মুছাই এখন জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের শীর্ষ নেতা। প্রায়শ তার অবস্থানে পুলিশে হানা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু ঘন ঘন স্থান বদলের কারণে তাকেও পাকড়াও করা যাচ্ছে না।
×