ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মেলান্দহে এডিপির বরাদ্দ

পৌনে তিন কোটি টাকা লোপাট

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ১৭ মার্চ ২০১৭

পৌনে তিন কোটি টাকা লোপাট

নিজস্ব সংবাদদাতা, জামালপুর, ১৫ মার্চ ॥ মেলান্দহ উপজেলায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) ২ কোটি ৬৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকা হরিলুট হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা চেয়ারম্যানের যোগসাজশে কাগজে কলমে ৪৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নের শতভাগ অগ্রগতি দেখানো হলেও বাস্তবে তারও কোন হদিস মিলেনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেলান্দহ উপজেলায় ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) ৪ কিস্তিতে বরাদ্দ আসে ২ কোটি ৬৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। কাগজে কলমে ৪৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নের শতভাগ অগ্রগতি দেখানো হলেও বাস্তবে আর দেখা মেলেনি। পুরো টাকাই হরিলুট হয়েছে। তাদের দেখানো ৪৩টি প্রকল্পের ৯টি টেন্ডারে, ৭টি স্পট টেন্ডারে ও বাকি ২৭টি পিআইসি কমিটির মাধ্যমে বাস্তবায়ন দেখানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য দিতে হয়েছে বরাদ্দকৃত টাকার শতকরা ১০ ভাগ। আবার বিল নেয়ার সময় দিতে হয়েছে শতকরা ১০ টাকা হারে। এ বরাদ্দের শতকরা ২০ ভাগ অর্থাৎ ৫০ লক্ষাধিক টাকা পিসি বাবদ, পিআইসির নামে দেখানো ২৭টি প্রকল্পে শতকরা ৫০ ভাগসহ সন্তান, ভাতিজা ও বেয়াই ইউপি চেয়ারম্যানের নামে ঠিকাদারি লাইসেন্সে নামমাত্র কাজ করে সর্বসাকল্যে প্রায় ২৫ লাখ টাকা লুটে নিয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান পুত্র জাহিদ জগলুল হায়দার লেলিনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইএলটি ট্রেডার্সের কাজের নাম-মেলান্দহ উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসবাবপত্র সরবরাহ, চুক্তিমূল্য-২২ লাখ টাকা, উপজেলা চেয়ারম্যানের বেয়াই ৭নং চরবাণী ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন ভুট্টোর নামীয় প্রতিষ্ঠান মেসার্স ভাবনা এন্টারপ্রাইজের নামে শিহাটা গমিজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় উন্নয়নে ২০ লাখ টাকা ও মেসার্স শহিদুর রহমান, মেলান্দহ, জামালপুরের নামে মেলান্দহ উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া সামগ্রী বিতরণ বাবদ ৫ লাখ টাকা, মেলান্দহ উপজেলাধীন যুব মহিলাদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ বাবদ ১২ লাখ টাকা ও মাহমুদপুর ইউজেডআর-হরিনাপাই সমাজকল্যাণ ভায়া টেস্টি ফিশারি রাস্তায় ২.৫০ বর্গমিটার বক্স কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্প বাবাদ ৭ লাখ টাকা। ২৪ লাখ টাকা মূল্যের প্রাক্কলিত ব্যয়ে এ তিনটি প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন দেখানো হলেও স্বয়ং উপজেলা চেয়ারম্যান তার দায়ভার গ্রহণ করে সিংহভাগ টাকা লোপাট করেন। চেয়ারম্যান পুত্র লেলিনের প্রকল্পে উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে আসবাবপত্র সরবরাহে চুক্তি মূল্য ছিল ২২ লাখ টাকা। ঠিকাদার কাগজে কলমে ৩১টি বিদ্যালয়ে ৪৩১ জোড়া উঁচু-নিচু বেঞ্চ বিতরণ দেখিয়েছেন। তার দেয়া বিতরণ তালিকায় দেখা যায় অনিয়ম। বিদ্যালয় প্রধানেরা অভিযোগ করেন, তাদের নিম্নমানের বেঞ্চ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া তালিকায় উল্লিখিত পরিমাণ বেঞ্চ তাদের দেয়া হয়নি। বিতরণের তালিকায় প্রাপ্তি স্বাক্ষরেও অনেক শিক্ষকের স্বাক্ষর নিজেরাই দিয়েছেন বলেও তারা অভিযোগ করেন। সরবরাহকৃত প্রতি জোড়া উঁচু-নিচু বেঞ্চে বরাদ্দ অনুযায়ী মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি। ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নে যুব মহিলাদের সেলাই মেশিন বিতরণ প্রকল্পে পিআইসির সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য মোখলেছুর রহমান জানান, তিনি এ প্রকল্পের কথা কিছুই জানেন না। তবে চেয়ারম্যান তার কাছ থেকে তিনজনের নাম নিয়েছিলেন। এ প্রকল্পে প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ২ লাখ টাকা। নয়ানগর ইউনিয়নের পশ্চিম বুরুঙ্গা মাদ্রাসা উন্নয়ন প্রকল্পে প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ২ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে পিআইসির সভাপতি ইউপি সদস্য আব্দুল জলিলও জানালেন অভিযোগের কথা একই কথা। এ মাদ্রাসায় ৯ ফুটি ২৬ পাতা টিনের ফর্দ ও ১০টি ৮ ফুটি খুঁটি দিয়েই ২ লাখ টাকা হজম করা হয়। আব্দুল জলিল আরও জানান, চেয়ারম্যানের ম্যানেজার নুর হক সব জানেন। নাংলা ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডে হতদরিদ্রদের টিউবওয়েল বিতরণ প্রকল্পে প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ২ লাখ টাকা। পিআইসির সভাপতি ছিল ইউপি সদস্য আসমা বেগম। মাস্টার রোল দাখিল করেন নাজমা বেগম নিলুফা। বিতরণ তালিকার কেউ একটি টিউবওয়েলও পায়নি। ভুয়া বিতরণ তালিকা দেখিয়ে পুরো ২ লাখ টাকা হজম করা হয়েছে। আদ্রা ইউনিয়নে হতদরিদ্রদের মাঝে টিউবওয়েল সরবরাহ প্রকল্পে প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ২ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের পিআইসি সভাপতি ছিলেন ইউপি সদস্য মজিবর রহমান। তিনি জানান, তিনিই শুধু একটি টিউবওয়েল পেয়েছেন। বাকি কারও খবর তিনি জানেন না। শুধু এ প্রকল্পগুলোই নয়, প্রতিটি প্রকল্পেই অনিয়ম ও লোপাটের একই চিত্র পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিআইসি কমিটির সভাপতিরা জানান, আমরা প্রকল্পের ব্যাপারে কিছুই জানি না। আবার কেউ কেউ জানান, প্রকল্প অনুমোদনের সময়ই উপজেলা চেয়ারম্যানকে বরাদ্দের শতকরা ৫০ ভাগ অগ্রিম দিতে হয়েছে। তাছাড়া বিল পাশের সময় শতকরা ২০ ভাগ পিসি নিয়েছে। তারপর মেলান্দহে যোগাযোগ খরচ তো আছেই। আপনারাই বলুন কয় টাকা থাকে। এভাবেই হরিলুট হয়েছে এডিপির পৌনে ৩ কোটি টাকা। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এতগুলো প্রকল্প একার পক্ষে দেখা সম্ভব হয়নি স্বীকার করে নিজেকে দায় থেকে এড়িয়ে দোষ চাপালেন তারই অধীন উপসহকারী প্রকৌশলীদের ওপর। তিনি জানান, তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই তিনি কাজের শতভাগ অগ্রগতির কাগজে স্বাক্ষর দিয়েছেন। বিতরণ তালিকা নিয়ে গরমিলের বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান। উপজেলা কমপ্লেক্সের সীমানা দেয়াল, রাস্তার হেরিংবন্ড ও গাছপালা লোপাটের বিষয়ে তিনি ইউএনওকে জানিয়েছেন বলে জানান। তিনি বলেন, আমি তো আর মারামারি করতে পারি না। তাছাড়া এগুলো রক্ষার দায়িত্ব উপজেলা প্রশাসনের। এসব অনিয়ম, দুর্নীতি প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার জন কেনেডি জাম্বিলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এডিপি প্রকল্পে হরিলুটের আংশিক সত্যতা স্বীকার করে তার অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করেন। তিনি প্রকল্প অনুমোদন ও বিল প্রদানের সময় শতকরা ১০ ভাগ পিসি নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। বিভিন্ন স্থাপনা, উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের সীমানা দেয়াল, গাছপালা কেটে নেয়াসহ রাস্তার হেরিংবন্ড তুলে নেয়ার বিষয়ে সত্যতা স্বীকার করে তা প্রতিহতের চেষ্টা করেছেন বলে জানান। এ দিকে মেলান্দহ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম হাবিবুর রহমান চাঁন তার বিরুদ্ধে আনীত এসব অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি কারও কাছ থেকে কোন টাকা নেইনি। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব কমিটির। দেখভালের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও প্রশাসনের।
×