ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশে কালো টাকায় নাগরিকত্ব কেনা যায় ॥ ভাবার বিষয়

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১৭ মার্চ ২০১৭

বিদেশে কালো টাকায় নাগরিকত্ব কেনা যায় ॥ ভাবার বিষয়

প্রাক-বাজেট আলোচনা শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্পষ্ট করে কয়েকটা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, কালো টাকা দেশে বিনিয়োগের কোন সুযোগ নেই। তাই সেই টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে, সেখানেই বিনিয়োগ হচ্ছে। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেকন্ডহোম গড়ে তোলা হচ্ছে। বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ কমছে। ব্যাংকিং খাতের বিশৃঙ্খলার কথা উল্লেখ করে তিনি ব্যাংকিং কমিশনের প্রয়োজনীয়তার কথা পুনরুল্লেখ করেছেন। বলেছেন, প্রবাসী আয় হ্রাস পাচ্ছে যা শুভ লক্ষণ নয়। গ্রামাঞ্চলে জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, এ কথাও তিনি বলেছেন। একটি কাগজে দেখলাম তিনি বিশ্বজুড়ে নতুন করে জেগে ওঠা ‘জাতীয়তাবাদের’ বিপদের প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন। প্রকৃত পক্ষে অর্থমন্ত্রী কী কী বলেছেন তার কিছুই আমি জানি না। এখানে যা তুলে ধরেছি তা একটি দৈনিক থেকে দেখা যাচ্ছে টাকা পাচারের ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছেন এবং কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন কালো টাকা দেশে বিনিয়োগের সুযোগ না থাকাকে। আচ্ছা, কালো টাকা বিনিয়োগের যে সুবিধা নেই এ কথা আমরা জানি। কিন্তু যে সমস্ত ব্যবসায়ী গ্রুপ দেশে চুটিয়ে ব্যবসা করছে এবং তাদের বাৎসরিক বিক্রির পরিমাণ দশ পনেরো হাজার কোটি টাকা চলে যায় তারা দেশে বিনিয়োগ করছে না কেন? কয়েকদিন আগে একটি দৈনিকে একটা খবর পড়লাম। খবরটিতে বলা হয়েছে দেশের বিখ্যাত একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ বাংলাদেশ ব্যাংকে দরখাস্ত করেছে বিদেশে বিনিয়োগের জন্য। তারা মালয়েশিয়া বিনিয়োগ করতে চায়। সেটি একটি ‘সাবসিডিয়ারি কম্পানি’ ব্যবসা, যার হোল্ডিং কোম্পানি সিঙ্গাপুরের। এসব বিষয় পরিষ্কার নয় বাংলাদেশ ব্যাংক ওই ব্যবসায়ী। গ্রুপের দরখাস্তের ওপর কোন সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না অনেক দিন যাবত। যেহেতু ব্যবসায়ী গ্রুপটি সরকারীভাবে বিদেশে টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করতে চায় তাই অনুমান করা চলে এই টাকা ‘সাদাই’ ‘কালো’ নয়। এখানেই প্রশ্ন, এটা হচ্ছে কেন? এবার এর সঙ্গে উল্টো প্রসঙ্গও তুলে ধরি। বহুদিন যাবতই শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশের বড় বড় ব্যবসায়ী বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ চায়। অনেকেই ‘চাওয়া-চাওয়ির’ অপেক্ষা না করে বিদেশে শিল্প করেছেন বলেও খবর আছে। এসব খবর দেশের কাগজেই ছাপা হয়। কাগজে দেখেছি ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় ‘গার্মেন্টস’ শিল্পটি নাকি বাংলাদেশের একজন বড় ব্যবসায়ীর, যার আবার একটি দেশীয় ব্যাংকেও নিয়ন্ত্রণ আছে বলে শোনা যায়। এদিকে শোনা যায় চীনের দক্ষিণাঞ্চলের একটি প্রদেশে বাংলাদেশী ব্যবসায়ী-শিল্পপতির আনাগোনা খুব বেশি এবং সেখানে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প আছে। চীনের সঙ্গে বিরাট আকারের আমদানি ব্যবসা সূত্রে ‘ওভার ইন ভয়েসিংয়ের টাকার সিংহভাগ নাকি সেখানে গচ্ছিত! দুবাইয়ের সঙ্গে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের আত্মিক সম্পর্ক গভীর, ব্যবসায়িক তো বটেই। কিছুদিন আগে বিখ্যাত এক ব্যবসায়ী আফ্রিকায় জমি কেনার জন্য সরকারের অনুমতি চেয়েছিলেন বলে মনে পড়ে। এ ছাড়া কানাডার ‘বেগমপাড়া’ ইদানীং খ্যাতি লাভ করেছে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, ইউরোপীয় দেশসমূহ ও যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশ এখন বাংলাদেশী বিত্তবানদের জন্য ডালভাত। এসব দেশে নানা ধরনের ব্যবসায়ী-কর্তৃক বিনিয়োগের ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে বহুদিন থেকে। সবই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মানুষের। কার কী আছে এসব গর্ব ও অহঙ্কারের কথা। সরকারী দলিল- দস্তাবেজের প্রমাণ নেই। তবে বিষয়টি জলের মতো পরিষ্কার। দেখা যাচ্ছে এবং বোঝা যাচ্ছে আমরা বাংলাদেশে যখন ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইনের ধারা বাস্তবায়নে ব্যস্ত এবং এই আইনের বাস্তবায়ন সূত্রে সারা বিশ্ব ভ্রমণে প্রশিক্ষণ নিতে ব্যস্ত তখন বিশ্বের তাবত দেশ ‘নাগরিকত্ব’ (সিটিজেন শিল্প)’ ‘থাকার অনুমোদন’ (স্টে পারমিট) ইত্যাদি বিক্রয়ে ব্যস্ত এবং উদ্যোগী। খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় কোন্ দেশে কত ডলার দিয়ে ‘নাগরিকত্ব’ পাওয়া যায়। কত ডলার বিনিয়োগ করলে ‘স্টে পারমিট’ পাওয়া যায়। আমার টেবিলে ১৪ মার্চের একটি খবর। এর শিরোনাম হচ্ছে : বিত্তশালী শরণার্থী টানছে উন্নত দেশ।’ খবরটিতে বলা হয়েছে ইউরোপের দেশগুলো এখন সঙ্কটে। পর্তুগাল ২০১২ সালে চালু করে ‘গোল্ডেন ভিসা’। স্পেনেও আছে একই কর্মসূচী। গ্রীস, সাইপ্রাস, নেদারল্যান্ডসও এই কাতারে। ক্যারিবিয়ান দেশগুলোতে চীনাদের সব টাকা। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ইত্যাদি দেশে বিনিয়োগের জন্য ডলার নিয়ে গেলে তারা স্থায়ীভাবে থাকতে দেয়। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশের কথা বাদই দিলাম। এসবের কথাই বোধহয় মাননীয় অর্থমন্ত্রী আকারে ইঙ্গিতে বলেছেন, বলতে চেয়েছেন। তাহলে কী দাঁড়ালো? আমরা যখন দেশের ব্যাংকিং আইন কঠোর থেকে কঠোরতর করছি, দুর্নীতি দমনে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে ‘দুদক’ যখন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কালো টাকা রোধ করতে তখন সারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলো কালো টাকার বিনিময়ে ‘নাগরিকত্ব’ ‘স্টে পারমিট’ বিক্রি করছে। বস্তুত আমাদের মতো দেশগুলো থেকে সকল ‘মাথা’ তারা নিয়ে নিচ্ছে। এই প্রলোভনে পড়ে দেশের একশ্রেণীর ধনাঢ্য ব্যক্তি, উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত পাগলের মতো দেশ ছাড়ছে। মনে হচ্ছে কারও হাতে সময় নেই। তাড়াতাড়ি তরী ভাসাতে হবে। দ্বৈত নাগরিকত্ব আইন এই কাজে সহায়তা করছে। এখানেরও খাব, ওখানেরও খাব। সুন্দর এক নীতি। দেখা যাচ্ছে এই কাজে লাগে ডলার। এক শ্রেণীর বাংলাদেশী বিদেশে শ্রমিকদের কাছ থেকে ডলার কিনে ফেলে। তারা তাদের কাছ থেকে ডলার নিয়ে নেয়। বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়স্বজনদের সেই ডলারের সমপরিমাণ টাকা তারা দিয়ে দেয়। অর্থ পাচার হলো কোত্থেকে? ডলারের দেশে ডলার রইল, টাকার দেশে টাকা রইল। শোনা যায়, বরং অভিযোগই যে, ‘বিকাশ’ ব্যবস্থা এই কাজে সহায়তা করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিনিয়োগের পরিবেশের কথা পরে, দেশে কী ‘কালো’ টাকা, কী ‘সাদা’ টাকা কোনটাই কোথাও রাখার ব্যবস্থা নেই। বড় বড় ব্যবসায়ীর বরং একটা সুবিধা আছে। তারা জমিতে, মালে কোম্পানির এ্যাকাউন্টে নানা ‘ফরমে’ টাকা লুকিয়ে ফেলতে পারে। রফতানিকারকরা বিদেশে টাকা লুকিয়ে রাখতে পারে। এসব ব্যক্তির কথা আলাদা। এরা বিনিয়োগকারী (!)। কিন্তু ভবিষ্যতের বিনিয়োগকারী যারা হতে পারে তারা টাকা রাখবে কোথায়? সদ্য চালু করা ‘ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফরমটি’ আমি এখনও দেখিনি। কাগজে পড়েছি। বিশাল ফরম নাকি এটি। এবং বলা হচ্ছে অশিক্ষিত লোক দূরের কথা, শিক্ষিত লোকের পক্ষেও নাকি ওই ফরম পূরণ করা কঠিন। আর যেসব ডকুমেন্ট ও কাগজপত্র চাওয়া হয় তাতে কে যাবে এ্যাকাউন্ট খুলতে। এসবই কি ‘মানি লন্ডারিং’ বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয়। দেশের সব মানুষই কি ‘মানি লন্ডারিংয়ে নিয়োজিত, ব্যস্ত? সরকারের এজেন্সিগুলো কি জানে না কারা ‘মানি লন্ডারিং’ করে। তা হলে সব আমানতকারী, সম্ভাব্য আমানতকারীকে এ স্ক্রুটিনির মধ্যে ফেলা কেন, যেখানে বিশ্বের দেশে দেশে ‘নাগরিকত্ব’ বিক্রি হয়। বিনিয়োগ করা যেখানে ডালভাতের মতো কাজ। কেউ জিজ্ঞেস করে না টাকার উৎস কী? টাকা ‘কালো’ না ‘সাদা’ এই প্রশ্ন করে না। মাননীয় অর্থমন্ত্রী এসব কারণেই কী ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য ব্যক্তি, প্রভাবশালী লোকজন বিদেশে টাকা পাচার করছে এবং হচ্ছে সেই সব দেশের সম্মানিত নাগরিক। হতে অসুবিধা কী? তারা তো বছরে দু’তিনবার দেশে আসতে পারবেন। একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে আমাদের বলে যাবেন কী ভাবে বাঙালী থাকতে হবে। কত ‘লম্বা’ ‘লম্বা’ কথা বলে যাবেন। দুই দেশের নাগরিক (!) তারা। অর্থমন্ত্রীকে এই রোগের ওষুধ খুঁজে বের করতে হবে। কারণ এই মুহূর্তে দেশকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে এই সমস্যা। ব্যবসায়ীরা দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে করছে। উচ্চবিত্ত ও ধনাঢ্যরা দেশে টাকা না রেখে বিদেশে রাখছে এবং ‘নাগরিকত্ব’ কিনছে। ঢাকা শহর ভর্তি দালালে। দুই দিন পর পর খবর হয় কাগজে। শুনেছি এসব খবর নাকি হুন্ডিওয়ালারাই করায়। তারা জানান দেয় বিদেশে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ ঘটনা। কোথায় কোথায় এই সুবিধা পাওয়া যায় তারা তা বলে দেয়। ওভার ইনভয়েসিংয়ের টাকা, রফানিকারকদের রিটেনশন কোটার টাকা, আছে তাদের কাছে। ওয়েজ আর্নারদের ডলারের একাংশ আছে তাদের। এমতাবস্থায় দেশে প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট কীভাবে হবে। পুরো বিষয়টির ওপর গবেষণা করে সিদ্ধান্তে আসা দরকার। কে করবে এই গবেষণা? বিদেশে নেই কার লোকজন, কার আত্মীয়স্বজন। অতএব এই আশা করা বাতুলতা বলেই মনে হয়। তবে একটা নতুন ঘটনা পরিস্থিতি কিছুটা হলেও পাল্টাতে পারে বলে মনে হয় যার কথা অর্থমন্ত্রী বলেছেন। সারা পৃথিবীকে এক করা হবে এই ছিল ‘নব্য উদারতাবাদী’দের সেøাগান। বাজার অর্থনীতি, অবাধ বাণিজ্য, বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের তত্ত্ব¡াবধানে নিষ্কণ্টক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দিন এখন প্রশেরœ সম্মুখীন। চারদিকে ‘জাতীয়তাবাদী’দের উত্থান ঘটছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্পের নেতৃত্বে। এই নতুন জাতীয়তাবাদের শেষ পর্যন্ত ‘ঘরমুখো’ হতে হবে হয়ত। এটা ঘটলে টাকা বিদেশে যাওয়ার ঘটনা হ্রাস পেতে পারে। তাহলে দেশে যাতে টাকা রাখা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকে টাকা আসুক, আসতে দিন। যারা সন্দেহজনক ব্যক্তি, যাদের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা আছে, খাতায় যাদের নাম আছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। বাকিদের মুক্ত রাখা হোক। করুক না তারা বিনিয়োগ, ব্যবসা, বাণিজ্য। ইত্যবসরে ‘দুদক’ বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয় রাজস্ব বোর্ড খুঁজে বের করুক। কী করা দরকার লেখক : সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×