ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন যথানিয়মেই অগ্রসর হচ্ছে

ডেথ রেফারেন্সের বেশি মামলা চলছে ধীর গতিতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৬ মার্চ ২০১৭

ডেথ রেফারেন্সের বেশি মামলা চলছে ধীর গতিতে

বিকাশ দত্ত ॥ ডেথ রেফারেন্সের কিছু চাঞ্চল্যকর মামলা ছাড়া বেশির ভাগই ধীরগতিতে এগুচ্ছে। রমনার বোমা হামলা মামলা, বিডিআর বিদ্রোহ মামলা, সিলেটের সবজি বিক্রেতা শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলা, খুলনার শিশু রাকিব হাওলাদার হত্যা মামলা, পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান দম্পতি হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্সও শুনানির চলছে। ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানি শেষে সিলেটের চাঞ্চল্যকর সামিউল আলম রাজন হত্যা মামলার রায় ঘোষণার জন্য ১১ এপ্রিল দিন ধার্য করা হয়েছে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও মামলা-জট কমছে না। ডেথ রেফারেন্সের মামলার স্তূপ বেড়ে যাচ্ছে। যার কারণে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি বাড়ছে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কারাবন্দীদের বন্দীত্বের যন্ত্রণাও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, দ্রুত নিষ্পত্তি করা এ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের দায়িত্ব। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে ‘রাষ্ট্রপক্ষ তার কাজ যথা নিয়মেই করে যাচ্ছে।’ অন্যদিকে সুপ্রীমকোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) মোঃ সাব্বির ফয়েজ বলেছেন, আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপীল শুনানি করতে। তবে হাইকোর্টে বিচারক সংকট থাকায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক বেঞ্চ দেয়া যাচ্ছে না। এতে নিষ্পত্তি কিছুটা কমে গেছে। হাইকোর্টে বর্তমানে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় একটি স্পেশাল বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানি হচ্ছে। তাই অন্য মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে কিছুটা চাপ পড়ছে। এছাড়াও হাইকোর্টের আরও তিনটি ডেথ রেফারেন্স শুনানি হয়। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বহু আসামির ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে হাইকোর্ট থেকে খালাস বা লঘুদ- পেয়েছেন। তাই ডেথ রেফারেন্স শুনানি যতোই বিলম্বিত হয়, ততোই ভুক্তভোগী ও আসামি উভয়পক্ষের উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পাচ্ছে । গত বছর নিষ্পত্তি হয়েছে কেবল ৪৮টি মামলা। একই সময়ে বিচারাধীন ছিল ৫২৪টি মামলা। আর এর আগের বছর নিষ্পত্তি হয়েছিল ৫৮টি মামলা। সে সময় পর্যন্ত বিচারাধীন ছিল ৫১৯টি মামলা। তার আগে ২০০৪ সালে নিষ্পত্তি হয় ১০১টি মামলা। তবে ২০০৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪৯ এ। ২০০৬ সালে আবার বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫-তে। ২০০৭ সালে নিষ্পত্তি হয় ১৪৮ মামলা। আর ২০০৮ সালে নিষ্পত্তি হয় ১২৮টি। এরপর আবারও কমে যায় নিষ্পত্তির সংখ্যা। ’০৯, ’১০ ও ’১১ সালে যথাক্রমে নিষ্পত্তি হয় ৪৮, ৪৩ ও ৭৪টি মামলা। এরপর আবারও বাড়ে নিষ্পত্তির সংখ্যা। ’১২, ’১৩ ও ’১৪ সালে যথাক্রমে নিষ্পত্তি হয় ১৪৫, ১১১ ও ১৩৫টি মামলা। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশেই একই অবস্থা। স্বাভাবিক নিয়মই নিষ্পত্তির তুলনায় মামলা দায়েরের সংখ্যা বেশি হয়। আর ডেথ রেফারেন্স তো অনেক সেন্সেটিভ মামলা। কাউকে তো আর কচুকাটা করা যাবে না।’ এখতিয়ারসম্পন্ন বেঞ্চ সংখ্যা বাড়ালে ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির হার বাড়বে কি না জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, ‘বেঞ্চ বৃদ্ধির বিষয়টা তো প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার। তাছাড়া শুধু বেঞ্চ বাড়ালেই তো হবে না দক্ষ বিচারপতিও তো লাগবে।’ দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে ‘রাষ্ট্রপক্ষ তার কাজ যথা নিয়মেই করে যাচ্ছে।’ সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ডেথ রেফারেন্স দ্রুত নিষ্পত্তি করা এ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের দায়িত্ব। পেপারবুক তৈরি হওয়ার পর তা কোর্টে মেনশন করতে হবে তাদেরই। শুনানির জন্য লিস্টে আনাও তাদের দায়িত্ব। এছাড়া এক্ষেত্রে সাজাপ্রাপ্তদের আইনজীবীদের একটু ভূমিকা আছে বলেও মনে করেন সাবেক এই আইনমন্ত্রী। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩১ ধারা অনুযায়ী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকরা যে কোন প্রকার দ- দিতে পারেন। তবে শুধু মৃত্যুদ- দিলে সেটি হাইকোর্টে অনুমোদন করাতে হয়। আর এ অনুযায়ী মামলার নথিপত্র পাঠিয়ে দেয়া হয় উচ্চ আদালতে। এরপর চাঞ্চল্যকর হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মামলার পেপার বুক তৈরি করে তা উপস্থাপন করা হয় শুনানির জন্য। হাইকোর্টের রায়ে সংক্ষুব্ধরা অনেকে আবেদন করেন আপীল বিভাগে। এরপর রিভিউ পর্যন্ত সুযোগ থাকে উভয় পক্ষের। আর রিভিউ খারিজ হলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ পান আসামিরা। তবে প্রাণ ভিক্ষা না চাইলে বা রাষ্ট্রপতি ক্ষমা না করলে কার্যকর করা হয় মৃত্যুদ-। কিন্তু নিম্ন আদালতের রায় ঘোষণার পর থেকেই ফাঁসির আসামিকে রাখা হয় কারাগারের কনডেমড সেলে। সেখানে তাদের থাকতে হয় দ- কার্যকরের আগ পর্যন্ত। তবে সাজা পরিবর্তন হলেই কেবল কনডেমড সেল থেকে মুক্তি মেলে। ডেথ রেফারেন্স মামলার রায় পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ- প্রাপ্ত অনেকেরই এই দ- হাইকোর্টে এসে বহাল থাকে না। অনেকে আবার খালাস পান আপীল বিভাগ থেকেও। তাই দায়রা আদালতে মৃত্যুদ- পাওয়া আসামি উচ্চ আদালতে খালাস পেলেও জীবন থেকে বড় একটা সময় পার হয়ে যায়। বিগত বছরে চাঞ্চল্যকর বেশ কয়েকটি মামলায় দেখা যায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত অনেক আসামিই ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে খালাস পেয়েছেন। ২০০৪ সালে গাজীপুরের সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যার ঘটনা ঘটে। এই মামলায় ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল বিচারিক আদালত ২৮ আসামির ২২ জনকে মৃত্যুদ- দিয়েছিলেন। ঘটনার এক যুগ পর ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ জুন হাইকোর্টে মৃত্যুদ- বহাল রয়েছে মাত্র ছয় জনের। মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের মধ্যে খালাস পেয়েছেন সাতজন। আর মৃত্যুদ- কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে আরও সাতজনকে। বাকি দুজন আপীল চলাকালে মারা গেছেন। ২০০০ সালে কলেজছাত্রী বুশরা হত্যার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় হওয়া মামলায় ২০০৩ সালে বিচারিক আদালত তিনজনকে মৃত্যুদ- ও দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছিলেন। ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে ২০০৭ সালে হাইকোর্ট একজনের মৃত্যুদ- বহাল রেখেছিলেন এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছিলেন। পরে গত বছর ১৫ নবেম্বর আপীল বিভাগ থেকে সব আসামিই খালাস পান। ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী শাজনীন তাসনিম রহমান ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হন ১৯৯৮ সালের ৩ এপ্রিল। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ২০০৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর বিচারিক আদালত ছয়জনকে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন। ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানি শেষে ২০০৬ সালের ১০ জুলাই হাইকোর্ট পাঁচ আসামির মৃত্যুদ- বহাল রাখেন, খালাস পান একজন। আপীল শুনানি শেষে এই মামলায় ২০১৬ সালের ২ আগস্ট একজনের মৃত্যুদ- বহাল রেখে বাকিদের খালাস দেন আপীল বিভাগ। সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের মতে, ডেথ রেফারেন্স মামলায় পেপারবুক বিড়ম্বনা এড়াতে অভিজ্ঞ জনবল প্রয়োজন। এছাড়া তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবস্থাকেও উন্নত করতে হবে। কারণ এখনও হাইকোর্ট বিভাগে পেপারবুক প্রস্তুত হচ্ছে সনাতন পদ্ধতিতে। মামলার গতি বাড়াতে উন্নত প্রযুক্তির বিকল্প নেই।
×