ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সংঘবদ্ধ চক্র তৎপর ;###;বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের ৭ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ৩০১ কোটি ডলারের এলসি, আমদানি অনুযায়ী শিল্প কারখানা হয়নি ;###;শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ঘোষণাবহির্ভূত মালামাল ;###;বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি

ভুয়া এলসিতে আমদানি বাণিজ্য ॥ বিপুল অর্থ পাচার

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৬ মার্চ ২০১৭

ভুয়া এলসিতে আমদানি বাণিজ্য ॥ বিপুল অর্থ পাচার

রহিম শেখ ॥ পশুখাদ্য তৈরির জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির কথা ছিল। সে মোতাবেক ৪ লাখ ডলারের এলসি খোলে দুটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মেশিনারিজ আমদানির বিপরীতে এলো বিদেশী মদ, সিগারেট, এলইডি টেলিভিশন ও ফটোকপিয়ার মেশিন। রাজধানীর যে ঠিকানা দিয়ে এলসি খোলা হয়েছিল সেটি ছিল ভুয়া। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে নিষিদ্ধ ঘোষিত এসব পণ্য আটক হলেও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কোন ব্যক্তির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলা হলেও তা আসেনি। এ সবের বদলে কন্টেনারে এসেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক। কখনও ফেব্রিক্সের বদলে এসেছে দামী ওষুধ। আবার কখনও শূন্য। পণ্য আমদানিতে বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চলছে রীতিমতো নয়ছয়। হচ্ছে অর্থ পাচার। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলসি খোলা থেকে শুরু করে শিপিং এজেন্ট, বন্দর, কাস্টমস, সি এ্যান্ড এফ এজেন্টসহ কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা এসব অপকর্ম করছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের তথ্য বলছে, দেশ থেকে পাচার করা অর্থের ৮০ শতাংশই হয় মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাণিজ্যের আড়ালে। এনবিআর এসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে জানালেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের ৭ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি বেড়েছে ১৩ শতাংশ। এ সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ৩০১ কোটি ডলারের এলসি খুলেছেন উদ্যোক্তারা। তবে যে পরিমাণে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে, সে অনুযায়ী শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠেনি। যার ফলে বিদেশে অর্থ পাচারের মতো ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এছাড়া শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য ইত্যাদি আমদানির ক্ষেত্রে ঘোষণা বহির্ভূত অন্য মালামাল আমদানি করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়েই ফাঁকি দেয়া হচ্ছে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব। মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্যসামগ্রী কারসাজির কারণে শুল্ক ফাঁকিতে পড়ছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। সংশ্লিষ্টদের মতে, স্ক্যানিংয়ের স্বল্পতা, ডাটা সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিকভাবে শেয়ারিং পদ্ধতি মজবুত না হওয়ায় এ ঘটনা ঘটছে। আমদানি ছাড়া রফতানি চালানের ক্ষেত্রেও ডকুমেন্ট জালিয়াতি ও মিথ্যা ঘোষণার অপকৌশল ধরা পড়েছে শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের হাতে। ফলে একের পর এক পণ্যের চালান আটক হলেও কমছে না শুল্ক ফাঁকির ঘটনা। পশুখাদ্য তৈরির মূলধনী যন্ত্রপাতি ঘোষণা দিয়ে সম্প্রতি দুটি চালানে চীন থেকে আনা ১২ কন্টেনারের ভিতরে পাওয়া যায় ১৬ হাজার ২৭০ বোতল বিদেশী মদ, ৩ কোটি ৮৪ লাখ শলাকা সিগারেট, ফটোকপি মেশিন ও বিভিন্ন ব্রান্ডের দামী এলইডি টেলিভিশন। এসব পণ্যের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার ‘হেনান আনহুই এগ্রো এলসি’ ও কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুরের ‘এগ্রো বিডি এ্যান্ড জেপি’। উভয় প্রতিষ্ঠানেরই মালিক খোরশেদ আলম নামে এক ব্যবসায়ী। আমদানিকারকের পক্ষে পণ্য খালাসের দায়িত্বে ছিল সি এ্যান্ড এফ এজেন্ট ‘রাবেয়া এ্যান্ড সন্স। চালানে রফতানিকারক হিসেবে চীনের জমরাজ ইন্ডাস্ট্রিজের নাম উল্লেখ করা হয়। জালিয়াতির মাধ্যমে আনা এসব পণ্য জব্দের পর চালানে উল্লিখিত ঠিকানায় আমদানিকারকের খোঁজ নিলে সেখানে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের কোন অস্তিত্বই মেলেনি। একইভাবে অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি খালাসের দায়িতপ্রাপ্ত সি এ্যান্ড এফ এজেন্ট রাবেয়া এ্যান্ড সন্সেরও। যদিও মিথ্যা ঘোষণায় নিয়ে আসা এসব পণ্যের ১ শতাংশ হারে শুল্কায়নও করা হয় কাস্টমসে। এ জন্য ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো হয় প্রায় চার লাখ ডলার। চালানের রফতানিকারক, সি এ্যান্ড এফ এজেন্ট একই। ঋণপত্রও খোলা হয় একই ব্যাংক থেকে। চীনের রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান হলেও পণ্য বোঝাই হয় সিঙ্গাপুর থেকে। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে কীভাবে ঋণপত্র খোলা হয়েছে জানতে চাইলে আইএফআইসি ব্যাংকের রাজধানীর নয়াপল্টন শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মেহেদী হোসেন জনকণ্ঠের কাছে দাবি করেন, ব্যাংকে হিসাব খোলার পর কর্মকর্তারা সরেজমিনে ওপরে টিনশেডের ছাউনিযুক্ত কারখানার প্রাথমিক কাঠামো দেখতে পান। এরপরই এই প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণপত্র খোলা হয়। তবে কেরানীগঞ্জ ও খিলক্ষেতের ঠিকানায় গিয়ে কোন কারখানার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১১ মাসে হেনান আনহুই এগ্রো এলসি ও এগ্রো বিডি এ্যান্ড জেপি অন্তত ১৬টি চালানে ৭৮টি কনটেনার খালাস করে নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জনকণ্ঠকে বলেন, শক্তিশালী জালিয়াত চক্র ছাড়া মিথ্য তথ্য দিয়ে কেউ অবৈধ পণ্য আমদানি করতে পারে না। ব্যাংকে এলসি খোলা থেকে পণ্য খালাস পর্যায়ে সব জায়গায় ওইসব চক্র কাজ করছে। আমরা এসব চক্রের মূলৎপাটন করব শীঘ্রই। জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মোঃ নজিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রাজস্ব উন্নয়নের অক্সিজেন। ব্যবসায়ী নামধারী কিছু অসৎ ব্যক্তি আর্থিক অনিয়ম করে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করছে। এনবিআর এসব প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেই থেমে থাকছে না। শাস্তির আওতায় আনতেও কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তিনি বলেন, দেশ থেকে পাচার করা অর্থের ৮০ শতাংশই হয় মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাণিজ্যের আড়ালে। বছরে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে যে পরিমাণ আর্থিক অনিয়ম হয় সে পরিমাণ অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতুর মতো দুটি সেতু নির্মাণ সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। সূত্রে জানা গেছে, মূলধনী যন্ত্রপাতি বা শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতেও অহরহ উচ্চ শুল্কের পণ্য আসছে। এছাড়া মুদ্রা পাচারের জন্য নির্দিষ্ট আমদানি পণ্যের বদলে আসছে ইট, বালু বা পাথর। গত বছর মিথ্যা তথ্য দিয়ে পণ্য আমদানির ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। এতে বিপুল পরিমাণে অর্থ পাচার এবং শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। গত বছরের ডিসেম্বরে এ ধরনের মিথ্যা ঘোষণায় আনা ২২ কনটেনারের একটি চালান আটকে দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস। প্রত্যেকটি কন্টেনারে একটি করে বিপি শিটের রোল থাকলেও পুরো কন্টেনারের বাকি রোলগুলোর ভেতর রয়েছে পাথর। চালানটির সি এ্যান্ড এফ এজেন্ট ছিল চট্টগ্রামের গ্লোবালটেক। এটির বিল অব এন্ট্রি নম্বর ছিল ১৪৯৩৭৪৯। ঢাকার সিএপি ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল চীন থেকে বিপি শিটের ৪৭৪ টনের দুটি চালান আমদানির ঘোষণা দেয়। শুল্ক কর্মকর্তারা সঠিক পণ্য বলে তা খালাসের সুপারিশও করে। কিন্তু গোপন সূত্রে খবর পেয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা দল কায়িক পরীক্ষার সময় দেখেন, বিপি শিটের অস্তিত্বই নেই। ২২ কনটেনার ভর্তি শুধু মাটির ব্লক। গত বছরের ২২ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে গার্মেন্টস শিল্পের কাঁচামাল (হ্যাঙ্গার, বোতাম ও সুতা) ঘোষণায় আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ ও প্রসাধনী পণ্য নিয়ে আসে কুমিল্লা ইপিজেড এলাকার প্রতিষ্ঠান ক্যাট গার্মেন্টস লিমিটেড। চালানের আগাম পত্র (বিল অব এন্ট্রি-২৩২৯৪৮) জমা দেয় খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সি এ্যান্ড এফ প্রতিষ্ঠান খলিল ট্রেডার্স। রফতানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানির ঘোষণা থাকায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য দ্রুত খালাসের ছাড়পত্র পায় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু গোপন তথ্যের ভিত্তিতে চালানের ছাড়করণ সাময়িকভাবে স্থগিত করে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা চালায় চট্টগ্রাম কাস্টমসের এআইআর শাখা। এতে দেখা যায়, প্রায় সাড়ে তিন হাজার কেজি ওজনের ২৮ ধরনের আমদানি নিষিদ্ধ ওষুধ ও ৩ হাজার ৪৭৩ কেজি প্রসাধনী পণ্য নিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর চার দিন আগে ১৮ ডিসেম্বর একই এলাকার প্রতিষ্ঠান কাদেরা স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেডও তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ঘোষণায় প্রায় ১৩ কোটি টাকার সিগারেট নিয়ে আসে। আমদানি নথি জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব (৬০২ শতাংশ শুল্ক হারে) ফাঁকি দিয়েছিল প্রায় ৭৮ কোটি টাকার। আমদানিকারকের পক্ষে চালান (বিল অব এন্ট্রি নম্বর-২৩৫০২৬) খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ছিল ‘সারাচেন কর্পোরেশন’। গত বছরের অক্টোবর মাসে সরিষাবীজ আমদানির নামে ৪৩টি খালি কনটেনার নিয়ে আসে চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান লাকি ট্রেড। আগস্টে ইলেকট্রনিক পণ্যে ব্যবহৃত ২৬ টন তামা আমদানির ঘোষণা দিয়ে পাথর আনার মাধ্যমে প্রায় ৬৫ লাখ টাকা চীনে পাঠায় গাজীপুরের শেনজেন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। নারায়ণগঞ্জে এসআর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যালুমিনিয়াম স্ক্র্যাপের ঘোষণা দিয়ে কনটেনার ভর্তি ছাই নিয়ে আসে। ১ কোটি ২০ লাখ টাকা বিদেশে পাঠাতে রোজা ফুডস চীন থেকে ৩২০ ড্রাম খোলা সয়াবিন তেল আমদানির ঘোষণা দিয়ে পানি নিয়ে আসে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমদানি চালানের মিথ্যা ঘোষণায় আসা এ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পণ্য শনাক্ত করা কঠিন। কারণ এখনো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় ঘাটতি আছে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বন্দরে এসব পণ্য সঠিকভাবে পরীক্ষা করার জন্য ২০ থেকে ২৫টি স্ক্যানার প্রয়োজন হলেও পুরনো কয়েকটি স্ক্যানার দিয়ে কাজ করতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে সাধারণত কায়িক পরীক্ষা চালানো হয় না। আমদানিকারকদের দেয়া হয় চালান দ্রুত ছাড়করণের সুবিধা। এসব কাঁচামালে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি হয় বলে এগুলোর ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত আমদানি ছাড়াও অন্যান্য বাড়তি সুবিধা দেয়া হয়। তাই বাড়তি শুল্কযুক্ত পণ্য বা আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের কায়িক পরীক্ষা এড়ানোর জন্যই পোশাক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির মিথ্যা ঘোষণা দেয় কিছু প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া শুল্ক ফাঁকি দিতেও এ ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছেন তারা। চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ পণ্য আটকের ঘটনায় বর্তমানে উচ্চতর আদালতে মামলার সংখ্যা ৭ হাজার ২৯৭টি। এর সঙ্গে জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ৯২৫ কোটি টাকা। এছাড়া গত ১ বছরে জেটি পরীক্ষণে ৬২৪টি মামলা করার ফলে অতিরিক্ত ৩৩ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। এছাড়া আনস্টাফিং ডিভিশন থেকে মামলা হয়েছে ৪০টি। কয়েকটি মামলার নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, পোশাকশিল্পের কাঁচামাল ঘোষণায় আমদানিতে রাজস্ব ফাঁকি দিতে চার ধরনের মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন আমদানিকারকরা। এগুলো হলো আমদানি পণ্যের পরিচিতি তালিকা (এইচএস কোড) পরিবর্তন, ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য আমদানি, সিপিসি (কাস্টমস প্রসিডিউর কোড) পরিবর্তন ও নথি জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে এইচএস কোড পরিবর্তন বা ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানির ঘটনায়। এ বিষয়ে বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই দেশে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানিতে অস্বাভাবিক তথ্য মিলছে। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট এলসির মালামাল বন্দর থেকে খালাসের সময় কনটেনারে প্রকৃতপক্ষে কী আনা হয়েছে সেটি ফিজিক্যালি দেখার দায়িত্ব কাস্টমস কর্তৃপক্ষের। ফলে মাল খালাসের সময় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিল অব এন্ট্রির পরিসংখ্যান থেকেও কিছু তথ্য মিলতে পারে। এছাড়া উদ্যোক্তারা যে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খুলেছেন, সেগুলো দেশে এনে তা কারখানায় স্থাপন করা হয়েছে কিনা, তা সরেজমিন তদন্ত করা উচিত বলে ওই কর্মকর্তা মনে করেন। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জনকণ্ঠকে বলেন, আমদানির চিত্র ফুলানো-ফাঁপানো। প্রকৃত পক্ষে এর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার দাবি রাখে। অনেক আমদানি পণ্যে কাস্টমস ডিউটি থাকে না। এরপরও সেসব পণ্যের আমদানি অতি মূল্যায়িত দেখানো হচ্ছে। যেখানে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার একটা অংশ বাইরে পাচারের সমূহ ধারণা দিচ্ছে। এগুলো আমাদের জোরালো মনিটরিংয়ে রাখা দরকার। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে পণ্য আমদানির দেনা শোধে সৃষ্ট ফোর্সড লোনের (গ্রাহকের নামে বাধ্যতামূলক ঋণ সৃষ্টি করে আমদানির দেনা শোধ করা) নামে প্রতারণার ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। অসাধু কিছু আমদানিকারক ঋণপত্র বা এলসি খুলে পণ্য আমদানি করছেন। দেনা শোধের শর্তে পণ্যও বিক্রি করছেন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হলেও টাকা পরিশোধ করছেন না। ফলে ব্যাংক বাধ্য হয়ে গ্রাহকের নামে ফোর্সড লোন বা বাধ্যতামূলক ঋণ সৃষ্টি করে বিদেশী ব্যাংকের দেনা শোধ করছে। ব্যাংকের এসব ঋণ গ্রাহক শোধ না করায় খেলাপী হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে খেলাপী ঋণের পরিমাণ। বন্দরে স্ক্যানিংয়ের স্বল্পতা ॥ বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে অত্যাধুনিক স্ক্যানার ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে কনটেনারের মধ্যে থাকা পণ্যের স্বচ্ছ ইমেজ পাওয়া যায়। অত্যাধুনিক স্ক্যানার না থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার কনটেনারের মধ্যে কোন অবৈধ ও ক্ষতিকর পদার্থ থাকলে তা খুঁজে বের করা খুবই কঠিন। তাছাড়া প্রতিদিন শিল্পের কাঁচামাল, দুধসহ পাউডারজাতীয় বিভিন্ন পণ্য, রাসায়নিক, ভোজ্যতেলসহ তরল রাসায়নিক চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খালাস হচ্ছে। কোন কোন পণ্য সরাসরি কনটেনারসহ আমদানিকারকের শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা ইয়ার্ডে চলে যায়। শিল্পপণ্য আমদানি বা খোলা যন্ত্রপাতিও স্ক্যানিং করা হয় না। আনস্টাফিং পণ্যও স্ক্যানিংয়ের বাইরে থাকে। বর্তমানে কিছু রফতানি পণ্য এবং অর্ধেক আমদানি পণ্য স্ক্যানিং হচ্ছে। স্ক্যানিং মেশিনের অভাব খুবই প্রকট। তবে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আধুনিক স্ক্যানার মেশিন এবং কাস্টমস হাউসে ১৮৩ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীর সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র স্ক্যানিং ডিভিশন গঠন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চলতি বছর ২টি স্ক্যানার ক্রয়ের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এক হাজার ৬৮৯টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিআইএন নম্বর বাতিল ॥ শতভাগ রফতানিমুখী শিল্পের উৎপাদন উৎসাহিত করতে কাঁচামাল আমদানিতে বন্ড সুবিধার নামে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে সরকার। তবে এ সুবিধা পেতে হলে কিছু শর্ত মানতে হয়। অথচ সরকারের এসব বিধিনিষেধ না মেনে অভিযুক্ত এক হাজার ৬৮৯টি প্রতিষ্ঠান কারখানায় পণ্য উৎপাদনে ব্যবহারের কথা বলে বন্ড সুবিধার আওতায় কাগজ ও কাগজজাতীয় মালামাল আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়। তদন্তে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচার ও বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে বিআইএন অকার্যকর ঘোষণা করে এনবিআর। বিআইএন অকার্যকর হওয়ায় এক হাজার ৬৮৯টি প্রতিষ্ঠান এখন থেকে আর কোন পণ্য আমদানি-রফতানি করতে পারবে না। কোন পণ্য আমদানির ফরমায়েশও দিতে পারবে না। কোন পণ্য রফতানিতে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে পারবে না। তারা আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত সরকারী- বেসরকারী সুবিধা নিতে পারবে না। এমনকি ব্যাংকে তাদের এলসি (ঋণপত্র) খোলা, বন্ড সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত পণ্য আনা, বন্দরে পণ্য খালাস বা চালানসহ আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত সব কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় থাকা ব্যক্তিদের বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত সব কার্যক্রমও বন্ধ করা হয়েছে।
×