ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এএলআরডির গবেষণাপত্র উপস্থাপন

কৃষি অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় নারীর ভূমিকা থাকলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জোটেনি

প্রকাশিত: ০৫:০০, ১৬ মার্চ ২০১৭

কৃষি অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় নারীর ভূমিকা থাকলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জোটেনি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৮ শতাংশ কৃষি খাতে নিযুক্ত। অন্যদিকে জীবিকার জন্য গ্রামীণ জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি খাতকে মজবুত ও শক্তিশালী করতে গ্রামীণ নারী-পুরুষ সমান তালে ভূমিকা পালন করছে। নারী কৃষকরা তাদের পরিবারের খাদ্য সরবরাহের পাশাপাশি বাণিজ্যিক কৃষি কাজে অবদান রেখে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখছে। সেই সঙ্গে, ভূমির মালিকানায় বা বাজার ব্যবস্থায় নারীর প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯,৪ শতাংশ নারী। কিন্তু ভূমিতে গ্রামীণ নারীর মালিকানা মাত্র ২-৪ শতাংশ এবং বাকি ৯৬ শতাংশ জমির ব্যক্তি মালিকানা রয়েছে পুরুষের নামে। কৃষি-অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় নারী অগ্রবর্তী ভূমিকায় থাকলেও তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আজও জোটেনি, হয়নি কৃষিকাজে নারীর অবদানের সঠিক মূল্যায়ন। বুধবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এএলআরডিপি আয়োজিত ‘নারীর ভূমি অধিকার, কৃষিতে অংশগ্রহণ ও বঞ্চনা: সম্ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে মাঠ পর্যায়ে গ্রামীণ নারীর ভূমি মালিকানার অবস্থা, ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে এ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) উদ্যোগে ‘নারীর সঙ্গে জমির সম্পৃক্ততা এবং কৃষিতে তাদের অবদান’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। সেমিনারে গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন এএলআরডির উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি। কৃষি জমির সঙ্গে নারীর সম্পৃক্ততা, কৃষি উৎপাদনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ, বাজার ব্যবস্থায় তাদের প্রবেশাধিকার কেন্দ্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে তাদের ভূমিকা যাচাই করাসহ চাষাবাদের ক্ষেত্রে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ, কৃষিকাজে উন্নত প্রযুক্তি সম্পর্কিত জ্ঞান এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই গবেষণাটি করা হয়। গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা, চাটমোহর ও পাবনা এই চারটি এলাকার নারী কৃষকদের এ গবেষণার আওতায় এনে এদের জীবনমান পর্যবেক্ষণ করে গবেষণাটি প্রস্তুত করা হয়। বাংলাদেশে ৯০-এর দশকের পর থেকে ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিবেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৪ সাল থেকে গড় বার্ষিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি। গবেষণায় এটি প্রমাণিত যে, কর্মসংস্থানসহ সকল সম্পদে পুরুষের পাশাপাশি নারীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে তা দারিদ্র্য দূরীকরণসহ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ফলদায়ক হবে। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ২০০২-০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের অংশগ্রহণ হ্রাস পেয়েছে। ২০০২-০৩ সালে শ্রমশক্তিতে পুরুষের অংশগ্রহণ ৮৭.৪ শতাংশ থেকে ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়ে ২০১৩ সালে ৮১.৭ শতাংশতে নেমে আসে। অন্যদিকে নারী অংশগ্রহণ ২০০২-০৩ সালে ২৬.১ শতাংশ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ক্রমবর্ধমান। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার নারীরা কৃষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। ৯০ দশকের শুরু থেকেই নারীরা জমি প্রস্তুত, ধান রোপণ, ধান কাটা থেকে শুরু করে সকল কাজই করে আসছে। পাশাপাশি বাড়ির গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি পালনের কাজকর্মও করে আসছে। কিন্তু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নারীর অবদান এখনও দৃশ্যমান নয়। বর্তমানে দেশে কতজন নারী কৃষক কৃষিকাজে যুক্ত আছে এ সংখ্যা সরকারী হালনাগাদে আজও উঠে আসেনি বলে জানানো হয় গবেষণাপত্রে। কৃষকদের কৃষি উপকরণসহ সব ধরনের সরকারী সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান চালু করেছে। এই কর্মসূচীর আওতায় সারাদেশে এক কোটি ৪০ লাখ কৃষক কৃষি কার্ড পাবেন। ২০০৯ সাল থেকে কার্ড বিতরণ শুরু হয় কৃষকদের মধ্যে। হালনাগাদ করা হয় ২০১৪ সালে। শুধু কার্ডধারী পরিবার প্রধান (নারী হোক বা পুরুষ) কৃষি উপকরণ সুবিধা পাবে। নারী প্রধান পরিবারকেও কার্ড দেয়া হবে, তবে এক্ষত্রে শর্ত হলো নারীর নামে জমি থাকতে হবে। এছাড়া কার্ড ব্যবহার করে কৃষকরা ব্যাংক ঋণ নিতে পারবেন যদি কার্ডধারীর নামে ৩১ শতাংশ জমি থাকে। তা জামানত রেখে ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক নারী কৃষকের নিজ নামে জমি নেই যার ফলে তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছেন। অনেকেই বর্গা জমি চাষ করেন, এক্ষেত্রে আবার কার্ডধারী বর্গাচাষীরা ঋণ নেয়ার সুযোগ পাবেন না। তাই অধিকাংশ নারী কৃষক এই কার্ড ব্যবহার করে সরকারী সুবিধা ভোগ করতে পারছেন না। গবেষণাপত্রে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়, ঘোড়াঘাটে নারী প্রধান কৃষক পরিবারে ২১৫২টি কার্ড প্রদান করা হয়েছে নারীদের নামে। সরকারের নিয়মানুযায়ী ১০ টাকা দিয়ে সর্বমোট ৮ হাজার জন ব্যাংকে এ্যাকাউন্ট খুলেছেন যার মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬০ জন। অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিখি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিচালক (সরেজমি উইং) কৃষিবিদ চৈতন্য কুমার দাস। অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. সীমা জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রওশন আরা ফিরোজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আইনুন নাহার ও এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা।
×