ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পিছু হটছে বহুজাতিকরা

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ১৫ মার্চ ২০১৭

পিছু হটছে বহুজাতিকরা

বহুজাতিক কোম্পানিগুলো পিছু হটছে। তারা যে যার যার দেশের দিকে রওনা দিচ্ছে। সেটা যে কেবল সংরক্ষণবাদের হুমকির কারণে ঘটছে তা নয়, আরও কারণ আছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপছন্দের অনেক কিছুর মধ্যে আছে বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি। তার অভিযোগ এরা চাকরিবাকরি ও কলকারখানা বাইরে নিয়ে গিয়ে আমেরিকানদের বেকার করে ফেলেছে, তাদের জীবনে বিপর্যয় ঘটিয়েছে। এই বহুজাতিকদের এখন পোষ মানাতে হবে। কর হ্রাস করা হলে ওদের টাকা দেশে ফিরে আসবে। সীমান্তে শুল্ক বসালে পণ্যের অবাধ সরবরাহ বিঘিœত হবে। তাদের ব্যবসা করার সহায়ক সীমান্ত চুক্তি নতুন করে প্রণীত হবে। মার্কিন ব্যবসায়ী কর্মকর্তাদের তিনি বলেন, শাস্তিমূলক আচরণ যদি এড়াতে চান তাহলে যে কাজটা আপনাদের করতে হবে তা হলো দেশে থেকে যাওয়া।’ সংরক্ষণবাদী সুরের দিক দিয়ে ট্রাম্প ব্যতিক্রমী ধরনের আক্রমণাত্মক। তবে নানা দিক দিয়ে তিনি সময়ের পেছনে পড়ে রয়েছেন। বৈশ্বিক সংহতির মূল বাহন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ২০১৬ সালের পপুলিস্ট শক্তির উত্থানের বেশ আগেই পিছু হটতে শুরু করেছিল। তাদের আর্থিক অবস্থা পরতির দিকে যাচ্ছিল যার ফলে তারা স্থানীয় ফার্মগুলোকে আর ছাড়িয়ে যেতে পারছিল না। তাদের অনেকেরই ব্যয় হ্রাসের ও করের বোঝা বইবার ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে পড়ছিল। স্থানীয় প্রতিবাদীদের অগ্রাহ্য করার শক্তিও হারিয়ে ফেলছিল। ট্রাম্প সেসব কোম্পানিকে লক্ষ্য করেই কামানের গোলা দেখেছেন যেগুলোর বিস্ময়করভাবে নাজুক অবস্থায় পড়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই স্বদেশের পথ ধরেছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের ওপর এর প্রভাব হবে সুগভীর। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিশ্বের শ্রমিকদের ৫০ জনের মধ্যে মাত্র একজনকে নিয়োগ করে থাকে। তবে এতেই অনেক কিছু যায় আসে। শত শত কোটি লোকে যা দর্শন করে, পরিধান করে ও আহার করে সেগুলোকে প্রভাবিত করে অল্প কয়েক হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যেমন আইবিএম, ম্যাকডোনাল্ডস, ফোর্ড, এইচএ্যান্ডএম, লেনোভো, হোন্ডা প্রর্ভতি। তারা সেই সাপ্লাই টেইনের সমন্বয় সাধন করে যা কিনা সকল বাণিজ্যের ৫০ শতাংশেরও বেশি। এরা বিশ্বের শেয়ার বাজারগুলোর মূল্যের এক-তৃতীয়াংশ এবং লিঙ্গাবি ডিজাইন থেকে শুরু করে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সফটওয়্যার ও ডায়াবেটিস ওষুধ পর্যন্ত এর বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির সিংহভাগ অংশের মালিক। এসব বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল ১৯৯০ এর দশকের প্রথম দিকে। কারণ সে সময় চীন ও সাবেক সোভিয়েত শিবিরের দেশগুলো মুক্ত বাণিজ্যের পথে পা বাড়িয়েছিল এবং ইউরোপের বাজার সংহত রূপ নিয়েছিল। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পছন্দ করেছিল বহুজাতিক কোম্পানি। কোম্পানিগুলো জাতির পরিসরে আবদ্ধ না থেকে তাদের কর্মকা-গুলো ছড়িয়ে দিয়েছিল। একটি চীনা কারখানার হয়ত ব্যবহৃত হয় জার্মানির মেশিন, ফ্যাক্টরির মালিক থাকে যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাক্স দেয় লুক্সেমবার্গে তার জন্য বিক্রি করে জাপানে। উদীয়মান বিশ্বের সরকারগুলো এসব কোম্পানির চাকরি, রফতানি ও তাদের কেনা প্রযুক্তিকে স্বাগত জানায়। ওটা ছিল স্বর্ণযুগ। কিন্তু সেই স্বর্ণযুগ আর চিরস্থায়ী হলো না। গত পাঁচ বছরে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মুনাফা ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। মূলধনের প্রাপ্তি দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। এর জন্য শক্তিশালী ডলার ও তেলের মূল্যহ্রাস অংশও দায়ী। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সুপার স্টার কোম্পানি এবং শক্তিশালী ব্র্যান্ডের ভোগ্যপণ্যের ফার্মগুলো এখনও টিকে আছে বটে তবে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের যন্ত্রণা এত ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী যে সেগুলোকে ক্ষণিকের বলে উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। প্রায় ৪০ শতাংশ বহুজাতিক কোম্পানির ইকু্যুইটির ওপর প্রাপ্তির পরিমাণ ১০ শতাংশের কম। তাদের অর্থনৈতিক পারদর্শিতা যে কমে গেছে এটাই তার মাপকাঠি। সংখ্যাগরিষ্ঠ শিল্পে তাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে অধিকতর মন্থরগতিতে এবং স্থানীয় যেসব কোম্পানি তাদের পেছনে পড়ে ছিল সেগুলোর তুলনায় তারা মুনাফা করতে পারছে কম। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বৈশ্বিক মুনাফার ভাগ এক দশক আগে ছিল ৩৫ শতাংশ। এখন তা ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। অনেক শিল্প, ম্যানুফ্যাকচারিং, আর্থিক, প্রাকৃতিক সম্পদ। মিডিয়া ও টেলিকম কোম্পানির বৈশ্বিক পরিসরে ব্যাপ্তি সুবিধাজনক হয়নি বরং বোঝার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকার শেল গ্যাস ও তেলশিল্প থেকে শুরু করে ব্রাজিলের ব্যাঙ্কিং, চীনের ই-কমার্স থেকে শুরু করে ভারতের টেলিকম পর্যন্ত যাবতীয় কোম্পানি সবই স্থানীয়-বৈশ্বিক নয়। পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক দৃশ্যপট বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য পরিস্থিতি আরও অনেক কঠিন করে তুলছে। ট্রাম্পের উত্থান বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ তার আবির্ভাবের ফলে অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। অনেক কোম্পানি আছে আকার অবয়বের দিক দিয়ে খুব বেশি বড়। সেগুলোকে তাদের ব্যবসায় সাম্রাজ্য ছোট করে ফেলতে হবে। অন্যরা যেসব জায়গায় ব্যবসা করছে সেখানকার বাজারে তাদের শিকড় আরও গভীরভাবে প্রবেশ করানোর চেষ্টা করছে। জেনারেল ইলেকট্রিক ও সিমেন্স তাদের সাপ্লাই চেইন, উৎপাদন, চাকরি-বাকরি ও কর আঞ্চলিক এবং জাতীয় ইউনিটগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছে। সিলিকন ভ্যালির ওপর থেকে গুগল পর্যন্ত তারকা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও বিদেশে নিজেদের ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে। আবার অন্যদিকে ফাস্টফুড কোম্পানি ও হোটেল টেইনগুলো বার্গার ও ব্রেড তৈরি বাদ দিয়ে ব্র্যান্ডিং স্বত্ব বিক্রির দিকে ঝুঁকছে। তবে এ জাতীয় ভার্চুয়াল বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও পপুলিজমের কাছে বিপন্ন হয়ে পড়বে। কারণ এরা সরাসরি খুব কম সংখ্যকই চাকরি সৃষ্টি করে, সামান্য কর দেয় এবং বাণিজ্য বিধিনিয়মের দ্বারা সংরক্ষিত নয়। সোজা কথায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পিছু হটতে হচ্ছে এবং আগামীতেও আরও হটতে হবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×