ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সমাপনী মাসের শুরু আজ

কার যেন এই মনের বেদন চৈত্র মাসের উতল হাওয়ায়...

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৫ মার্চ ২০১৭

কার যেন এই মনের বেদন চৈত্র মাসের উতল হাওয়ায়...

মোরসালিন মিজান ॥ বিদায়ের সুরটি বাজছে। কি যেন নেই। হারিয়ে যাচ্ছে। ফুরিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত এই হাহাকার চৈত্রের দান! বাংলা ১২ মাসের শেষ মাসটির শুরু হচ্ছে আজ। আজ ১ চৈত্র, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। এই মাস বহু চাওয়াকে ভালবাসাকে বন্ধনকে পুরনো করে দেয়। কবিগুরু তাই লিখেছিলেন কার যেন এই মনের বেদন চৈত্র মাসের উতল হাওয়ায়,/ঝুমকোলতার চিকন পাতা কাঁপে রে কার চম্কে-চাওয়ায়/হারিয়ে-যাওয়া কার সে বাণী কার সোহাগের স্মরণখানি/আমের বোলের গন্ধে মিশে/কাননকে আজ কান্না পাওয়ায়...। মানুষের মনের মতো প্রকৃতিতেও নানা পরিবর্তন নিয়ে আসে চৈত্র। গ্রামীণ জীবন ও অর্থনীতিতে এর বিশেষ নানা প্রভাব দৃশ্যমান হয়। চৈত্র মাস চৈৎ মাস নামেও পরিচিত। গাঁয়ে চৈত্র মাসকে চৈৎ বলে ডাকা হয়। এটি বাংলা সালের দ্বাদশ ও সমাপনী মাস। বর্তমান বছরের বিদায় ও নতুন বছরের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে চৈত্র। এক সময় চৈত্র মাস নিয়ে লেখার তেমন কিছু ছিল না। অভাবের মাস হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এ সময়ে এসে কৃষকের গোলাভর্তি ধান শেষ হয়ে যেত। হাতে টাকা-পয়সা থাকত না। কোনরকমে চলত কৃষকের। বাড়তি খরচের কথা ভাবতেই পারতেন না তারা। শুধু কী তাই? চৈত্র মাসে বিয়ে-শাদিসহ সামাজিক অনেক উৎসব অনুষ্ঠান বন্ধ থাকত! সবাই অপেক্ষা করে থাকতেন বৈশাখের জন্য। এ বিবেচনায় চৈত্র নতুন স্বপ্ন বোনার মাস। তবে এখন বদলে গেছে অনেক কিছু। সারাবছরই কোন না কোন ফসল হয়। এই কিছু দিনের মধ্যে রোপণ করা হবে গ্রীষ্মের শাক-সবজি। গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। চৈত্র মাসের গরমের কথাও বলতে হয়। এ সময় গরম বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যায়। শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায় মাঠ। বৃষ্টিও নিয়মিত হয় না। ফলে শেষ সময়ে এসে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বোরো ধানের আবাদ। এক সময় তো বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়া হতো। ঐতিহ্যবাহী সেই আচার এখন আর চোখে পড়ে না। পাম্পের সাহায্যে সেচের কাজ চলে। চৈত্রকে রুক্ষ মনে হলেও, এ সময় সবুজ পত্রপল্লবে ভরে ওঠে বৃক্ষ শাখা। এরই মাঝে এসেছে আমের মুকুল। মিষ্টি ঘ্রান এসে নাকে লাগছে। আর কিছু দিনের মধ্যেই আমের দেখা মিলবে। ঘরে ঘরে বিশেষ ডাল রান্না হবে কাঁচা আম দিয়ে। আর কাঁচা আমের ভর্তার কথা তো বলাই বাহুল্য। আর মাসের শেষে বাঙালী ঐতিহ্যের চৈত্রসংক্রান্তি। চৈত্রের শেষদিন, ৩০ চৈত্র বাঙালীর বর্ষ বিদায়ের দিন, চৈত্রসংক্রান্তি। আবহমানকাল থেকে নানা লোকাচার উৎসব-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে, এটি পালন করে আসছে এ দেশের মানুষ। মূল আয়োজন গ্রামে হলেও, নগর সংস্কৃতিতে এর কদর এখন যথেষ্ট। চৈত্রসংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাস্ত্র মেনে স্নান-দান-ব্রত এবং উপবাস করে কাটান। নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী অন্য ধর্মাবলম্বীরাও নানা আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। চৈত্রসংক্রান্তির আরেকটি বড় উৎসব চড়ক। গোটা চৈত্র মাসে সন্ন্যাসীরা উপবাস, ভিক্ষান্নভোজনসহ নানা নিয়ম পালন করেন। সংক্রান্তির দিন তারা শূলফোঁড়া, বাণফোঁড়া ও বড়শি গাঁথা অবস্থায় চড়ক গাছে ঝোলেন। আগুনের ওপর দিয়ে হাঁটেন। ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য শারীরিক কসরত দেখতে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ জড়ো হন। আনন্দে মাতেন। এ আয়োজনের সঙ্গে আরও চলে গাজনের মেলা। মেলার সঙ্গে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নাম সম্পৃক্ত। যেমন, শিবের গাজন, ধর্মের গাজন, নীলের গাজন। অবশ্য শহুরে জীবনে চৈত্রের প্রভাব খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। আগে খুব লোডশেডিং হতো। এখন বদলেছে পরিস্থিতি। ফলে চৈত্র মাসও বেশ উপভোগ্য। আর মাসের শেষ দিনগুলো তো নতুন বছরের আনন্দঘন শুরুর সঙ্গে যুক্ত। পুরনো চৈত্র নতুন বৈশাখের আগমনী বার্তা দেয়। কবিগুরু লিখেছিলেনÑ চৈত্রের সেতারে বাজে বসন্তবাহার/বাতাসে বাতাসে ওঠে তরঙ্গ তাহার...। সেই তরঙ্গ এখন প্রকৃতিতে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে চৈত্র!
×