ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৫ মার্চ ২০১৭

অগ্নিঝরা মার্চ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ১৬ মার্চ, ১৯৭১। একাত্তরের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের বৈঠক হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু সামরিক আইন প্রত্যাহার, বাঙালীদের ওপর গুলিবর্ষণ ও হত্যাকা- বন্ধসহ বিভিন্ন নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে এর জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে বিচার দাবি করেন। ধানম-ির বাসভবন থেকে বেলা পৌনে ১১টার দিকে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি ভবনের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় বিপুলসংখ্যক মানুষ জাতীয় নেতাকে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগান দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। বঙ্গবন্ধুও এ সময় তাঁর কর্মী, সমর্থক ও ভক্তদের প্রতি ‘জয় বাংলা’ বলে গাড়িতে ওঠেন। এ সময় অপেক্ষমাণ বিদেশী সাংবাদিকদেরও জয় বাংলা বলে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে দেখা যায়। তবে বাঙালী হত্যার প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে বঙ্গবন্ধু অংশ নেন ইয়হিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে। বেলা ১১টার আগে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সাদা মোটরগাড়িতে করে প্রেসিডেন্ট ভবনে (বর্তমানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা) গেলে পাকি প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধু কালো পতাকা উড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে পৌঁছলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালী জাতির এই নেতাকে স্বাগত জানিয়ে আলোচনার কক্ষে নিয়ে যান। বেলা ১১টায় রুদ্ধদ্বার কক্ষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও সংসদীয় ক্ষমতার অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে শুরু হয় একান্ত আলোচনা। বৈঠক চলে আড়াই ঘণ্টা ধরে। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার বাসভবনের বারান্দার সিঁড়ি পর্যন্ত এসে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানান। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ভবনের প্রধান ফটকে পৌঁছলে সেখানে উপস্থিত দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ও আলোকচিত্রিরা তাঁর গাড়ি ঘিরে ধরেন। বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছায় গাড়ি থেকে সাংবাদিকদের জানান, ‘আমি রাজনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আরও অলোচনা হবে। এটি দু’এক মিনিটের ব্যাপার নয়। এজন্য সময়ের দরকার। আলোচনা চলবে। কাল সকালে আমরা আবার বসছি। এরচেয়ে বেশি আমার বলার নেই।’ প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে সরাসরি ধানম-ির বাসভবনে ফিরে বঙ্গবন্ধু দলের শীর্ষস্থানীয় সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। গভীর রাত পর্যন্ত এ বৈঠক চলে। দু’দফা সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ফাঁকে বিকেলে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে কনভেনশন মুসলিম লীগ প্রধান ফজলুল কাদের চৌধুরীকে সাক্ষাত দেন। বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠক চলছে, অন্যদিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে আন্দোলন-সংগ্রামে পুরো পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। পহেলা মার্চ থেকেই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ হারায় বাংলাদেশের। সামরিক জান্তাদের কোন আদেশ-নির্দেশই মানছে না বীর বাঙালীরা। একমাত্র সেনা ছাউনি ছাড়া পাকিস্তানের অস্তিত্বই ছিল না কোন জায়গায়। বরং পুরো বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায়, শহর-বন্দরে পতপত করে উড়ছে বাংলাদেশের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট আলোচনার জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করলেও ভেতরে ভেতরে সামরিক জান্তারা ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। কেননা সামরিক জান্তারা বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোস করবেন না। তাই আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে ভেতরে ভেতরে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। প্রতিদিনই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র-গোলাবারুদ আনা হয় পূর্ব পাকিস্তানে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিষয়টি আঁচ করতে পেরে গোপনে সারাদেশেই অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহের মাধ্যমে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র পাক হানাদারদের গুলিতে নিহত হওয়ার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পদত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালীন এটি ছিল একমাত্র পদত্যাগ। এ প্রসঙ্গে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর লেখা ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ গ্রন্থে লিখেছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদান করি। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে জেনেভার একটি পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র নিহত হবার খবর পেলাম। ১৫ মার্চ ঢাকায় প্রাদেশিক শিক্ষা সচিবের কাছে একটি পত্রে জানাই যে, আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম এবং পত্রটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেয়া হোক।’ সারাদেশের অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ বন্ধ। সব সরকারী ভবন, হাট-বাজার এমনকি পাড়া-মহল্লায়ও উড়ছে প্রতিবাদের কালো পতাকা। কোথাও কোথাও বাংলাদেশের নতুন পতাকাও উড়তে থাকে। মহল্লায় মহল্লায় গড়ে উঠতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। সব বয়স, সব পেশা ও শ্রেণীর মানুষ বেরিয়ে আসতে থাকে রাজপথে। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বঙ্গবন্ধুকে আরও উজ্জীবিত করতে রাস্তায়, মাঠে-ময়দানে তখন গণসঙ্গীত, নাটক, পথনাটক ও পথসভা করে চলছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বেতার-টেলিভিশন শিল্পী সংসদ, মহিলা পরিষদ প্রভৃতি সংগঠন। হাইকোর্টের আইনজীবী, বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করতে থাকে।
×