ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম কুদ্দুছ

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা ও ১১ মার্চ ১৯৪৮

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১৫ মার্চ ২০১৭

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের  সূচনা ও ১১ মার্চ ১৯৪৮

(গতকালের পর) করাচীর শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব নিয়ে যখন বিভ্রান্তি, সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভ চলছিল, সেই সময় কিছু অনাকাক্সিক্ষত হাঙ্গামা বাঙালীর মনে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাগুলোকে সামান্য মনে হলেও বাঙালীদের প্রতি অবাঙালী এবং শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণের প্রমাণ মেলে। ছাত্র-শিক্ষক এবং সচেতন নাগরিকদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হতে শুরু করে যে, স্বাধীন পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু বাঙালীরা কি বঞ্চিত-লাঞ্ছিত হবে? ন্যায্য দাবির কথা বলতে গেলে কি বাঙালী বলে নির্যাতিত হতে হবে? তাহলে কি জাতিগত মর্যাদা এবং অধিকারের জন্য সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানেও নতুন করে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে, আন্দোলনে নামতে হবে? এ সময় ৭ ডিসেম্বর ১৯৪৭ ঢাকা রেল কর্মচারীদের এক সভা ফজলুল হকের সভাপতিত্বে শুরু হয়। বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সভায় বাঙালী-অবাঙালীদের মাঝে মতপার্থক্য এবং মারামারি সংঘটিত হলে ফজলুল হক সভা ত্যাগ করে চলে যান। এ সময় পরিকল্পিতভাবে প্রচার চালানো হয় যে, ফজলুল হক রেলওয়ের হিন্দু কর্মচারীদের নিয়ে পাকিস্তান এবং উর্দুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন ও হিন্দুদের বাংলাকে মুসলিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত চালাচ্ছেন। অপপ্রচারের প্রতিবাদে ওই দিনই সিরাজুদ্দৌলা পার্কে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিপর্বে পুরনো ঢাকার একদল লোক চেয়ার ছোড়াছুড়ি করে সভাটি প- করে দেয়। বেশকিছু ছাত্র সে সময় নিগৃহীত হয়। ১২ ডিসেম্বর ১৯৪৭-এ ঘটে আরেকটি পরিকল্পিত ঘটনা। উর্দুর পক্ষে সেøাগান দিতে দিতে ৫০/৬০ জনের একটি গ্রুপ বাস ও ট্রাকে করে ঢাকা শহরের পলাশী এলাকায় আসে। এ সময় পলাশী এলাকার বাঙালী কর্মচারী এবং কিছু ছাত্র বিরূপ মন্তব্য করলে গু-া প্রকৃতির লোকগুলো পলাশী ব্যারাকের সরকারী কর্মচারী এবং পার্শ্ববর্তী আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়। মুহূর্তের মধ্যে এ সংবাদ শহরময় ছড়িয়ে পড়ে এবং উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পলাশী ব্যারাকে সরকারী কর্মচারীদের ওপর উর্দু ভাষার সমর্থক গু-াদের আক্রমণ এবং বিভিন্ন স্থানে বাংলা ভাষার সমর্থক ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। সচিবালয়ের ভেতরে সরকারী কর্মচারীদের ধর্মঘট এবং বাইরে ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ ও প্রতিবাদ বিক্ষোভ দমনে সরকার কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করে। ১৩ ডিসেম্বর থেকে ১৫ দিনের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী অনেক মুসলমান নেতা-কর্মীকে শুধু মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে ষড়যন্ত্রকারী-চক্রান্তকারী হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা এই সময় থেকেই শুরু হয়। পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী প্রকাশ্যে এবং পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম গ্রুপের প্রতিপক্ষ গোপনে এই অপপ্রচারে জড়িত হয়। ১২ ডিসেম্বরের ঘটনার পর পূর্ববঙ্গ সরকার একটি প্রেসনোট প্রকাশ করে। উক্ত প্রেসনোটে পূর্ববঙ্গের বাঙালী-অবাঙালী মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রচারণার অভিযোগে ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ দিনের জন্য কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্র ‘আনন্দবাজার’, ‘স্বাধীনতা’ ও ‘ইত্তেহাদ’-এর প্রচার পূর্ব পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হয়। সেই যে ভারতবিরোধী অকারণ প্রচারণা শুরু হয়েছিল, স্বার্থান্বেষী মহল আজও হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং গোষ্ঠীস্বার্থে সে প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর নাম বা চেহারায় হয়তো এরা আলাদা; কিন্তু চিন্তা, উদ্দেশ্য এবং ঘটনার বাস্তবতায় এরা এক ও অভিন্ন। পাকিস্তান গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন ১৯৪৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই অধিবেশনে উত্থাপিত প্রস্তাব এবং এ সম্পর্কিত আলোচনা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমগ্র পাকিস্তানে বিশেষ করে পূর্ব বাংলার কোন কোন্ গণপরিষদ সদস্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এবং বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তাও জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। পূর্ববাংলার কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেসদলীয় গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই অধিবেশনেই সর্বপ্রথম উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর প্রস্তাব উত্থাপন করে সংসদে বলেন, ‘‘ মি. প্রেসিডেন্ট, এ কথা আমি জানি বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের কথা যদি আমরা চিন্তা করি তাহা হইলে দেখিব যে, রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা হইতেছে বাংলা। কাজেই প্রাদেশিক হইলেও যেহেতু রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা বাংলা, সেই কারণে বাংলা ভিন্ন মর্যাদার দাবিদার। রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ৬ কোটি ৯০ লাখ অধিবাসীর মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ অধিবাসী বাংলা বলে। এই যদি অবস্থা হয় তাহা হইলে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত?.. আমাদের ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ এই সংসদের কার্যবিবরণী বুঝিতে অক্ষম। কারণ যে ভাষাতে ইহা পরিচালিত হয় সে ভাষা তাহাদের অজানা। ২৯ নং রুলে ইংরেজীর সম্মানজনক উল্লেখ রহিয়াছে।.. তাই যদি হয়, ২৯ নং রুলে যদি লিখিত থাকিতে পারে যে, সংসদের কার্যবিবরণী উর্দু অথবা ইংরেজীতে পরিচালিত হইবে, তাহা হইলে ৪ কোটি ৪০ লাখ লোকের মুখের ভাষার একটি সম্মানজনক উল্লেখ রুল নং ২৯-এ কেন থাকিতে পারিবে না? মি. প্রেসিডেন্ট, আমি তাই আমার এই প্রস্তাব দ্বারা লাখ লাখ মানুষের মনের অনুভূতিকেই প্রকাশ করিতেছি এবং সে কারণেই আমাদের রাষ্ট্রে ‘বাংলা’ একটি প্রাদেশিক ভাষা নয়। বাংলা ভাষাকে ‘রাষ্ট্রের’ ভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করিতে হইবে। এবং সে কারণে জনাব সভাপতি, আমি প্রস্তাব করিতেছি: ‘ইংলিশ শব্দের পরবর্তীতে ‘বেঙ্গলি’ এই শব্দটিকে ২৯ নং রুলে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।” [সূত্র : আসুন আর একবার ঐ পথে হেঁটে আসি-লেখক সরদার ফজলুল করিম, ভোরের কাগজ, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮] ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্থাপিত সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি। এদিন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, “পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।’’ [ সূত্র : একুশে ফেব্রুয়ারি, প্রকাশক-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, লেখক-ড. রঙ্গলাল সেন, পৃ. ১২] পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, “উর্দুই একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইতে পারে বলে পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ লোকের অভিমত। বাংলাকে সরকারী ভাষা করার কোনই যুক্তি নেই। তবে পূর্ববঙ্গে শিক্ষা ও শাসনকার্যের ক্ষেত্রে যথাসময়ে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হইবে।” [সূত্র : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশির আল হেলাল, পৃ. ২৪৩] গণপরিষদে কংগ্রেস দলের অস্থায়ী নেতা শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সংশোধনী-প্রস্তাবটি সমর্থন করে বলেন, “এতদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল পাকিস্তান জনগণের, সংখ্যালঘু ও সংখ্যগুরু উভয় সম্প্রদায়ের রাষ্ট্র। কিন্তু পরিষদের নেতার বিবৃতি সম্পর্কে অ-মুসলমানদের বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। শাসনতন্ত্র গঠনে অ-মুসলমানদের কোন অধিকার আছে কিনা সে-কথা এখন তাঁদের ভেবে দেখতে হবে। সংশোধন প্রস্তাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিও করা হয়নি। উর্দু ও ইংরেজীর সঙ্গে বাংলাকেও পরিষদের ভাষার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হয়েছে। [সূত্র : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশির আল হেলাল, পৃ. ২৪৩-২৪৪] গণপরিষদে কংগ্রেস দলের সেক্রেটারি রাজকুমার চক্রবর্তী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশোধনী প্রস্তাবের সমর্থনে বলেন- “উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়। তা হচ্ছে উপরতলার কিছুসংখ্যক মানুষের ভাষা। পূর্ব বাংলা এমনিতেই কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, তার উপর এখন তাঁদের ঘাড়ে একটি ভাষাও আবার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। একে গণতন্ত্র বলে না। আসলে এ হলো অন্যান্যদের ওপর উচ্চশ্রেণীর আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্য কোন চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই পরিষদের সরকারী ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি। ইংরেজীকে যদি সে মর্যাদা দেয়া হয় তাহলে বাংলা ভাষাও সে মর্যাদার অধিকারী।’’ [সূত্র : ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস-বশির আল হেলাল, পৃ. ২৪৪] চলবে...
×