ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. জীবেন রায়

অভিমত ॥ অভিভাবকদের উদ্দেশে কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ১৫ মার্চ ২০১৭

অভিমত ॥ অভিভাবকদের উদ্দেশে কিছু কথা

বেশ কিছুদিন আগে প্রজন্মের ঊদ্দেশে কিছু কথা লিখেছিলাম। দু-চারটা উৎসাহমূলক মন্তব্য পেয়ে আমিও উৎসাহবোধ করছি। শুনেছি সুনামগঞ্জের আমার এক মেসো লেখাটা অনেককে পড়ে শুনিয়েছেন। আমার সেই শ্রদ্ধেয় স্যার, শ্রী বি কে রায়, লেখাটি তাঁর ছেলেকে পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। একজন অভিভাবক হিসেবে তাই এবার অন্য সব অভিভাবকের উদ্দেশে কিছু কথা সবিনয়ে লিখতে চাই। আমার ধারণা, আমেরিকার মানুষগুলোর রক্তের জিনে ভলান্টারিজম দারুণভাবে জড়ানো। স্কুল ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই ভলান্টারি কাজ করতে পছন্দ করে এবং করে থাকে। আমাদের ছোট্ট মেয়ে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। সে তো ভলান্টারি কাজে খোদ আমেরিকানদেরও ছাড়িয়ে। আজ এখানে, কাল সেখানে, লেগেই আছে। আমি বলি যথেষ্ট হয়েছে, কেননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাকে ড্রাইভ করে আনা-নেয়া করতে হয়। তবে আমি নিজে আজকাল আর ফিজিক্যালি ভলান্টারি কাজ করতে যাই না। আমি মনে করি এই যে আমি বাংলাদেশে এবং এখানে লোকাল পত্রিকায় লিখি এটাই আমার ভলান্টারি কাজ। আমি তো কখনও পয়সার আশা করে লিখি না। প্রতিবছর আমাদের বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। তাতে কমিউনিটি সার্ভিসেসের কথাও লিখতে হয়। আমি যখন এখানে নিয়মিত লেখা শুরু করি তখন আমার ডিপার্টমেন্টে হৈ চৈ পড়ে যায়। এডিটরিয়াল পেজে এত আমাদের কলিগ জীবেন? নানা দিক থেকে ইমেইলে অভিনন্দন আসতে থাকে। একজন কলিগ নোটিস বোর্ডে আমার লেখাগুলো প্রায়ই পোস্ট করে যাচ্ছে। আমার এক কলিগ বলছে এই লেখালেখিই আমার কমিউনিটি সার্ভিস। পরবর্তী একটি লেখায় সেগুলোর ভাষান্তর করে পাঠাব। যা হোক, আমেরিকানদের কথা বলছিলাম। ভলান্টারি ছাড়াও দান-দক্ষিণায় এরা এভারেস্টের চূড়ায়। দেখুন না বিশ্বের সবচাইতে ধনী মানুষগুলো, যেমন বিল গেটস, ওয়ারেন বাফে, মার্ক জুকারবার্গ তাদের সর্বস্ব সারা বিশ্বের মানুষকে মঙ্গলের জন্য দিয়ে দিয়েছেন। বিল গেটসের ইচ্ছে তার মেয়ে আগে উন্নত শিক্ষা নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করুক। এসব জিনিয়াস এবং সহানুভূতিশীল নমস্য মানুষের জন্যই পৃথিবীটা এত সুন্দর। চাঁদ আর ঝলসানো রুটি নয়। বরং ভালবাসার আধার। মার্কিন সামাজিক ব্যবস্থায় ১৮ বছর পর ছেলেমেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলে। এমনকি পড়াশোনা করতে কিংবা বাড়ি, গাড়ি কিনতে ব্যাংক থেকে লোনের ব্যবস্থা করে দেয়। আবার ধনী লোকজন সমস্ত খরচ চালিয়েও যায়। তবে এখানকার ধনী লোকের ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগই একেবারে বকে যায় না। তবে একেবারে যে যায় না তেমনও নয়। ‘এনফ্লুয়েঞ্জা’ শব্দটি এসেছে সেইসব ধনী ছেলেমেয়েদের বকে যাওয়া থেকেই। এটা হলো ধনী ছেলেমেয়েদের টাকার জ্বর রোগ। তবে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্ম একই রকম মেধার অধিকারী হবে তেমন কোন কথা নয়; আবার উল্টোটাও হতে পারে। মহাত্মা গান্ধী কিংবা মার্টিন লুথার কিং-এর ছেলেমেয়েরা তাদের মতো হয়নি; কিন্তু বখেও যায়নি। আবার জওহরলাল নেহরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী এবং তার পুত্র রাজীব গান্ধী একই জিনের যে ধারক ছিলেন, ইতিহাস তাই প্রমাণ করে। আঠারো হতেই ছেলেমেয়েরা আলাদা, আমরা বাঙালীরা তেমনভাবে ভাবতে পারি না। সেটা অবশ্য আমাদের জন্য ভালই। আমাদের পারিবারিক সম্পর্কগুলো এখনও অনেক দৃঢ় আছে। আমরা শুধু মা, বাবা দিবসে কিংবা ভ্যালেন্টাইন ডেতে একগুচ্ছ ফুল কিংবা রেঁস্তরাঁয় খাইয়েই দায়িত্ব পালন করি না। যদিও এসব জয়েন্ট ফ্যামেলি কন্সেপ্ট অনেকটাই চলে গেলেও এখন পর্যন্ত ছেলেমেয়ে নাতি-নাতিনে আটকে আছে। এটা অবশ্যই যথাযথ এবং তাই থাকা উচিত। আমার মনে আছে আমার দ্বিতীয় মেয়ে যখন আটলান্টায় এমোরী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার ডিগ্রী পড়ছিল, তার পুরনো গাড়িটা প্রায়ই বিগড়ে যাচ্ছিল। আমরা তখন একটা নতুন গাড়ি কিনে দেই। মেয়ে হয়ত ভাবতে পারেনি, পরে জেনেছি সে নাকি কেঁদেছিল। আমি একথা বলছি না, আমি এখন অভিভাবক এবং মেয়েদের ওপর ভরসা করে আছি। যদিও আটলান্টা থেকে যখনই আসে একগাদা শাক-সবজি, বাংলাদেশী মাছ, মুড়ি, সরিষার তেল ইত্যাদি নিয়ে আসে। এই যে আমার দ্বিতীয় মেয়েটি চাকরিসূত্রে প্রচুর গাড়ি চালাতে হয়, প্লেনে চড়তে হয়। সর্বদাই একটা চিন্তায় থাকি। এটা সহজাত। আবার আমরা কেউ অসুস্থ হলে বড় মেয়ে (ডাক্তার) বলবে এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে যাও। আমি তো এই ধনাঢ্য দেশে যুবক বয়স থেকেই আসা-যাওয়া করছি, থাকছি। আমি এখন সিনিয়র সিটিজেন তথা অভিভাবক হয়ে গেছি। কিন্তু মহিলাদের কোমড় জড়িয়ে নাচানাচিটা তো রপ্ত করতে পারিনি। দেশে থাকতে কিংবা এই দেশে এসেও তিনটি মেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলাই ছিল আমাদের একমাত্র ধ্যান-ধারণা। আমার ভাবতে ভাল লাগে বাংলাদেশেও মেয়েরা আজকাল ঘরে বসে থাকে না। শিক্ষায় ভাল করছে। সব ধরনের কাজে যোগ দিচ্ছে। এরই নাম তো পারিবারিক উন্নয়ন এবং তথা দেশের উন্নয়ন। বাংলাদেশে ধনী ছেলেমেয়েদের কা-কারখানা কেমন? পত্র-পত্রিকার সূত্র ধরে বলতে হয় তেমন সুবিধের নয়। প্রায়ই দেখা যায় কুকীর্তি, দুর্নীতি, গান কিলিং এবং অসংযত জীবনযাপন কিংবা এক্সট্রিম র‌্যাডিক্যালের দিকেও ঝুঁকে পড়ে। আমার ধারণা, কোন অভিভাবকই চান না তাদের ছেলেমেয়েরা বিপথে হাঁটা শুরু করুক। তারপরও বিপথগামী হয়ে ওঠে। তবে অবশ্যই অভিভাবক নিজেদেরও সংযত জীবনযাপন করতে হবে। ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে অন্য কাজ করবে সেটাও স্বাভাবিক। পারিবারিক কাজে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে কাজ করে অভিজ্ঞতা নেবে সেটাও ঠিক। আর এভাবেই ছেলেমেয়েরা অভিজ্ঞ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের গরিব, নিম্ন, মধ্যবর্তী পরিবারের অভিভাবকদের সচ্ছলতার একমাত্র পথ তাদের ছেলেমেয়েদের উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করে যাওয়া। আমি জানি অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে উঠে না। কিন্তু চেষ্টা করলে কিছুটা সফলতা তো আসবেই। সেইসঙ্গে সচ্ছল এবং ধনী অভিভাবকগণেরও তৎপর থাকতে হবে কি করে শিক্ষার সিঁড়িটিকে তাদের ছেলেমেয়েদের ধরিয়ে দেয়া যায়। বাংলাদেশেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অনেক বিজনেসই বেশ ভালভাবে টিকে আছে এবং চলছে। সেটাও তো শিক্ষারই ফল। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাক্ষেত্রে কোন পরিবার থেকে কেউ যদি প্রথম প্রজন্ম কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তাদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্থা আছে। আমি জানি, শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশে মেয়েদের এখন অগ্রাধিকার। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ভাল। কোন গরিব পরিবার থেকে প্রথম কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসলে তাদেরও আর্থিক সহায়তা দেয়া যায় কিনা দেখা উচিত অথবা কোন একজন সহৃদয় ধনী ব্যক্তি এ ধরনের একটি বৃত্তি চালু করতে পারেন। বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকটা মুনাফাভিত্তিক হয়ে উঠেছে। তাদের মুনাফার টাকা শিক্ষাতেই খাটানো উচিত। তাতে অনেকের জীবন পরিবর্তন করে দেয়া যাবে। বাংলাদেশে বিনে পয়সায় স্কুল পর্যন্ত পড়া যায়; কিন্তু বিনে পয়সায় পড়ার বিশ্ববিদ্যালয় তো নেই। অবশ্য বিশ্বের কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। এমন বিশ্ববিদ্যালয় থাকলে অনেকেই বিনে পয়সায় গ্রীষ্মের তিন মাস পড়াতে আসত। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত কর্মক্ষেত্রের চাহিদা নিয়ে বিল গেটস সম্প্রতি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের তিনটি এরিয়ার কথা বলেছেন। বিল গেটস হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন; কিন্তু পড়াশোনা শেষ করেননি। করবেন কেন? তিনি নিজেই তো একটা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছেন। কাজের ভবিষ্যত তার মতে (১) আর্টিফিসিয়েল ইন্টেলিজেন্স (২) এনার্জি সেক্টর (আরেক জিনিয়াস, ইলন মাস্কের কাজের কথা উল্লেখ করেছেন) এবং (৩) বায়োটেকনোলজি। প্রথমটির সঙ্গে কম্পিউটার, রোবোটিক বিজ্ঞান জড়িত। দ্বিতীয়টির সঙ্গে সোলার এনার্জি জড়িত। টেসলা খ্যাত ইলন মাস্ক সোলার রুফ টাইলস তৈরি করছে এবং অন্যান্য ফিউচার ইস্টিক কাজ কারবার করছে। তৃতীয় ক্ষেত্রটি অতি পুরনো হলেও অনেক নতুন নতুন ওষুধ তৈরি হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত ডিএনএ ভ্যাক্সিন তৈরি হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশেও এসব ক্ষেত্রে বেসিক পড়াশোনা হচ্ছে। তবে সৃজনশীল হতে হবে। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী অধ্যাপক [email protected]
×