ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একান্ত সাক্ষাতকারে একজন ডায়েবেটিক;###;মাহবুব উজ জামান

ডায়াবেটিক রোগীকে নিজেকে নিজের ডাক্তার হতে হয়

প্রকাশিত: ০৭:১২, ১৪ মার্চ ২০১৭

ডায়াবেটিক রোগীকে নিজেকে নিজের ডাক্তার হতে হয়

‘পুরনো ডায়াবেটিক রোগী হয়েও সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব। সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ডায়াবেটিক রোগীকে নিজেকে নিজের ডাক্তার হতে হয়।’ সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিলের সদস্য, বারডেমের পেসেন্টস ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুব উজ জামানের প্রথম কথা ছিল এটি। সাক্ষাতকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার নিখিল মানখিন। জনকণ্ঠ : একজন ডায়াবেটিক রোগী হিসেবে ডায়াবেটিস সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করুন। মাহবুব উজ জামান : বর্তমানে আমার বয়স ৮১। আমি একজন ৫৫ বছরের পুরনো ডায়াবেটিক রোগী। আমার সিরিয়াল নম্বর ১২৮৯। বর্তমানে ডায়াবেটিক রোগীর সিরিয়াল নম্বর পাঁচ লাখ আট হাজার ছয় শ’য়ের ওপরে। পুরনো ডায়াবেটিক রোগী হিসেবে সচেতনতা সম্পর্কে আমি দুটো কথা বলব। কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা ইত্যাদি জীবাণুভিত্তিক রোগ। তাই এসব রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ডায়াবেটিস বংশানুগতিক বা জেনেটিক রোগ। তাই তা প্রতিরোধ সম্ভব হয়নি। উত্তরাধিকার সূত্র আপনি অগাধ সম্পত্তির মালিক হতে পারেন, যা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ডায়াবেটিস রোগ নষ্ট হয় না। ডায়াবেটিস রোগ এমন একটি রোগ যে মাদুর বিছিয়ে রাখে, যত রকম রোগ আছে তাদের আমন্ত্রণ জানায় এই বলে যে, এসো ভাই, একটু বসো। একবার বসতে পারলে আর ছাড়াছাড়ি নেই। বিশেষ করে চোখ, হার্ট এবং কিডনি ইত্যাদি নষ্ট করে ছাড়ে। এ ছাড়াও নানাবিধ রোগেও একজন ডায়াবেটিক রোগী আক্রান্ত হয়। জনকণ্ঠ : পুরনো একজন ডায়াবেটিক রোগী হয়েও আপনি কিভাবে সুস্থ জীবনযাপন করছেন? মাহবুব উজ জামান : অনেকেরই প্রশ্ন আমি এতদিনের পুরনো রোগী কিভাবে সুস্থ আছি। আমার ভাল থাকার মূল কারণ নিয়ম মেনে চলা। একজন ডায়াবেটিক রোগীকে অবশ্যই খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ সেবনসহ শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। অনেক সময় খেতে বসার পর সুস্বাদু খাবার পরিবেশিত হয়। প্রয়োজনমতে খাবার পর গৃহিণী বলে আরও একটু নাও। একদিনে একটু বেশি খেলে কিছু হবে না। তারপর খেলেই হয় সর্বনাশ। আমি সকালে উঠে প্রথমে রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করি এবং পরিমাণমতো ইনসুলিন নিই। সকাল আটটার মধ্যে আমার নাস্তা পর্ব শেষ হয়। বেলা ১১টায় সামান্য কিছু খাই। হতে পারে নোনতা বিস্কুট বা খই-মুড়ি বা সামান্য ফলফলাদি। এরপর দেড়টা থেকে দুটোর মধ্যে দুপুরের খাওয়া শেষ করি। পেটুপুরে খাই না। বিকেল ৫টার দিকে হাল্কা নাশতা খাই। রাত ৮টায় পরিমাণমতো ইনসুলিন নিয়ে রাতের খাবার পর্ব শেষ করি। আমি এভাবে চলি। তবে প্রত্যেক মানুষের মাঝে মাঝে ভালমন্দ খেতে ইচ্ছে হয়। আমিও মাঝে মাঝে মনটা ভরে আম, কাঁঠাল, অন্যান্য ফলমূল, মিষ্টি, মাছ-মাংস খেয়ে থাকি। তারপর সতর্ক হয়ে রক্তের শর্করা পরীক্ষা করে কতটা বাড়ল তা দেখে প্রয়োজনমতো ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়াই এবং পরবর্তী খাবার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। এতে দেখা যায় আমার সবকিছু নিয়ন্ত্রণে। এক্ষেত্রে বলতে হয় যে, নিয়মিত ডায়েট, ড্রাগ এবং হাঁটাহাঁটি করে থাকি। কেউ যদি সকালের নাশতা অনিয়মিত অভ্যেস করে তবে তার জন্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা দুরূহ। এ জন্য আমি মনে করি ডায়াবেটিক রোগীকে নিজেকে নিজের ডাক্তার হতে হয়। জনকণ্ঠ : বারডেমের পেসেন্টস ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ডায়াবেটিক রোগীদের বিষয়ে আপনার ধারণা কেমন? মাহবুব উজ জামান : অনেক ডায়াবেটিক রোগী নিজেদের শরীরে ডায়াবেটিসের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা রাখেন না। তাদের দেহে ডায়াবেটিস থাকলেও তা কমিয়ে বলার চেষ্টা করেন। ডায়াবেটিসের প্রাথমিক অবস্থা নিয়ে আসা ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা কমই থাকে। আমি লক্ষ্য করেছি যে, একজন রোগী সে সুস্থ নয় অথচ জাহির করতে চায় যে, সে সুস্থ। যেদিন রক্ত পরীক্ষা করার তারিখ থাকে তার দু’দিন আগে খাবার নিয়ন্ত্রণে এনে রক্ত পরীক্ষা করায়। আমি তখন তার রিপোর্ট ভাল দেখে তার এইচবিএ১সি পরীক্ষা করে দেখতে পাই যে, সেটা মোটেই নিয়ন্ত্রণে নেই। এটা করে সে নিজের ভবিষ্যত নিজেই অন্ধকার করছে। জনকণ্ঠ : আপনার কর্মজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন। মাহবুব উজ জামান : আমি জীবনে বহু কর্মকা-ে জড়িত। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড চেয়ারম্যান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজের গবর্নিং বডির সদস্য, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব এবং ওরিয়েন্ট স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি, শিশুস্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি জেনারেল এবং ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কমিটির সদস্য এবং বারডেম পেসেন্টস ওয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যান, বকশীবাজার বায়তুল মামুর মসজিদের সভাপতিসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে জড়িত ছিলাম এবং রয়েছি। এতসব করা সম্ভব হয়েছে শুধু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার কারণেই। যার জন্য ডায়াবেটিসকে রোগ না বলে আমি বলি ‘ডায়াবেটিস একটি নীরব আশীর্বাদ। জনকণ্ঠ : পুরনো ডায়াবেটিক রোগী হয়েও আপনি কিভাবে এতসব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন? মাহবুব উজ জামান : জীবন সম্পর্কে সচেতনতা এবং কাজের প্রতি আগ্রহ, অধ্যবসায়, আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতা থাকলে অনেক কিছু করা সম্ভব। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। জনকণ্ঠ : দেশের ডায়াবেটিসের অবস্থা এবং করণীয় সম্পর্কে কিছু বলুন? মাহবুব উজ জামান : বাংলাদেশে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৭১ লাখ, বছরে বাড়ছে আরও ১ লাখ রোগী। বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত ও ওই সব রোগ আক্রমণের পথ প্রশস্ত করে ডায়াবেটিস। কেবল ডায়াবেটিসের জটিলতা কমাতে পারলে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতেই বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় কমানো সম্ভব বলে মনে করছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে ৬৪ কোটি ২০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সচেতনতার অভাবে অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিসে মোট আক্রান্তের শতকরা ৫ ভাগ আক্রান্ত টাইপ-১ ডায়াবেটিসে। এই প্রকার ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা ইনসুলিন ছাড়া বাঁচতে পারেন না। তাদের ইনসুলিনপ্রাপ্তি মানবাধিকার হয়ে দাঁড়ায়। ডায়াবেটিক সমিতির মাধ্যমে প্রতিবছর দেশের গরিব রোগীদের জন্য ৯ কোটি ইনসুলিন সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এর পরও ইনসুলিন পায় না টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শত শত রোগী। গরিব রোগীর পক্ষে বছরের পর বছর ধরে ইনসুলিন গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হাসপাতাল, ক্লিনিক, থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা সেন্টারসমূহে সরকারী উদ্যোগে স্বল্প খরচে ইনসুলিন সরবরাহ এবং ডায়াবেটিস পরীক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। ডায়াবেটিস এমন এক রোগ, যা সুনিয়ন্ত্রণে না থাকলে রোগীর হৃৎপি-, কিডনি ও চোখসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। ডায়াবেটিস আছে এমন রোগীদের শতকরা ৫০ ভাগই জানেন না যে, তাদের ডায়াবেটিস আছে। তাই বছরে অন্তত একবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা দরকার। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মাহবুব উজ জামান আরও বলেন, ডায়াবেটিক সমিতি সাধ্যমতো বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সমিতির একার পক্ষে সারাদেশে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ কার্যক্রম সফল করা সম্ভব নয়। এটি সমন্বিত উদ্যোগে বাস্তবায়ন করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে যাতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নেয়া উচিত। স্কুল-কলেজে খোলা মাঠ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এককভাবে না পারলেও কয়েকটি স্কুল বা কলেজ যাতে সম্মিলিতভাবে একটি খেলার মাঠের ব্যবস্থা করে সে বিষয়ে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে। টিভি-রেডিও-সংবাদপত্রে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন বা সেøাগান প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। এলাকাভিত্তিক ওয়াকিং ক্লাব, সুইমিং ক্লাব ইত্যাদি গড়ে তোলা উচিত। গৃহায়ন কর্মসূচীর অনুমতি দেয়ার সময় হাঁটা-চলার জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা ও খেলাধুলার জন্য কিছুটা জায়গা রাখার বিধান রাখা যেতে পারে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে স্বাস্থ্য শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে (যেমন মসজিদে খুতবার সময়) ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও সুস্বাস্থ্য রক্ষা সংক্রান্ত সচেতনতামূলক বক্তৃতা করার ব্যাপারে ধর্মীয় নেতাদের উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। আর মোবাইল অপারেটররা যাতে প্রতিদিন স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতামূলক সংক্ষিপ্ত বার্তা (এসএমএস) পাঠাতে অন্তত ৩০ সেকেন্ড সময় ব্যয় করে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। জনকণ্ঠ : কী উদ্দেশ্যে আপনি বারডেম হাসপাতালে নিজের নামে ‘মাহবুব উজ জামান এ্যাওয়ার্ড’ প্রবর্তন করেছেন? মাহবুব উজ জামান : নার্সরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দিনরাত অন্য মানুষের সেবা করে যাচ্ছে, এটা কত বড় অবদান সেটি সবার চিন্তা করা দরকার। যারা এই কাজটা এত আন্তরিকতার সঙ্গে করে যাচ্ছেন তাদের পুরস্কৃত করা দরকার- এই ভাবনা থেকেই তাদের পুরস্কৃত করার কথা ভাবি। ২০১০ সালে এটা শুরু হয়েছে, আমি যতদিন পারি চালিয়ে যাব, তবে আমার মৃত্যুর পরেও যেন এটি থেমে না যায় সে জন্যও আমি পথ করে যাব। জনকণ্ঠ : ডায়াবেটিক রোগীদের কী পরামর্শ দেবেন? মাহবুব উজ জামান : আপনারা নিজেদের জীবনকে ভালবাসুন। নিজেকে মন দিয়ে ভালবাসলে শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন করবেন। আর সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে ডায়াবেটিসকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
×